মতামত

ঈদের ঢাকা: চেনা নগরীর অচেনা রূপ

কমলেশ রায়: এক মাস সিয়াম সাধনার পর এলো খুশির ঈদ। ঈদ মোবারক। সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা। ঈদ মানে খুশি। ঈদ মানে আনন্দ। ঈদের আনন্দের মহিমা আলাদা। জাদুময় এক পরশে বদলে যায় অনেককিছু। যেমন আমাদের চিরচেনা রাজধানী ঢাকা। ঈদের ছুটিতে একদম বদলে যায়। ভিন্ন এক চেহারায় হাজির হয়। চেনা নগরীকে কেমন যেন অচেনা লাগে। নতুন প্রেমিকার মতো রহস্যময় মনে হয়। গলি ফাঁকা। রাজপথ ফাঁকা। ফুটপাত খালি। মোড় ফাঁকা। সিগন্যাল ফাঁকা। রিকশার জট নেই। গাড়ি-বাসের দীর্ঘ সারি নেই। যান একেবারেই কমে গেছে। যানজট উবে গেছে। হর্ন কানে বাজছে কম। টুংটাং শব্দ খুব একটা বিরক্ত করছে না। শব্দদূষণ কমে গেছে। কোলাহল অনেকটাই থেমে গেছে। হঠাৎ করেই থমকে গেছে ব্যস্ত নগরীর গতি। নেমে এসেছে শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ। কড়া হরতালেও সহজে এমনটা চোখে পড়ে না। এই ধীর-স্থিত ভাব রাজধানীর চেহারায় একটা আপাত গাম্ভীর্য এনেছে। আর তাতে করে অন্যসময়ের চেয়ে প্রিয় এই মহানগরী খানিকটা সমীহ আদায় করে নিচ্ছে বৈকি। ঈদে রাজধানীর আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ও সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য হলো জাতীয় ঈদগাহ  ময়দান। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, মন্ত্রী, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন, সংসদ সদস্য, বিশিষ্ট ব্যক্তি ও রাজনৈতিক নেতাসহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষ এখানে ঈদের নামাজ আদায় করেছেন। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকারমসহ নগরীর মসজিদে মসজিদে অনুষ্ঠিত হয়েছে একাধিক ঈদের জামাত। নতুন পোশাক পরে, টুপি মাথায় দিয়ে বাবা বা অভিভাবকের হাত ধরে ছোটরা ঈদের নামাজ আদায় করতে যাচ্ছে- এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর কী হতে পারে। নামাজ আদায় শেষে ঈদের কোলাকুলি আনন্দময় আরেক অভিজ্ঞতা। পারস্পারিক সৌহার্দ্য ও মানবিক বন্ধনের প্রকাশ। গণভবনে বিচারক, কূটনীতিক, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীসহ সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঈদ উপলক্ষে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে করা হয়েছে বর্ণিল আলোকসজ্জা। সন্ধ্যার পর রঙ-বেরঙের আলোতে স্থাপনাগুলো ঝলমল করছে। পথচারীদের চোখ আটকে যাচ্ছে। নগরীর রূপে যা যোগ করেছে বাড়তি মাত্রা। গোটা নগরীতে ভিড় নেই, ফাঁকা। তবে কোথাও কোথাও উপচে পড়া ভিড়। বিনোদন কেন্দ্র ও দর্শনীয় স্থানগুলোতে যেন তিল ধারণের ঠাঁই নেই। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এসব জায়গায় ঘুরতে যান অনেকেই; ঈদের ছুটি আরেকটু  জমিয়ে উদযাপন করতে। মিরপুর চিড়িয়াখানায় ভিড় হয় সবচেয়ে বেশি। বিচিত্র প্রাণীকূল দেখতে এখানে ভিড় জমায় ছোট-বড় সব বয়সী মানুষ ।  শিশুপার্কও পরিণত হয় শিশুদের মিলনমেলায়। নাগরদোলা, রেলগাড়িসহ বিভিন্ন রাইডে চড়ে ভীষণ আনন্দ পায় ছোটরা। আগারগাঁওের বিমান জাদুঘরেও ভিড় হয় খুব। খোলামেলা বিশাল জায়গাজুড়ে বিভিন্ন মডেলের বিমান দর্শনের ব্যবস্থা ছাড়াও এখানে মনোরঞ্জনের চেষ্টার কোনো ঘাটতি রাখা হয়নি। হাতিরঝিলেও দর্শনাথীদের বেশ ভিড় দেখা যায়। লালবাগের কেল্লা, আহসান মঞ্জিলের ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোও এই ঈদের ছুটিতে মুখরিত হয়ে ওঠে দর্শনাথীদের পদচারণায়। ঈদের ছুটিতে জাতীয় জাদুঘর দেখতে যান অনেকে। আবার বৃক্ষপ্রেমী অনেকেই বেড়াতে যান মিরপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনে। প্রকৃতির সান্নিধ্যে কাটিয়ে আসেন কিছুক্ষণ। কেউ কেউ আবার ওয়ারীতে ছুটে যান বলধা গার্ডেন দেখতে। এই উদ্যানে অনেক দুর্লভ গাছপালা রয়েছে। রমনা, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ ঢাকার পার্কগুলোতেও ভিড় জমে চোখে পড়ার মতো। ঢাকায় প্রতি বছর ঈদ আনন্দ-শোভাযাত্রা বের করে ‘আমরা ঢাকাবাসী’ নামে একটি সংগঠন। এছাড়াও বিচ্ছিন্নভাবে অনেক সংগঠনই নানা ধরণের আনন্দ আয়োজন করে। ঈদ শুভেচ্ছা জানিয়ে বরাবরের মতো এবারও পোস্টার করেছেন অনেকে। পাড়া, মহল্লার দেয়ালে শোভা পাচ্ছে সেই সব পোস্টার। নির্বাচনী বছর হওয়ায় পোস্টারে রাজনৈতিক আমেজ এবার আরও জোরদার হয়েছে। ঈদে মুক্তি পেয়েছে পাঁচটি ছবি। রাজধানী সিনেমা হলগুলোতে চলছে ঈদের ছবি। ঢাকাই সিনেমাপ্রেমীরা সময় করে অবশ্যই যাবেন সিনেমা হলে। ঈদে হলগুলোতে দর্শক খড়া কিছু হলেও কাটে। ভিড় অনেকটাই বাড়ে। হলের সামনে ভিড় জমে। সুযোগ বুঝে টিকিট কালোবাজারির ঘটনাও ঘটে। তবে এখন আর খুব বেশি ছবির কপালে এমন ‘সৌভাগ্য’ হয় না। ফাঁকা ঢাকায় রিকশায় ঘুরে বেড়ানোর মজাই আলাদা। গ্রীন রোডের বাসিন্দা রাসেল বললেন, ‘ঈদের ছুটিতে অন্তত একদিন আমি শেষ বিকালে ঘণ্টাচুক্তি রিকশা করে ঘুরে বেড়াই। ফাঁকা রাস্তায় রিকশায় চড়ার মজা অন্যরকম। রিকশা ছুটে চলে। সন্ধ্যার বাতাস চোখেমুখে ঝাপটা দেয়। আহা, নিজেকে বেশ ফুরফুরে মনে হয়।’  তবে রিকশাওয়ালা, সিএনজি অটোরিকশাওয়ালারা এই উৎসবে বাড়তি অর্থ কামিয়ে নেন বেশ কায়দা করে।  ‘এতো ভাড়া কেন ? অন্যদিন তো অতো টাকা দিয়ে যাই। তাছাড়া রাস্তাও তো ফাঁকা, যানজট নেই।’এমনি আরও অনেক কথা বলেও দেখবেন প্রতিক্রিয়া কী হয়। প্রতিক্রিয়া যাই হোক ফলাফল প্রায় শূন্য। দাঁত বের করা হাসি দিয়ে চালক বলবেন, ‘মামা বাড়তিটুকু ঈদের বকশিস। এমন দিনে পরিবার রাইখা গাড়ি নিয়া বাইর হইছি। আপনারা না দিলে আমরা পামু কই।’ ভাগ্নের আবদার বলে কথা। এই নগরীতে থাকেন। সুতরাং একটা জোরালো দাবি তো তৈরি হয়ই, কী বলেন আপনারা? বিজ্ঞ ও ভারিক্কি গোছের এক ভদ্রলোক এক আড্ডায় একদিন বলেছিলেন, ‘জানেন, ঈদের ছুটিতে ঢাকার বাতাস কিছুটা হলেও প্রাণ ফিরে পায়। দূষণের মাত্রা অনেক কমে যায়। দেখবেন, অন্যসময়ের চেয়ে এ কদিন নিঃশ্বাস নিতে একটু সহজ হয়। কটা দিনের জন্য হলেও তো বায়ুদূষণ, শব্দদূষণসহ হরেক রকম দূষণের হাত থেকে খানিকটা রেহাই মেলে। নগরীর পরিবেশ কিছুটা  সতেজ হয়। বাসযোগ্যতা কিঞ্চিৎ হলেও বাড়ে। এটাই বা কম কী।’নানা সমস্যা আর দূষণে জর্জরিত ঢাকাকে নিয়ে এমন যৎকিঞ্চিৎ আশার কথা শুনতে তো ভালোই লাগে। বাস্তবতার নিরিখেই রাজধানীতে গড়ে উঠেছে অগণিত একক পরিবার। ইট-কাঠ-পাথরের ছোট্ট ছোট্ট খাঁচায় আমাদের বসবাস। ঈদে আন্তঃপরিবার সম্পর্ক ও আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগের বুনন শক্ত হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানসিক দূরত্ব ঘুঁচিয়ে আবার সম্পর্ক ঝালাইয়ের মতো ঘটনাও ঘটে। ঈদে উপহার দেওয়া-নেওয়ার  পাশাপাশি দাওয়াত আদান-প্রদানও চলে। সামাজিক বন্ধন দৃঢ় হয়। ঈদে ঢাকা মহানগরীর নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। জঙ্গি হামলার কোনো আশঙ্কা নেই বলে জানিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। তার এই কথায় রাজধানীবাসী আশ্বস্ত হয়েছে। মনে স্বস্তি বোধ করছে। এবার চুরি, ছিনতাই না হলেই হয়। তাহলেই নগরবাসী অকুণ্ঠ চিত্তে ধন্যবাদ জানাবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে। তবে একটা ব্যাপারে অবশ্যই সাবধান। আর সেটা হলো পথ চলাচল বা পারাপারের ক্ষেত্রে। ফাঁকা সড়ক পেয়ে বেপরোয়া গাড়ি চালান অনেকে। বাইক চলে আরও বেপরোয়া গতিতে। কখনও কখনও একদল তরুণ অনেকগুলো বাইক নিয়ে প্রতিযোগিতায় নামে। এদের অনেকের কাছে জেতাই শেষ কথা। সামনের কার কী হলো তাতে তাদের খুব বেশি কিছু আসে-যায় না। ফলে ঘটে দুর্ঘটনা। প্রাণহানির মতোও ঘটনা ঘটে। আসুন, আমরা সবাই সাবধান হই। সাবধানে চলাচল করি। ঢাকা নগরীতে ঈদের আনন্দ আয়েশ করে পুরো মাত্রায় উপভোগ করি। ঈদের ঢাকা আমাদের কাছে আনন্দময় ঢাকা হয়েই থাকুক। সবার ঈদ আনন্দে কাটুক। আবারও ঈদের শুভেচ্ছা। লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যসেবক

       

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ জুন ২০১৮/তারা