মতামত

বিবেকের তাড়নায় তাড়িত হোক জাতি

১৯৭৫ সালের পনেরোই অগস্ট দিনটা শুভ ছিল না। সেই এক ভোর এসেছিল আমাদের জীবনে, বড় অন্ধকার সেই ভোর। বাঙালির যে প্রজন্ম ১৯৭১ জেনেছে, মুক্তিযুদ্ধ বুঝেছে, তাদের কাছে ‘পনেরোই আগস্ট’ উচ্চারণটা গলা দিয়ে বেরোনোর আগেই বেদনায় রুদ্ধ হয়ে যায়। ১৯৭৫ সালের এই দিনে বিপথগামী কতিপয় সেনা সদস্যের হাতে সপরিবারে নির্মমভাবে মারা যান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেদিন দেশে না থাকায় প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। যাঁর গৌরবময় নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে সেই মহান নেতাকে সপরিবারে হত্যা শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক ঘটনা। আমাদের জীবনে বারবার ১৫ আগস্ট আসে, বারবার মনে করিয়ে দেয় এ জাতি এমন দিনে বড় ভুল করেছিল। গত কয়েকদিন ধরেই জাতীয় শোক দিবসকে সামনে রেখে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চে দেয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণটি শুনছি শহরের নানা প্রান্তে। এই ঐতিহাসিক ভাষণ বাঙালি জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছিল স্বাধীনতা সংগ্রামে। একটি উদার অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ার জন্য যে মানুষটি লড়াই করেছেন, যার ডাকে ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছে, সেই দেশ আজ কেমন আছে? অ-সংস্কৃতিতে ভরা এক সমাজ নির্মাণ করেছি আমরা। সাম্প্রদায়িক হানাহানি আছে, হামলায় বিপর্যস্ত মানুষের প্রাণভয়ে পলায়নের বীভৎসতা আছে। তাই স্বাধীনতার কথা কেন যেন নিচু সুরে বাঁধতে হয় এখন। ঘাতকরা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার যে পথ সৃষ্টি হয়েছিল সেখান থেকে দেশকে সরিয়ে বিপরীতমুখী করার উদ্দেশ্য ছিল তাদের বড় একটি লক্ষ্য। তাদের লক্ষ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভুলিয়ে দেয়া। মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর অবদানকে খাটো করা এবং যে অসাম্প্রদায়িক চেতনার মধ্যে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল সেটা নস্যাৎ করে দেয়া। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে শুরু হয় এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র। একটা পর্যায় দেশে এসেছিল যখন বঙ্গবন্ধুর নামটাও জাতীয় প্রচার মাধ্যমে প্রচারিত হতে পারত না। ইতিহাস থেকে মুক্তিযুদ্ধের মহানায়কের নাম মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল। তরুণদের দীর্ঘকাল জানতে দেয়া হয়নি মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস। বঙ্গবন্ধুকে শুধু অস্বীকার করাই নয়, নানাভাবে তাঁর সম্পর্কে মিথ্যা বক্তব্য প্রচার করা হয়েছে। তাঁর অবদানকে নানাভাবে খাটো করা, এমনকি অস্বীকারও করা হয়েছে। কিন্তু কুচক্রীদের সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেছে। এ দেশের ইতিহাসের সঙ্গে যাঁর নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত, দেশের মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় যাঁর স্থান, কোন হুকুম বা ফরমান দিয়ে তাঁর নাম মুছে ফেলা যায় না, তাঁর অবদানকে খাটো করা যায় না। দেশকে তিনি ভালোবেসেছেন অকৃত্রিমভাবে, দেশের মানুষও তাঁকে দিয়েছে হৃদয় উজাড় করা ভালোবাসা। তাই খুনী, ঘাতকচক্র ও তাদের পৃষ্ঠপোষকের সব চক্রান্ত, চেষ্টা, তৎপরতা ব্যর্থ হয়েছে। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করে দেশকে পাকিস্তান বানানো, বাংলাদেশকে রাজনীতিবিহীন করে পাকাপোক্তভাবে সামরিক শাসনে আবদ্ধ করার আরেক ঘৃণ্য কাজ ছিল জেল হত্যাকাণ্ড। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাত্র আড়াই মাসের মাথায় ৩ নভেম্বর একই খুনিচক্র ভোর রাত ৪টায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে ঢুকে হত্যা করে বাঙালি জাতির চার সূর্যসন্তান তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামরুজ্জামানকে। এই জেল হত্যাকাণ্ড যে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যা ও পাকিস্তানি ধারা অভিমুখীন প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় সংঘটিত হয়েছিল সে কথা খুবই পরিষ্কার। কিন্তু প্রশ্ন হলো বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সদস্যরা কী করছিলেন? ১৫ আগস্ট আঘাত আসার পর, জেলখানায় শহীদ হওয়া চারজন জাতীয় নেতা বাদে বাকি অন্যসব মন্ত্রীরা সাথে সাথেই খুনি মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিলেন। আর তাই এই চারজনকে হত্যা করেছিল পাকিস্তানপন্থীরা, বাকিরা ছিলেন জামাই আদরে। আজ যখন দেখি ১৫ আগস্ট বা ৩ নভেম্বর ঢাকার রাস্তাঘাটে ট্রাফিক জ্যাম সৃষ্টি হয়, কারণ লাখ লাখ মানুষ ফুল দিতে ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারে যায় কিংবা জেলখানায় তখন প্রশ্ন জাগে ১৯৭৫-এর সেই কঠিন দিনগুলোতে এদের হাজার ভাগের একভাগ মানুষও যদি রুখে দাঁড়াতো, তাহলে কি হতে পারতো? যারা এসব হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে, এখন সময় এসেছে তাদের নিশ্চিহ্ন করার। বিবেকের তাড়নায় তাড়িত হতে হবে এ জাতিকে। বিবেক যদি এখনো কাজ না করে তাহলে এরা বাংলাদেশ নামের মানচিত্রকেই একদিন গিলে খাবে, যে মানচিত্র তারা কখনো মেনে নেয়নি। এই নৃশংস সাম্প্রদায়িক যুদ্ধাপরাধী পিশাচ শক্তির চেহারা যেন আর দেখতে না হয়, সে জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে হবে প্রত্যেক দেশপ্রেমিক নাগরিককে। দেশপ্রেমিক নাগরিকরাই পারে এই মুখোশধারীদের স্বরূপ উন্মোচন করতে। আর তারা উন্মোচিত হলে, তাদের কদর্য চেহারায় কালির ছোপ মাখিয়ে দিতে পারলেই শহীদদের আত্মা শান্তি পাবে। কিন্তু আওয়ামী লীগেরও ভাববার আছে অনেক কিছু। এই দলের বিকাশের পেছনে যে ইতিহাস তা অনেক কঠিন বাস্তবতার মধ্য দিয়ে রচিত হয়েছে। নতুন প্রজন্ম এই ইতিহাস না জানলে তাদের হাতে আওয়ামী লীগ কখনো নিরাপদ নয়। আর যেখানে আওয়ামী লীগে গত দুই দশকে এত পরগাছার জন্ম হয়েছে সেগুলোকে সমূলে উৎপাটন না করলে বিপদ আসন্ন। দেশে সংখ্যালঘুদের জমি দখল থেকে শুরু করে টাকা পাচারের মতো এত ভয়াবহ অপরাধের সঙ্গে দলের যারাই জড়িত, তাদের নিয়ে রাজনীতি করবে কিনা বঙ্গবন্ধুর দলটি সেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে আজ। লেখক: প্রধান সম্পাদক জিটিভি ও সারাবাংলা রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ আগস্ট ২০১৮/তারা