মতামত

নীল তিমির অন্তর্জালে, অন্তর্ঘাতে

ইমদাদুল হক : নীল রঙের সঙ্গে প্রেম-বিরহের সম্পর্ক নতুন নয়। এর সঙ্গে মান-অভিমান এমনকি আত্মহত্যারও একটা যোগসূত্র আছে। নীল তিমির সঙ্গে আমাদের নেটিজেনদের পরিচয় বলতে গেলে অভিষেক পর্যায়ের। তারপরও এই নীল তিমি আমাদের ভার্চুয়াল দুনিয়াকে যতটা নীল করছে তা মোটেই সুখকর নয়। অনেক ক্ষেত্রেই অন্তর্ঘাত পর্যায়ের। ইতিমধ্যেই কেউ কেউ দাবি করছেন, বাংলাদেশে নীল তিমির অস্তিত্ব নেই। এটা অনেকটা তৃপ্তির ঢেকুর তোলা কিংবা বিষয়টিতে কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া। যা আত্মঘাতির নামান্তর। একটি বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল জানায়, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের অধ্যাপক তাজুল ইসলাম জানিয়েছেন দেশে দুজন ব্লু হোয়েল গেইমে আসক্ত। তার দেওয়া ফেসবুক স্ট্যাটাস দেখার পর বাচ্চারা ব্লু হোয়েল গেইমে ‘আসক্ত’ এমন সন্দেহে দুইজন অভিভাবক তাকে মেসেঞ্জারে ছবি পাঠিয়েছেন। এর মধ্যে এক কিশোরের হাতে আঁকা ছবি দেখে তা ‘ব্লু হোয়েল’ আসক্তদের উপসর্গের সঙ্গে মিলে গেছে। তার বড় ভাই তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন। তবে অপর কিশোর চিকিৎসকের কাছে যেতে অনীহা প্রকাশ করেছে বলে জানান তাজুল ইসলাম। অন্যদিকে কেউ কেউ এই ব্লু-হোয়েল নিয়ে নানা মন্তব্যে গরম করছেন সামাজিক অনলাইন প্ল্যাটফর্ম। মন্তব্য ও স্ট্যাটাসগুলোর সময় দেখেও বোঝা যায় তারা কতটা বুঁদ হয়ে আছেন এই ভার্চু্য়াল দুনিয়ায়। মনের অজান্তেই তারা যেন ঘাতক ব্লু-হোয়েলের প্রচারণা চালাচ্ছেন। তাদের বরাতেই এখন ব্লু-হোয়েলের বাহ্যিক বিষয়টি চাউর হয়ে গেছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও। ছড়াচ্ছে আতঙ্ক, কৌতুহল আর ভয়। এ যেন বয়সন্ধিকালের ব্লু-ফ্লিমের কামসূত্র আবিস্কার! দীর্ঘ রজনীতে ঘরের মানুষের সঙ্গে সময় না কাটিয়ে এই টেকিস্টরা অন্তর্জালে জড়িয়ে আছেন! নসিহত করছেন কপি, পেস্ট, তরজমা কিংবা শেয়ারে। সত্যি বড় সেল্যুকাস একটা ব্যাপার। উত্তাল তরঙ্গের সঙ্গে জলকেলি।  এই হ্যামিলিয়নের সুরকে এবার বাঁধা দরকার। সাইবার নিরাপত্তা জোরদার করার পাশাপাশি এবার সোচ্চার হওয়া দরকার প্রযুক্তি আসক্তি নিয়ে। দিনে দিনে এই প্রযুক্তি আমাদের নেশাগ্রস্ত করে ফেলছে সে দিকটিতে এবার একটু আলোকপাত করা দরকার। আমরা আসলে দিন দিন যেন নিজস্ব চিন্তাটাকেই হারিয়ে ফেলছি বহমান স্রোতে। যেমনটা দেখা গেছে সেলফি'র ক্ষেত্রে। অনলাইনে ছবি পোস্ট করা থেকে শুরু করে প্রতিনিয়ত আপডেট দিতে দিতে বিছিন্ন হয়ে পড়ছি ঘর থেকে। সুদূরের কোনো ভার্চুয়াল বন্ধু ঢের প্রেমী হয়ে উঠছে আত্মীয় স্বজনের থেকে। এ যেন এক দুর্বিনীত ঘুর্ণিপাক। এই ঘুর্ণিপাকে ভেসে যাওয়া থেকে এখনই রক্ষা করা দরকার আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে। সন্তানের সঙ্গে বন্ধুত্ব আরও নিবিড় করা দরকার। তাদেরকে আরও সময় দেওয়া দরকার। তবে তারাও ভার্চুয়াল ফ্রেন্ডকে হেঁশেলে না এনে বৈঠক ঘরে আপ্যায়নের মধ্যে সীমিত থাকবে। রাত-দিনের ফারাকটা ঘুচিয়ে না দিয়ে সবারই প্রেয়োজনীয় বিশ্রাম এখন বড্ড জরুরি। ভুলে গেলে চলবে না, চিলে কোঠার যান্ত্রিক জীবন কোনোকালেই জীবনের ঝুঁকি কমাতে পারেনি। শরীর চর্চা ছাড়া মনের পুরিপূর্ণ বিকাশ সবসময় হয়ে ওঠে না। কেবলি ছুটে চলায় বাঁধন শিথিল হয়। জৌলুস তৃপ্তি আনে না, মনের গোপন কোঠরে শুণ্যতার জন্ম দেয় আজান্তেই। সঙ্গত কারণেই চাহিদা আর যোগানে ভারসাম্য না হলে তার নেতিবাচক প্রভাব এড়ানো সহজ নয়। ফলশ্রুতিতে হতাশাগ্রস্তরা যেমন সহজেই আসক্তিতে আক্রান্ত হন। আবার কৌতুহলও কিন্তু টেনে নিয়ে যায় নিষিদ্ধ জগতে। আবার যারা আবেগপ্রবণ, তাদের কাঁচা বয়সটাই আকর্ষিত হয় নতুন জয়ের আশায়। যাকে পরিচর্যা আর বশে না রাখলে ঘটে বিপত্তি। বুমেরাং হয় সব আয়োজন।   এই যেমন আমরা অনেক ক্ষেত্রেই বাচ্চাদের মোবাইল ফোন ব্যবহার, কম্পিউাটর কিংবা ওয়েব দখলদারিত্ব নিয়ে গৌরব করি। আবার এই গৌরবটা যেমনটা অভিভাবক মহলে অহঙ্কারের পর্যায়ে পৌঁছে তেমনি বাচ্চাটাও ধীরে ধীরে বেয়ারা হয়ে ওঠে। মন জয়ের নানা কৌশল রপ্ত করে অভিভাবক হয়ে ওঠে। তখন এই অভিভাবক প্রযুক্তি সম্পর্কে সচেতন না হয়ে হাওয়ায় গা ভাসিয়ে দেন। বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে না মিশে সন্তান ঘরে বসে গেম খেলে অন্তত গোল্লায় যাচ্ছে না বলে তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন। তার শারীরিক বিকাশের বিষয়টি থাকে আলোচনার বাইরে। আর এই সুযোগটাতেই কোমল মনে জন্ম নেয় গেম-আসক্তি। বাড়ির পাশের মাঠ কিংবা কয়েক ডজন বন্ধুর চেয়ে যেই জগতটা আরও বড় এবং অপরিচিত। অথচ সে জায়গাটিতে আমরা কতটা নিশ্চিন্তে তাদেরকে ছেড়ে দিই।   এর ফলে এই কৈশোর বয়সীকে সহজেই হিপনোটাইজ করা হয়। আত্মঘাতি হয় তারা। এই আত্মঘাত কিন্তু সাইবার বুলিং কিংবা সান্ত্রাস লালনের চেয়েও মারাত্মক। আরও গোপন। তাই 'ব্লু-হোয়েল' আসলে একটি সতর্ক বার্তা। আমাদের জন্য অশনি সঙ্কেত। জেগে ওঠার আমন্ত্রন। এমন অজ্ঞাত তিমির মুখে সন্তানকে রেখে আর কতটা উন্নাসিক থাকবো আমরা?   ভুলে গেলে চলবে না, ভার্চুয়াল জগতের যেমন কোনো সীমানা নেই, তেমনি এই জগতের কোথায়, কোন কিনারে যে নীল তিমিরা ওঁত পেতে আছে তা আমাদের অজানা। তাই দেশে নীল তিমির অস্তিত্ব নেই, এ কথাটা মোটেও যৌক্তিক নয়। তেমনি প্রযুক্তি ব্যবহারের বেসামাল দিকটা আলোচনার আড়ালে রাখাটাও বুদ্ধিমানের কাজ নয়। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় একটাই - পরিমিতি বোধ। প্রযুক্তি ব্যবহারের চেয়ে জ্ঞানে এগিয়ে থাকা। শোরগোল আর স্রোতে গা না ভাসিয়ে চিন্তার পরিসর বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ। তবেই কোনো নীল তিমি আমাদের গ্রাস করতে পারবে না। আমরাই এদেরকে হজম করে ফেলতে পারবো অনায়াসে।

   

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১০ অক্টোবর ২০১৭/মিলটন আহমেদ/শাহনেওয়াজ