মতামত

সু চি শান্তি প্রতিষ্ঠায় দৃষ্টান্ত হতে পারেন

জাহাঙ্গীর আলম বকুল: বাংলাদেশের জনগণের মুক্তিযুদ্ধে উপনীত হওয়ার আগের ইতিহাস যদি পর্যালোচনা করা হয়, তাহলে ১৯৪৭ সালের দেশ-বিভাগের পর থেকে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়া পর্যন্ত দেখা যাবে- অধিকারহীনতা আর বৈষম্যের পর্যুদস্ত ইতিহাস। একটা জাতি কখন যুদ্ধে নামে, তা এ সময়ের ইতিহাস লেখা আছে। এটা সব জাতিসত্তার ক্ষেত্রে একই রকম। এ দেশের মানুষ শোষণ-নির্যাতন সহ্য করেছে। যুদ্ধজয়ী একটা জাতিকে বিজয়ের কয়েক বছরের মধ্যে সামরিক শাসনে আবদ্ধ হতে হয়েছে। ১৫ বছর গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে গণ-অভ্যুত্থান ঘটাতে হয়েছে। এ দেশের মানুষ শোষিত-নির্যাতিত হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ করেছে এবং সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়েছে। তাই এ দেশের জনগণ সব সময় অধিকার বঞ্চিতের পক্ষে। এটা এ দেশের মানুষের নৈতিক অবস্থান। মিয়ানমারের এনএলডি পার্টির প্রধান অং সান সু চি নির্বাচনে জয়ী হলেও যখন জান্তা সরকার তাকে ১৫ বছর গৃহবন্দি করে রাখে, তখন তিনি এ দেশের মানুষের নৈতিক সমর্থন এবং সহানুভূতি লাভ করেন। অং সান সু চি কূটনীতিক, রাজনীতিক এবং লেখিকা। দিল্লি এবং যুক্তরাজ্যে পড়ালেখা করেছেন। এগুলো ছাপিয়ে তার পরিচয় তিনি আধুনিক মিয়ানমারের প্রতিষ্ঠাতা অং সানের কন্যা। ১৯৯০ সালের নির্বাচনে তার দল এনএলডি দেশটির সংসদের ৮১ শতাংশ আসন পেলেও সেনাবাহিনী ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি। এ নির্বাচনের আগেই সু চি গৃহবন্দি হন। এরপর ২১ বছরের মধ্যে ১৫ বছরই সু চিকে বন্দি থাকতে হয়েছে। তত দিনে তিনি বিশ্বের সবচেয়ে প্রখ্যাত রাজবন্দিদের একজন হয়ে ওঠেন। সু চি কারাবন্দি থাকা অবস্থায় ১৯৯১ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান। নোবেল কমিটি হিংসার বিরুদ্ধে অহিংসা ও গণতন্ত্রের সংগ্রামে তার অপসহীন মনোভাবের কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। সেই সু চি আজ সারা বিশ্বে নিন্দিত-ধিকৃত।  ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে মিয়ানমার স্বাধীন হওয়ার পর বিভিন্ন সরকারের সময় রোহিঙ্গাসহ সকল জাতিগোষ্ঠী পূর্ণ নাগরিক হয় এবং আইনসভায় তাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল। রোহিঙ্গারা মন্ত্রীও হয়। বিস্ময়ের বিষয়, ১৯৮০-র দশকে সে দেশের সামরিক শাসকরা হঠাৎ আবিষ্কার করেন, রোহিঙ্গারা বার্মিজ নয়। এরপর তারা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেন এবং তাদের সে দেশ থেকে বিতাড়িত করার জন্য সামরিক ও রাজনৈতিক কৌশল নেন। শুরু হয় জাতিগত ও ধর্মীয় নিধনের উদ্দেশ্যে রোহিঙ্গাদের উপর সুপরিকল্পিত নির্যাতন। যার সর্বশেষ চূড়ান্ত জাতিগত শুদ্ধি অভিযান শুরু হয়েছে ২৫ আগস্ট থেকে। এরপর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে জাতিগত নির্মূলে রোহিঙ্গাদের ওপর চলছে হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ। সেনা অভিযানে গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে বহির্বিশ্বের মিডিয়া এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রবেশের ওপর কড়াকড়ি থাকায় সব খবর বাইরে আসেনি। এরপর যতটুকু এসেছে তাতে ধারণা করা হচ্ছে, তিন সহস্রাধিক বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং কয়েক হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে চার লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। যা আমাদের মতো গরিব দেশের জন্য গলার কাঁটা। রোহিঙ্গারা এখন রাষ্ট্রহীন। নিজভূমে পরবাসী। তাদের ভোটাধিকার নেই এবং রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারে না। সামরিক সরকারকে যেহেতু জবাবদিহি করতে হয় না, তারা জাতিগত নিধনের মতো হঠকারী ও নিষ্ঠুর পদক্ষেপ নিতে পারে। প্রথমে বলেছি- অধিকার-বঞ্চিত, নির্যাতিত সু চির প্রতি বিশ্ববাসীর মতো এ দেশের মানুষের সমবেদনা ছিল। আজ নির্মম নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিক দায়বদ্ধতা থেকে আশ্রয়-প্রশয় দিতে হচ্ছে। যে সু চি একদিন নিজে অধিকার হারিয়ে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে লড়াই করে মানুষের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা অর্জন করেছেন, সেই সু চির সরকার আজ মানুষকে বাস্তুচ্যুত করছে, হত্যা করছে। সু চি নিজে একজন নারী হয়ে তার সেনা সদস্যদের দ্বারা ধর্ষিত নারীর পক্ষে কথা বলছেন না।  নিশ্চয় এই সু চিকে সেদিন নোবেল প্রাইজ দেয় নোবেল কমিটি। এই সু চির প্রতি শ্রদ্ধায়-ভালোবাসায় বিশ্ববাসীর হৃদয় কাঁদেনি। তার নোবেলসহ গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার ফিরিয়ে নেওয়ার দাবি উঠেছে। অনেকে সু চির সীমাবদ্ধতার বিষয়টি বলার চেষ্টা করছেন। কেননা ২০১৫ সালের ৮ নভেম্বর মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান হলেও সংসদে ২৫ শতাংশ প্রতিনিধিত্ব সামরিক বাহিনীর। নির্বাচনের ফলে এনএলডি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও শাসনতন্ত্রের বিধিবদ্ধ বাধায় দলীয় প্রধান সু চি রাষ্ট্রপতি হতে পারেননি। তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রীয় পরামর্শক। মূলত তিনিই সব কিন্তু নেপথ্যে সব ক্ষমতা জান্তার হাতে। জান্তা প্রভাব থেকে মিয়ানমারের বেরিয়ে আসা সহজ নয় এবং সময়সাপেক্ষ। সু চি স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় জান্তার সুরে কথা বলছেন। সু চি সামরিক বাহিনীর চাপের মুখে অনেক কথা নাও বলতে পারেন, কিন্তু ‘সেখানে পরিস্থিতি খুব মারাত্মক নয়’, ‘অধিকাংশ মুসলিম রাখাইন অঞ্চলে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে’- এমন মিথ্যাচার না করে নিজের ভাবমূর্তি রক্ষার চেষ্টা করতে পারতেন। আরো হাস্যকর-মুসলিমদের সঙ্গে কথা বলে রাখাইনের সংকট সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন তিনি। সরকারের সর্বোচ্চ ব্যক্তির মুখে এ সব কথা দায় এড়ানোর চেষ্টা। কিন্তু দায় এড়ানোর সুযোগ এখন তার নেই। শান্তির নেত্রী থেকে তিনি এখন পুরোদস্তুর রাজনীতিক। সামরিক বাহিনীর অপকর্মের দায়ও তার। সেনাবাহিনী তার সরকারের অধীন একটি প্রতিষ্ঠান। সু চি বলার চেষ্টা করেছেন, দীর্ঘ সময় ধরে চলা সামরিক শাসনের বলয় থেকে বেরিয়ে আসা এতটা সহজ নয় এবং তার সরকারের দেড় বছরে সেটা অসম্ভব। এ কথার বাস্তবতা অনস্বীকার্য। তবে সু চিকে এই সামরিক বাহিনীর উপরে চেপে বসতেই হবে, সেটা আজ হোক, কাল হোক। একটা সুযোগ ছিল- সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সুর না মিলিয়ে তাদের লাগাম টানার চেষ্টা করার। সামরিক বাহিনীকে ক্লোজ করে ব্যারাকে পাঠাতে না পারলে গণতান্ত্রিক দেশ প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। রোহিঙ্গাদের বিষয়ে সু চির প্রকৃত অবস্থান আমরা জানি না। তার অল্প দিনের সরকারের পক্ষে দীর্ঘ দিনের জান্তা সরকারের নিয়ম-নীতি ভাঙা সম্ভব নয়। মিয়ানমারের কোনো প্রশাসনিক কাঠামো নিয়মতান্ত্রিকভাবে কাজ করে না। সব স্তরে সংস্কার সময়সাপেক্ষ এবং কঠিন। পাহাড়সম সমস্যার মধ্যে চলতে হচ্ছে সু চিকে। তবে সব সমস্যা ডিঙিয়ে সু চির উদ্দেশ্য গণতান্ত্রিক মিয়ানমার প্রতিষ্ঠা কি না- সেটাই মুখ্য। সু চির সামনে সুযোগ এসেছে নিজেকে শান্তির মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার। এজন্য প্রথমে নিজের সরকারকে জান্তা নিয়ন্ত্রণ থেকে বের করতে হবে। অবশ্যই দেশের মানুষের অধিকার ফিরিয়ে দিয়ে তাদের মূলস্রোতে এনে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে হত্যা-নির্যাতন চালিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা গণতন্ত্রের পথ নয়। এটা স্থায়ী অশান্তির পথ। জাতির উদ্দেশে ভাষণে সু চি আশ্বাস দিয়েছেন, কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের। শর্তহীনভাবে পূর্ণাঙ্গ সুপারিশ বাস্তবায়নই শান্তির একমাত্র পথ।

   

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ সেপ্টেম্বর ২০১৭/বকুল/তারা