মতামত

‘জাতীয় গণহত্যা দিবস’ বিজয়ের ইতিহাসে নতুন সংযোজন

হাসান মাহামুদ : মুক্তিযুদ্ধের ৪৬ বছর পর দেশে এবার প্রথমবারের মতো পালিত হতে যাচ্ছে ‘জাতীয় গণহত্যা দিবস’। এরই মধ্যে বিষয়টি জাতীয় সংসদে পাশ হয়েছে। ১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বর জেনোসাইডকে জাতিসংঘ কনভেনশনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। জাতিসংঘের কনভেনশনটির মাধ্যমেই আমরা এমন নতুন একটি ইতিহাস সৃষ্টি করতে পেরেছি। এটি আমাদের জাতিগত বিজয়। মুক্তিযুদ্ধের একটি বিরল সম্মানের অনুষঙ্গও বটে। যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের ইতিহাস এরই মধ্যে বিশ্বে স্বাতন্ত্র অর্জন করেছে। এর মধ্যে আমাদের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এটি জাতি হিসেবে বাঙালি বিষয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের গবেষকদের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করেছে। প্রতিবছর আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনকে কেন্দ্র করে বিশ্বের নামিদামি গবেষকদের আগমণের মাধ্যমে বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশ যখন সৃষ্টিই হয়নি, সেই ১৯১৩ সালে রবীঠাকুরের নোবেল বিজয়ের মাধ্যমে বাংলা ভাষা নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গণে আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল। তখন অনেক মনীষী-গবেষক এই বঙ্গে আসতো বাংলা নিয়ে গবেষণা করতে, রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকর্ম কাছ থেকে গবেষণা করতে। এরপর কাজী নজরুল ইসলামের সৃষ্টিকর্ম নিয়ে কাজ করতেও অনেককে আমরা দেখেছি। কিন্তু ১৯৭০ সালের অনুষ্ঠিত অবিভক্ত পাকিস্তানের প্রাদেশিক নির্বাচনের পর বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রাম শুরু হলে অনেকেই এই অঞ্চলে এসেছেন সংবাদ সংগ্রহে, গবেষনায়। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় সারাবিশ্বের সর্বোচ্চ আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল বাংলাদেশ তথা পূর্ব পাকিস্তান। তার ধারাবাহিকতা আমরা পরবর্তী সময়েও দেখতে পেয়েছি। কিন্তু গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে যেন ক্রমাগত মঙ্গল সাধন হচ্ছে। ধারাবাহিকভাবে অর্থনীতির আকার, জিডিপি প্রবৃদ্ধির আকার বাড়ছে- তাও আবার রেকর্ড সৃষ্টি করেই। বিশ্বের বিভিন্ন পরাশক্তির দেশগুলোর কূটনৈতিক সিদ্ধান্তে থাকছে বাংলাদেশ। এমনকি ক্রিকেট, গলফ, বডি বিল্ডিংসহ কয়েকটি ক্রীড়াতেও বাংলাদেশ বিশ্বে সুনাম অর্জন করেছে। তবে এসব বিষয়কে ছাপিয়ে গত কয়েক বছর ধরে বিশ্বে অনন্যতায় পৌঁছেছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। প্রতিটি জিনিস গড়ার পেছনে একটা প্রক্রিয়া থাকে। বহুমুখী ও বহুমাত্রিক প্রক্রিয়ায় মানুষও গড়ে ওঠে। প্রক্রিয়াটির দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে। প্রথমত, অনুভূতি ও হৃদয় গড়ে তোলা। দ্বিতীয়ত, বুদ্ধির উন্মেষ ঘটানো। তেমনি অর্জন বা পরিণতি এবং মঙ্গল প্রচেষ্টার প্রক্রিয়ায় একটি জাতি এগিয়ে চলে। আমাদের মুক্তির সংগ্রামে এই দুটো বিষয় যেন সমান তালেই কাজ করেছে। এজন্য আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল একযোগে, একই মতাদর্শে। স্বাধীনতার মতাদর্শের বাইরে যারা ছিল, তাদের বিচারকাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং হচ্ছে। এটি আমাদের জন্য সৌভাগ্যের বিষয় যে মিডিয়াকর্মী হিসেবে আমরা এসব ঘটনার সাক্ষী হতে পেরেছি। এক্ষেত্রে বলা যেতে পারে যে, স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরেও আমরা স্বাধীনতার ইতিহাসের অংশীদার হতে পারছি। মুক্তিযোদ্ধা হত্যার কলঙ্ক আমরা এখনো পুরোপুরি দূর করতে হয়তো পারিনি। কিন্তু আমরা আশাবাদী, আমরা এই বিষয়টিও দেখে যেতে পারবো। একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধের দিনগুলোতে বাঙালির পাশে দাঁড়ানো বিদেশি বন্ধুদের ৪২ বছর পর হলেও সম্মাননা জানিয়েছে বাংলাদেশ। এই বন্ধুদের মধ্যে রয়েছেন ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, কিউবার নেতা ফিদেল কাস্ত্রো, ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়, যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী লর্ড হ্যারল্ড উইলস, জাপানের অধ্যাপক ও সমাজসেবী তোমিয়ো মিজোকামি ও হেইজি নাকামুরা, যুক্তরাষ্ট্রের পুরাতত্ত্ব বিশারদ ডেভিড নালিন, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কর্মী ইপ্সিতা গুপ্ত, কলকাতার সমাজেসেবী লেডি রানু মুখোপাধ্যায়, পশ্চিমবঙ্গের সাবেক উপমুখ্যমন্ত্রী বিজয় সিং নাহার, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অনীল কুমার সরকারের মতো বিশ্বখ্যাত ব্যক্তিরা। এসব ব্যক্তির কল্যাণে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এখন বিশ্বব্যাপী অনেকটাই পরিচিত অর্জন করেছে। এর সঙ্গে নতুন সংযোজন হতে যাচ্ছে জাতীয় গণহত্যা দিবস। ২৫ মার্চকে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার দাবিটি দীর্ঘদিন ধরে আমাদের চেতনায় ছিল। এবার পরিপূর্ণতা পেতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত এই দিনটি বিশ্বমানবতার প্রতি চূড়ান্ত এক আঘাতের দিনও বটে। তাই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত রেজ্যুলেশন ২৬০(৩)-এর আওতায় বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরাটা যৌক্তিক দাবি বলেই আমরা মনে করছি। ২৫ মার্চ বাঙালির ইতিহাসের এক অনবদ্য দিন। একদিকে স্বাধীন আকাঙ্ক্ষা ধ্বংসের দিন, শুভ-সুন্দর স্বপ্নের ওপর অসুর ও অসুন্দরের প্রভুত্ব স্থাপনের দিন, পরিকল্পিতভাবে একটি জাতি ও গোষ্ঠী বিনাশের দিন। আবার অন্যদিকে তা জাতিগতভাবে মৃত্যুঞ্জয়ী অলক্ষ্য স্বপ্নের বীজ বপনের দিন। দীর্ঘ নয় মাস সংগ্রামের শুরু হয়েছিল এদিনের প্রতিরোধের মাধ্যমেই। সে হিসেবে গণহত্যা দিবস উদযাপনের মাধ্যমে আমরা প্রতিবছর আমাদের স্বপ্নকে ছুঁয়ে দেখার উপলক্ষ্য উদযাপন করবো। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসও পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির ইতিহাসের তুলনায় অনেক বেশি সমৃদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের ‍শুরুতেই ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ আরম্ভ করে। যার উদ্দেশ্য ছিল বাঙালির প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দেওয়া। কিন্তু আমরা ঠিকই আমাদের প্রতিরোধ অব্যাহত রাখতে পেরেছি। বিজয় ছিনিয়ে আনতে পেরেছি। অপারেশন সার্চলাইট বিষয়টি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে একটি জঘন্য ইতিহাস হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়েছে এবং এটি নিকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এখন এই জঘন্য উপলক্ষটিকে আমরা জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করতে যাচ্ছি। এরই মধ্যে আওয়াজ উঠেছে দিবসটিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পালনের ব্যবস্থা করা হোক’। আমরাও এই দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করছি। কারণ, এটি অবশ্যই আমাদের রক্তিম সূর্যে উদ্ভাসিত গৌরবান্বিত জাতীয় বিজয়ের ইতিহাসে এক নতুন সংযোজন। লেখক: সাংবাদিক। রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ মার্চ ২০১৭/হাসান/শাহনেওয়াজ