মতামত

আবার জ্বলে উঠুক অপমানিত বর্ণমালা || অজয় দাশগুপ্ত

গর্বের মাস ভাষার মাস। আমাদের বইমেলা এখন স্বীকৃত। আমাদের ভাষার জন্য জীবনদান ও তার ইতিহাস মেনে নিয়েছে জাতিসংঘ। সব ঠিক আছে। বিশ্বের দেশে দেশে ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশীরা তাদের সন্তানদের বাংলা ভাষা শেখানোর জন্য কি যে করেন, না-দেখলে বোঝানো কঠিন। তাদের এই আগ্রহ আর ভাষার প্রতি ভালোবাসার দিকটা দেশে কি আছে আদৌ? দেশে গিয়ে দেখি, এখন আর বাড়ির বাইরে মানে গৃহকোণের বাইরে মাসী, খালা-চাচী বা পিসি, কাকা-জেঠা বলে কেউ নাই। সবাই আঙ্কেল বা আন্টি। এই সম্বোধন শুরু হয়ে এখন মহামারী আকার ধারণ করেছে। কারণ এর সাথে ইজ্জত জড়িত। জাতে ওঠার নতুন কায়দা হচ্ছে ভুল ইংরেজি বলা। ভুল এই কারণে ব্যাকরণের ধারে পাশে না-থেকে আকছার ভাষা ব্যবহার মানে সেই ভাষাকেও অসম্মান করা। বলছিলাম গর্বের কথা। ইতিহাস যত উজ্জ্বল হোক সে অতীত। অতীত শক্তি হতে পারে, বর্তমানের  সাথে চলতে গেলে তাকে সেভাবে রেখে তারপর নিজেদের মতো করে পা বাড়াতে হয়। আপনি চাইলেও আর বায়ান্নতে ফিরে যেতে পারবেন না। বরং আমরা যদি ফিরে তাকাই বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সেই শহীদদের কি আসলেই দেশ মনে রেখেছে? একটা কথা মানতেই হবে প্রাবল্য বা আধিক্য অনেক গুণ বা অর্জনকে আঘাত করে। হয়তো অগোচরে তারপরও সে তা করে। দেশে শহীদের সংখ্যা আর শহীদ হবার ঘটনা থামেনি। নানা কারণে মানুষ জান দেয়, দিচ্ছে। একাত্তরকে বাদ রাখলে বাকীগুলো হবার কথা ছিলো না। তাই শহীদের প্রতি আগ্রহও কমে এসেছে। সালাম বরকত জব্বার রা ইতিহাসে যতটা উজ্জ্বল ব্যক্তিজীবন বা সমাজে ততটা আলোকিত কি না এ প্রশ্ন রাখা যেতেই পারে। ভাষা আন্দোলনের মতো সাহসী সংগ্রামময় ইতিহাসও অবিকৃত রাখিনি আমরা। আওয়ামী লীগ আমলে যাদের নাম শুনি বিএনপি আমলে তারা হয়ে যান অদৃশ্য। আবার অন্য কেউ গদীতে এলে আসতে থাকে নতুন নাম। এই প্রবণতা ইতিহাসকে ছেড়ে কথা না-বলায় দেশের মানুষ আসলেই সংশয় আর বিপাকে থাকেন। এমনও আছে একদা ভাষা আন্দোলনে জড়িত মানুষেরা জীবনের শেষ পর্যায়ে বা মাঝপথে এই ভাষাকে নিজেদের প্রাণের বলে মানেননি। তখন সামনে এসে দাঁড়িয়েছে ধর্ম, সম্প্রদায়। আমাদের উপমহাদেশের বাঙালিরা ধর্মের দিক থেকে একটা বড় ধরণের সংশয়ে থাকেন ধর্মের উৎপত্তিগত জায়গার চাপে। ইসলাম হিন্দু বা বৌদ্ধ কোনোটার আদিভাষা বাংলা না। ফলে মন্ত্র পাঠ থেকে সুরা কিংবা পালিতে আওড়ানো শ্লোকের বেশীরভাগই চলে যায় মাথার ওপর দিয়ে। এটা যেমন, তেমনি আছে মান্য করার নামে ভয় আর ভীতিকর পরিবেশ। ফলে একটা সময় সংস্কৃত বা আরবি হয়ে যায় মাথায় রাখার বিষয়। তার ভাষাগত সৌন্দর্য বা দুর্বলতা কোনটাই আর কাজ করে না।  এই কারণে চাইলেও আপনি হককথা বলতে পারবেন না। একদল ছুটবে কৃপাণ হাতে, আরেক দলের হাতে তলোয়ার। সন্দেহ নাই, বাঙালি ভাষাগত ঐক্যেও আবদ্ধ জাতি নয়। কিছুদিন আগে এক নিবিষ্ট পাঠক আমাকে গালমন্দ করলেন এই বলে, আমি একটি লেখায় কেন ইংরেজদের প্রশংসা করেছিলাম। আরে আমি তো তাদের শাসন আমলের কয়েকটা দিকের কথা বলেছি মাত্র। আমি বরং প্রশ্ন করি, বাংলা পঞ্জিকা আর তারিখ মানলে আমরা আর ও-পার বাংলার মানুষরা কি আসলেই কোনো একটি দিবস বা উৎসব একসাথে পালন করতে পারি? পারি না । আমাদের বাংলা নববর্ষ ভিন্ন দিনে, কদমফুল ফোটার শ্রাবণের প্রথম দিন মেলে না, পূজার দিন ঈদের দিন মিলবে না। এমনকি ভাষার সংগ্রামে একাত্ম হবার দিনটি যদি আট ফাল্গুন মানতাম তাহলেও দুই বাংলায় দুদিনে পালন করতে হতো তা। ভাগ্যিস আমরা সেটি একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করি। এবং ইংরেজদের নববর্ষ, মে দিবস বা যা যা মানি এমনকি আমাদের স্বাধীনতা, বিজয় দিবস এগুলো ইংরেজি তারিখে বলেই একসাথে সারা দুনিয়ায় পালন করা যায়। তারপরও সব দোষ বিদেশীদের আর আমরা ধোয়া তুলসীপাতা। বাংলা নিয়ে আমাদের গর্বের পাশাপাশি তাই দায়িত্ববোধের কথাও এখন আলাপ হওয়া জরুরি। এই যে  বইমেলা, একে ঘিরে নবীন লেখকদের আনন্দ আর প্রকাশের যে স্পৃহা তাতে মন ভরে যায়। সাথে এটাও বলি, এরা কেন প্রস্তুত হয়ে আসবে না? কেন মনে করবে, একটা কবিতার বই বা গল্পের বই বের করা কোনো বিষয়ই না। এই বোধ তো আমাদের শিল্প সংস্কৃতি আর জাতিকে শেষ করে দেবে একসময়। না আছে মনসংযোগ, না কোনো বিজ্ঞান মনস্কতা। অথচ আজ জীবনবোধে এর ব্যবহার জরুরি। মানুষের মনে মনে যে অন্ধত্ব কবিতা তাতে প্রলেপ দিতে পারলেও তাড়াতে পারবে না। তাড়াতে হলে চাই বিজ্ঞান । সেদিকে মনোযোগী হতে হবে আমাদের। দেশের মানুষের মনে পোশাকে খাবারে ব্যবহারে আচরণে বিদেশী প্রভাব। মরুর দেশের ঝড়ো হাওয়া প্রতিবেশী দেশের ভিন্ন ভাষার নাটক সিরিয়াল আর ইংরেজির দৌরাত্ম্যে বাংলার প্রাণ ওষ্ঠাগত। কীভাবে তা থেকে বেরুতে হবে তার পথ খোঁজা জরুরি। বাংলাদেশের মানুষের মুখের ভাষাই এখনো ঠিক হয়নি। আমাদের সাহিত্য শিল্পে প্রমিত বাংলার প্রতি যে অবমাননা তার জন্য দায়ী টিভি নাটকের নামে যা তা ধরিয়ে দেবার একদল মানুষ। এরা আবার জনপ্রিয় বটে। খানিকটা কলকাতার ওপর রাগ, খানিকটা পড়াশোনার অভাব আর বাকীটা তাদের ইচ্ছেকৃত। কিন্তু এর দায় চুকাচ্ছে পুরো জাতি। আমার সবসময় মনে হয়েছে, এদেশের বাংলা ভাষার  সম্মান অজান্তে জমা হচ্ছে বিদেশে বড় হওয়া বাংলাদেশী প্রজন্মের কাছে। একদিন এরাই হয়তো তার মান বাঁচাবে। খেয়াল করবেন, দেশের অলিগলিতে বাহারী সব বিদেশী নামে বিদেশ থকে সাদা কালো মানুষদের ধরে এনে কত কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হয়েছে। দেদারসে চলছে সে বাণিজ্য। আর বিদেশে মানুষ উদয়াস্ত পরিশ্রমের পর ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে সন্তানদের নিয়ে যায় বাংলা স্কুলে। অদৃশ্য ভালোবাসার এই শক্তি বাংলাকে পুষ্ট করবেই। তারপরও আমাদের মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশজাতি আর মাটিই হচ্ছে আসল শক্তি। সেখানে হীনবল হলে আমাদের দুর্দশার অন্ত থাকবে না। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন না-হলে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা সম্ভব হতো না। সে সম্ভাবনার সময় আমরা বলতাম একটি বাংলা শব্দ একজন বাঙালির প্রাণ। আজ সে জায়গায় ইচ্ছেমত বিদেশী শব্দ। ধর্ম ও আধুনিকতার নামে যেসব শব্দ আমাদের সম্বোধন ও বিদায়ের মত প্রাত্যহিকতা বদলে দিচ্ছে তাতে আমরা কি আসলেই আশাবাদী হতে পারি?  অথচ কি অনন্ত সম্ভাবনাময় আমাদের ভাষার ভাণ্ডার। একজন রবীন্দ্রনাথ কিংবা নজরুল যে ভাষায় আছেন তাকে এই দীনতা মানায় না। আমাদের ভাষাবিদেরা পরিশ্রমে কষ্টে যে ভাণ্ডার দিয়ে গেছেন হেলায় তাকে বিনষ্ট করার মানে নেই। মানে নেই আধুনিকতা বা সংস্কারের নামে তাকে বিসর্জন দেয়ার। গান কবিতা সাহিত্য নাটক এমনকি জীবনেও আজ বাংলা অবহেলিত। একসময় আমাদের কবি লিখেছিলেন, অপমানে তুমি জ্বলে উঠেছিলে দুঃখিনী বর্ণমালা। আজ আবার প্রশ্ন রাখার সময়, ফের কি তুমি জ্বলে উঠবে না বাংলা বর্ণমালা? ধারণা করি সে তার শক্তিতেই সমস্যা অতিক্রম করতে পারবে। শুধু মনস্ক মেধাবী আর পণ্ডিতজনদের পাশাপাশি সবার মনোযোগ আর সমাজের সমর্থন চাই। রাজনীতি যদি ধর্ম সাম্প্রদায়িকতা জাতভেদ বা সংকীর্ণতার বাইরে আসতে পারে তাহলে সমস্যার সহজ সমাধানের পথ খুঁজ পাওয়া যাবে। না-হলে ভাষাভিত্তিক বাংলাদেশের সামনে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বিকল্প দেখি না। জয়তু মাতৃভাষা। লেখক: সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক

   

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/তারা