মতামত

মুগাবে : নায়ক না খলনায়ক?

রাসেল পারভেজ : দীর্ঘ ৩৭ বছর ধরে বিশ্ব জেনে এসেছে জিম্বাবুয়ে মানে মুগাবে, মুগাবে মানে জিম্বাবুয়ে। এবার তার সমাপ্তি হলো। ২১ নভেম্বর পদত্যাগ করেছেন তিনি। যে জিম্বাবুইয়ানদের জন্য জীবন বাজি রেখে তাদের নয়নের মণি হয়ে নায়কের আসন পেয়েছিলেন, আজ তাদেরই ক্ষোভের বিষে জীবনের পড়ন্ত বেলায় ‘পেছন দরজা দিয়ে’ বিদায় নিতে হলো তাকে। অনেকে তাকে ‘খলনায়ক’ অভিহিত করছেন; বিশেষ করে পশ্চিমা গণমাধ্যম তাকে এই চরিত্রে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু আসলেই কি তিনি খলনায়ক? মুগাবের ভূমিকা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে দেখে নেওয়া যাক একবার। শুরুতেই বলে রাখা ভালো, পশ্চিমা ধাঁচের শাসন ব্যবস্থার বরাবরই কড়া সমালোচক ছিলেন তিনি। আর পশ্চিমা গণমাধ্যমের দৃষ্টিতে তিনি একনায়ক ও ক্ষমতার অপব্যবহারকারী। কারো কারো কাছে মুগাবে মহানায়ক, যিনি জিম্বাবুয়ের স্বাধীনতা এনেছিলেন এবং ব্রিটিশ উপনিবেশের শৃঙ্খল ভেঙে সংখ্যালঘু শ্বেতাঙ্গদের শাসন থেকে দেশ মুক্ত করেছিলেন। উপরন্তু সবশেষ যারা তাকে পদত্যাগে বাধ্য করেছেন, তারা এ পরিণতির জন্য স্ত্রী গ্রেস ও তার চারপাশের দুর্নীতিবাজদের দুষেছেন। গত কয়েক বছর ধরে তার বিরুদ্ধে ক্রমেই সমালোচকের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছিল, যাদের কাছে উচ্চশিক্ষিত ও কূটবুদ্ধির এই রাজনীতিক আফ্রিকার একজন স্বৈরশাসক চরিত্রে রূপায়িত হন। তাদের দাবি, ক্ষমতা ধরে রাখতে গিয়ে তিনি পুরো দেশ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে ঠেকিয়েছেন এবং ভীতির রাজত্ব কায়েম করেছেন। মুগাবে তার নেতৃত্বের বিষয়ে ছিলেন আত্মরম্ভী ও অহংকারী। একবার তিনি বলেছিলেন, একমাত্র ঈশ্বরই তাকে ক্ষমতা থেকে সরাতে পারে। কিন্তু তার সেই ধারণা ভুল হলো। মানুষই তাকে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করল। এই পরিস্থিতি তার সমালোচকদের জন্য বিশাল জয়। আরেকটি বিষয় নিয়ে কথা বলা যাক। ব্রিটেনের কাছ থেকে জিম্বাবুয়ের স্বাধীনতা আদায়ের লড়াই তখন তুঙ্গে। ১৯৭৬ সালের কথা। দেশটির স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রগামী রাজনৈতিক দল জানু-পিএফ পার্টির অন্যতম শীর্ষ নেতা ছিলেন রবার্ট মুগাবে। সেই সময় ইউরোপ, আমেরিকায় লড়াকু গেরিলা নেতা হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেননি তিনি। ওই বছর সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় এক অগ্নিঝরা বক্তব্য দিয়ে বিশ্বনেতাদের নজরে আসেন মুগাবে। তিনি বলেছিলেন, ‘ভোট ও বন্দুক একসঙ্গে চলবে। সর্বোপরি আমরা যে ভোটই পাব, তা হবে বন্দুকের অবদান। যে বন্দুক ভোট উৎপাদন করছে, তা থাকবে এর জিম্মাদার নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের কাছেই। জনগণের ভোট এবং জনগণের বন্দুক সব সময়ই অবিচ্ছেদ্য জোড়।’ জিম্বাবুয়ের জাতীয় ভাষা ‘শোনা’ অনুযায়ী, তাত্ত্বিকভাবে মুগাবের ওই আগুনঝরা বক্তব্য তাদের বিপ্লবী সংগ্রামের মূলনীতি। কিন্তু চার দশক পর মুগাবের সেই কথা ভবিষ্যদ্বাণীর ছায়ায় যেন ফিরে এল তাকেই ঘায়েল করতে। বন্দুকের মুখেই সেনাবাহিনী গৃহবন্দি করে মুগাবেকে। ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুগাবের পতন হলো বন্দুকের শক্তিতে। যে বন্দুক এক সময় তার কাছে শক্তির উৎস ছিল, আজ তাতেই তার বিদায় হলো। জিম্বাবুয়ের স্বাধীনতা আন্দোলনে নানগাওয়ারও (৭৩) অবদান ছিল কিন্তু তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। ১৯৮০ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুগাবের আস্থাভাজন মহলে সব সময়ই তিনি সমাদৃত হয়েছেন। ১৯৮০-১৯৮৭ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ও ১৯৮৭-বর্তমান মুগাবে জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সম্প্রতি মুগাবের স্ত্রী গ্রেস মুগাবেকে তার উত্তরসূরি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা নিয়ে ক্ষমতাসীন জানু-পিএফ পার্টির মধ্যে চাপা ক্ষোভ ও বিভক্তি দেখা দেয়। গত সপ্তাহে নানগাগওয়াকে বহিষ্কার করেন মুগাবে এবং এ পদে গ্রেস মুগাবের অধিষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। মুগাবের এই পরিবারতান্ত্রিক মানসিকতা ও ক্ষমতার লিপ্সার বিরুদ্ধে চলে যায় সেনাবাহিনী এবং বন্দুকের জোরেই নীরব অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মুগাবেকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়েছে তারা।

১৯৬০-এর দশকে মুগাবের সঙ্গে জেল খেটেছেন নানগাগওয়া। ১৯৭০-এর দশকে তিনি মুগাবের ব্যক্তিগত সহকারী হন। তবে বার্ধক্যের ভারে ন্যুয়ে পড়া মুগাবে তার শেষ জীবনে স্ত্রী গ্রেসের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন এবং তার কথামতোই চলছিলেন। এ নিয়ে জানু-পিএফ পার্টিতে বিভেদ সৃষ্টি হয়। এই বিভেদের জেরেই বন্দুক গর্জে উঠল হারারেতে এবং পতন হলো মুগাবের। এর আগেও কয়েকবার ক্ষমতা নিয়ে সংকটে পড়েছেন মুগাবে কিন্তু টিকে গেছেন। শেষ পর্যন্ত ভাইস প্রেসিডেন্টকে নানগাগওয়াকে অপসারণ নিয়ে সেনাবাহিনী তার বিরুদ্ধে চলে যায় এবং ক্ষমতা কেড়ে নেয়। ২০০৮ সালে নির্বাচনের আগে প্রেসিডেন্ট মুগাবে বলেছিলেন, ‘যদি আপনি নির্বাচনে হারেন এবং জনগণের কাছে প্রত্যাখ্যাত হন, তাহলে রাজনীতি ছেড়ে দিন।’ কিন্তু নির্বাচন গড়ায় দ্বিতীয় দফায়। তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী মরগান টিএসভাঙ্গারাইয়ের বিজয়ের সম্ভাবনা দেখা দিলে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন মুগাবে। তখন তিনি এক বক্তব্যে বলেছিলেন, একমাত্র ঈশ্বরই তাকে ক্ষমতা থেকে সরাতে পারে। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে তিনি সহিংসতার পথ বেছে নেন। দীর্ঘদিনের প্রতিদ্বন্দ্বী মরগানের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করে নেন কিন্তু প্রেসিডেন্ট পদে থাকেন মুগাবে। ২০১৩ সালের নির্বাচনেও বিজয়ী হন মুগাবে। ১৯৭০-এর দশকে জিম্বাবুয়ের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় গেরিলা যুদ্ধে নাম করেন মুগাবে। জিম্বাবুয়েকে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন তিনি। সে দিকে প্রচেষ্টা ছিল কিন্তু সফল হননি। স্বাধীনতার ৩৭ বছর পরও পুঁজিবাদ ও ঔপনিবেশিক শক্তির সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে জিম্বাবুয়েকে। তা হলেও গেরিলা যুদ্ধ নিয়ে সমালোচনা করার সুযোগ নেই সেদেশে। এ বিষয়ে প্রশ্ন তুলতে বা অবমাননাকর কিছু বললে, তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। মুগাবে দেশের অর্থনৈতিক দুর্গতির জন্য সব সময় যুক্তরাজ্যের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা দেশগুলোর ষড়যন্ত্রকে দায়ী করেছেন। তিনি বারবার অভিযোগ করেছেন, পশ্চিমারা তাকে ক্ষমতা থেকে সরাতে চায়। তবে সমালোচকরা দাবি করেন, তিনি জানেনই না, আধুনিক অর্থনীতি কীভাবে কাজ করে। মুগাবেকে প্রায়ই বলতে শোনা যেত, একটি দেশ কখনো দেউলিয়া হয় না। কিন্তু ২০০৮ সালের জুলাই মাসে তার দেশে অকল্পনীয় মূল্যস্ফীতি ছিল- ২৩১০০০০০ শতাংশ। তখনো তিনি তার নিজস্ব তত্ত্বের ওপর অনড় থেকে মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টা করেন কিন্তু ব্যর্থ হন। জিম্বাবুয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক টনি হকিংনস একবার তার পর্যবেক্ষণে বলেছিলেন, ‘যখনই অর্থনীতি রাজনীতির পথ ধরেছে, তখন প্রতিবারই রাজনীতি জয়ী হয়েছে।’ ২০০০ সালে যখন প্রথমবার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার চাপে পড়েন, তখন মুগাবে বহুমুখী অর্থনৈতিক শক্তির অপব্যবহার করে তার বারোটা বাজিয়ে দেন। শ্বেতাঙ্গদের খামারগুলো ছিনিয়ে নেন মুগাবে, যা ছিল তাদের অর্থনীতির মূল শক্তি। কিন্তু দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে খামারগুলোর সেই অবস্থা আর নেই। ২০০০ সালে গণভোটে মুগাবে পরাজিত হন। এটি ছিল তার জীবনে প্রথম হার। সেই পরিস্থিতি সামাল দিতে তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনের গেরিলা যুদ্ধের কৌশল ব্যবহার করেন। নিজস্ব মিলিশিয়া বাহিনী মাঠে নামিয়ে নির্বাচনী সহিসংতা ও হত্যাকাণ্ড চালিয়ে জয় নিশ্চিত করেন। আট বছর পর ২০০৮ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রথম দফায় তার প্রতিদ্বন্দ্বী মরগানের কাছে হারার পরও তিনি গেরিলা যুদ্ধের কায়দায় নিজস্ব মিলিশিয়াদের মাঠে নামিয়ে দেন এবং দ্বিতীয় দফা নির্বাচনে জয়ী হন। অর্থাৎ তার একমাত্র লক্ষ্য, যেকোনো মূল্যে ক্ষমতা ধরে রাখা। জিম্বাবুয়ের সব সরকারি প্রতিষ্ঠান মুগাবের জানু-পিএফ পার্টির দখলে। গণমাধ্যম থেকে সংস্কৃতি- সবাই তাদের নির্দেশিত। তবে ৩৭ বছরে যা-ই হোক না কেন, জিম্বাবুয়েতে শিক্ষার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন মুগাবে। আফ্রিকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার হার তাদের- মোট জনসংখ্যার ৮৯ শতাংশ শিক্ষিত। জিম্বাবুয়ের প্রয়াত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মাসিপুলা সিথোলে বলেছিলেন, ‘শিক্ষার সম্প্রসারণ করে প্রেসিডেন্ট তার নিজের কবর খুঁড়ছেন।’ সত্যিই এই শিক্ষিত তরুণ সম্প্রদায় বেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতিসহ তাদের দেশের দুর্দশার জন্য মুগাবে সরকারের দুর্নীতিকে দায়ী করে থাকে। মুগাবে প্রায়ই বলেন, তিনি গরিবের জন্য লড়াই করছেন। কিন্তু তারই অনুসারীদের হাতে দরিদ্র কৃষক ভিটেমাটি, কৃষিজমি হারিয়েছে- এমন নজির ভূরি ভূরি। এসব দেখে নোবেলজয়ী আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটু একবার বলেছিলেন, জিম্বাবুয়ের দীর্ঘসময়ের প্রেসিডেন্ট প্রাচীনকালের আফ্রিকান একনায়কদের মতো ‘কার্টুন ফিগার’ হয়ে উঠেছেন। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে মানুষের নাভিঃশ্বাস উঠলেও মুগাবে তার জন্মদিন পালন করেছেন ঘটা করে। তিনি ৯৩তম জন্মদিনও পালন করেছেন সাড়ম্বরে। রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ নভেম্বর ২০১৭/রাসেল পারভেজ/তারা