মতামত

বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদন এবং এর ব্যবহার

রীনা পারভীন : বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে পাটের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। এ ইতিহাস বিবর্ণ হবার কোন সুযোগ নেই। দীর্ঘ পথ পরিক্রমা অতিক্রম করে বাংলাদেশের পাটখাতের স্থায়ীত্বের নিশ্চয়তা আজ নিশ্চিত হয়েছে। পাটখাত একটি মজবুত ভিত্তির পর দাঁড়িয়ে গেছে। পাটসমৃদ্ধ বাংলাদেশ আজ বিশ্বের সামনে বহুমুখী পাটপণ্যের সম্ভার সাজিয়ে তার সক্ষমতা প্রমাণ করতে পেরেছে। বাংলাদেশের পাটখাতের এই অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রার নেপথ্যে রয়েছে বহুমুখী পাটপণ্যের উৎপাদন এবং এর ব্যবহার। প্রচলিত/চিরাচরিত পাটপণ্যের পাশাপশি হরেকরকম বাহারী, নিত্যব্যবহার্য, ফ্যাশনেবল বহুমুখী পাটসামগ্রীর প্রসার ও বিপণন এ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন গতির সঞ্চার করেছে। জাতীয় পাট দিবস-২০১৯ এর মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ‘বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদন ও ব্যবহারেই সমৃদ্ধি’ এ প্রতিপাদ্যকে সমানে রেখে এ লেখায় বাংলাদেশের বহুমুখী পাটপণ্যের বর্তমান চিত্র এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা সম্পর্কে আলোকপাত করার প্রয়াস নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে ২০১৭-২০১৮ অর্থ বছরে ৯১ দশমিক ৯৯ লাখ বেল কাঁচা পাট উৎপন্ন হয়েছে। কাঁচা পাট রপ্তানি হয়েছে ১৩ দশমিক ৭৯ লাখ মে.টন। পাট রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। এখাতে রপ্তানি আয় ১২৯৪ দশমিক ৬৫ কোটি টাকা। বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশনের উৎপাদিত প্রচলিত পাটপণ্যের পাশাপাশি সোনালী আঁশের তৈরি বহুমুখী পাটপণ্য নতুন মাত্রায় এদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে সকলের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। ২০০২ সালে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের আর্থিক সহায়তায় জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টার (জেডিপিসি) প্রতিষ্ঠার সূচনালগ্ন থেকে এ দেশে বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদনের যাত্রা শুরু হয়। প্রতিষ্ঠাকালে মাত্র ২১টি বহুমুখী পাটপণ্য নিয়ে স্থানীয় বাজারে আত্মপ্রকাশ করে  জেডিপিসি’র ১০ জন উদ্যোক্তা। প্রাথমিক পর্যায়ে গুটি কয়েক বাহারী পাটের ব্যাগই ছিল সম্বল। নান্দনিক সৌন্দর্য ও ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্যবোধের কারণে এসব ব্যাগ বিশেষ করে মহিলাদের ফ্যাশনেবল ব্যাগ, জুতা ও জুয়েলারি বক্স, ইত্যাদি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। কিন্তু সিনথেটিক পণ্যসামগ্রীর দাপটে এসব পণ্যের সুলভ মূল্য, সহজলভ্যতা এবং সৌন্দর্যের কারণে প্রাকৃতিক তন্তুর তৈরি পণ্যসামগ্রীর অভ্যন্তরীণ বাজার প্রসারিত হবার সুযোগ ছিল না। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রাকৃতিক তন্তুর প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধি, সিনথেটিকের পরিবর্তে প্রাকৃতিক তন্তুর পণ্যসামগ্রী ব্যবহারে উদ্বুদ্ধকরণে বিশ্বব্যাপী প্রচার বাংলাদেশের সোনালী আঁশ পাটের বহুমুখী ব্যবহারের সম্ভাবনাকে নতুনভাবে আশার আলো দেখায়। এ ভাবেই স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলার পাট প্রাকৃতিক তন্তু হিসেবে শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ রাখতে সক্ষম হয়। এর ধারাবাহিকতায় বর্তমানে জেডিপিসি’র নিবন্ধিত ৭০০ উদ্যোক্তা এখন ২৮০ ধরনের বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদন করে অভ্যন্তরীন ও আন্তর্জাতিক বাজারে বিপণনের মাধ্যমে পাটখাতে এক নতুন মাত্রা সংযোজন করেছেন। তাদের উৎপাদিত বহুমুখী পাটপণ্যের স্থানীয় বাজার যেমন ব্যাপক তেমনি আন্তর্জাতিক বাজারে এদেশের বহুমুখী পাটপণ্যের চাহিদা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বহুমুখী পাটপণ্যের অভ্যন্তরীন বাজারের বিষয়ে আলোকপাত করলে দেখা যায় গত ৬/৭ বছর আগেও অভ্যন্তরীন বাজারে পাটের তৈরি চালের বস্তা ও সুতলি ছাড়া তেমন কোন বহুমুখী পাটপণ্যের বাজার গড়ে ওঠেনি। গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় প্রায় ১০০ কোটি টাকার বহুমুখী পাটপণ্যের বাজার সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো — নান্দনিক বিভিন্ন ধরণের ব্যাগ, সেমিনার ফাইল এবং প্রমোশনাল পণ্যসমূহ, নানা ধরণের গৃহস্থলী, বাহারী সাজসজ্জায় ব্যবহৃত পণ্যসামগ্রী অন্যতম। উল্লেখ্য, গত ৫ থেকে ৬ বছরে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে অর্থনৈতিক মন্দা, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও যুদ্ধ বিগ্রহের বিরূপ প্রভাবে প্রচলিত পাটপণ্যের ব্যবহার সংকুচিত ও স্থবির হলেও ধারাবাহিকভাবে বছরে ২০% থেকে ২৫% বহুমুখী পাটপণ্যের বাজার সম্প্রসারণের মাধ্যমে গত বছর প্রায় ৭০০ কোটি টাকার বহুমুখী পাটপণ্য রপ্তানি হয়েছে। দৈনন্দিন জীবনের ব্যবহার্য পণ্যসামগ্রী যেমন বিভিন্ন প্রকার ব্যাগ (ল্যাপটপ ব্যাগ, স্কুল ব্যাগ, লেডিস পার্টস, ওয়াটার ক্যারী ব্যাগ, মোবাইল ব্যাগ, পাসপোর্ট ব্যাগ, ভ্যোনিটি ব্যাগ, শপিং ব্যাগ, গ্লোসারী ব্যাগ, সোল্ডার ব্যাগ, ট্রাভেল ব্যাগ, সুটকেস, ব্রীফকেস, হ্যান্ড ব্যাগ, মানি ব্যাগ), হোম টেক্সটাইল (বেড কভার, কুশন কভার, সোফা কাভর, কম্বল, পর্দা, টেবিল রানার, টেবিল ম্যাট, কার্পেট, ডোর ম্যাট, শতরঞ্জি), পরিধেয় বস্ত্র (ব্লেজার, ফতুয়া, কটি, শাড়ী) ছাড়াও সরকারি ও বেসরকারি সংস্থায় অফিস এক্সেসরিস হিসেবে ফাইল ফোল্ডার, পেন হোল্ডার, কার্ড হোল্ডার, টিসু বক্স, টেলিফোন ইনডেক্স, ডাইরী, প্যাড, ভিজিটিং কার্ড ইত্যাদির চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারের বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় এবং এর অধীনস্থ দপ্তর/সংস্থায় অফিস আইটেম হিসেবে পাটের তৈরি পণ্য ব্যবহৃত হচ্ছে, যা সকলের জন্য একটা অনুসরণীয় উদাহরণ হয়ে উঠেছে। সরকারের অন্যান্য দপ্তর/সংস্থাও এ উদাহরণ অনুসরণ করতে শুরু করেছে। সম্প্রতি বহুমুখী পাটপণ্যের জনপ্রিয়তা দেশের সীমানা অতিক্রম করে বিদেশেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এ প্রসঙ্গে বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোর আগ্রহ ও চাহিদার বিষয়টি উল্লেখযোগ্য। এসব দূতাবাস বাংলাদেশের জাতীয় দিবস পালনের প্রাক্কালে বিদেশী অতিথিদের বহুমুখী পাটপণ্যের উপহার সামগ্রী প্রদানে বেশ আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। পাটের তৈরি মানিব্যাগ, টাই, বিভিন্ন ধরণের ব্যাগ, ফুল, কুশন কভার, অফিস এক্সেসরিস যেন সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার! দূতাবাসসমূহের এ ধরনের উদ্যোগে সাড়া দিয়ে জেডিপিসি বহুমুখী পাটপণ্যের প্রসার, প্রচার ও ব্র্যান্ডিং এ দূতাবাসগুলোকে সহযোগিতা করে আসছে। শুধু তাই নয়! এর পাশাপাশি এ দেশের বহুমুখী পাটপণ্যের পরিচিতি ও ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য দূতাবাসগুলোতে একটি বহুমুখী পাটপণ্যের নির্দিষ্ট কর্ণার করার জন্য জেডিপিসি কাজ করে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে জার্মানী, চীন ও ডেনমার্ক এ বাংলাদেশ দূতাবাসে এ ধরণের কর্ণার স্থাপন করা হয়েছে যার মাধ্যমে বহুমুখী পাটপণ্যের সৌন্দর্য অবলোকন করাই নয় বরং আন্তর্জাতিক বাজারে এ দেশের বহুমুখী পণ্যের প্রবেশের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরে পর্যটন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি, ফিন্যান্সিয়ালি ইনস্টিটিউশন ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে পরিবেশবান্ধব পাটপণ্যের গ্রহণযোগ্যতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে নিবন্ধিত উদ্যোক্তাদের পণ্যসামগ্রী প্রদর্শন ও বিক্রয়ের জন্য জেডিপিসি’র কার্যালয়ে একটি প্রদর্শনী ও বিক্রয় কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ২০১৮ সালে ও ২০১৯ সালের (ফেব্রুয়ারি) পর্যন্ত এই কেন্দ্র থেকে সর্বোচ্চ ৯৩ লাখ ১৬ হাজার ৯৬৫ টাকার পণ্য বিক্রয় হয়েছে। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ব্যবহারের জন্য এ কেন্দ্রের পণ্যসামগ্রী ক্রয়ের চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এ কেন্দ্রের প্রচার ও প্রসারে ৩৬০ ডিগ্রি সফট্ওয়ার তৈরি করার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এই সফ্ট্ওয়ার চালু হলে কেন্দ্রটি ভার্চুয়ালি পরিদর্শনসহ প্রায় ২০০ ধরনের উৎপাদিত বহুমুখী পাটজাত পণ্য সারা বিশ্বের ক্রেতা ও প্রতিষ্ঠান ৩৬০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে দেখার সুযোগ পাবেন, যা আন্তর্জাতিক বাজার সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে বহুমুখী পাটপণ্যের চাহিদা পূরণে জেডিপিসি’র উদ্যোক্তারা কাজ করে গেলেও তাদের পেশাগত দক্ষতা ও সুপ্ত উদ্ভাবনী প্রতিভা বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, আর্থিক বরাদ্দ ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা অপরিহার্য। জেডিপিসি’র নিজস্ব ডিজাইন ইন্সটিটিউট, R & D এবং কম্পোজিট মিল না থাকায় উদ্যোক্তাদের বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদনের কাঁচামাল (ফেব্রিক্স, ডাইং ও লেমিনেশন) প্রাপ্তিতে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। উল্লেখ্য, বিশ্বে green product, green solution, green growth ইত্যাদি বিষয়ে অভাবনীয় সচেতনতা সৃষ্টির কারণে পলিথিন ব্যাগ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে ৫৫টি দেশে, ৩১টি দেশে পলিথিন ব্যাগে কর আরোপ করা হয়েছে, ২৬টি দেশের কিছু রাজ্যে আংশিক নিষিদ্ধ, ভল্টারি চার্জ প্রযোজ্য করা হয়েছে ৬টি দেশে এবং ২০২১ এর মাঝামাঝি নিষিদ্ধ কার্যকর হবে ২০টি দেশে। ৫৫ দেশে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করায় এ ব্যাগের ব্যবহার ব্যাপক হারে কমে গেছে। গবেষণায় আরো দেখা যায় যে, ২০০৮-২০১২ পর্যন্ত ইউরোপের ১৮টি দেশের মধ্যে ছয়টি দেশে পাটের ব্যাগের চাহিদা বেড়েই চলেছে। এর মধ্যে ইতালি, তানজানিয়া, ডেনমার্ক, বুলগেরিয়া, আয়ারল্যাণ্ড ও ফ্রান্স অন্যতম। এ ছাড়াও যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে পাটের ব্যাগের চাহিদা আকাশচুম্বী। দক্ষিণ আফ্রিকার দেশগুলিতে চাহিদা ক্রমাগত বাড়ছে। এশিয়ার ১২টি দেশে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর মধ্যে ফিলিপাইন ও আরব আমিরাতে বিপুল পরিমান পাটের ব্যাগের চাহিদা রয়েছে। তাই সারাবিশ্বে বহুমুখী পাটপণ্যের অপার সম্ভাবনাকে যথাযথভাবে কাজে লাগানোর জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করার বিকল্প নেই। দেশের বহুমুখী পাটপণ্যের প্রচার, প্রসার ও বিপণনের মাধ্যমে সারাবিশ্বে এর ব্যবহার বৃদ্ধির জন্য জেডিপিসি নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে । তাই দ্বিধাহীনভাবে বলা যেতে পারে যে, বহুমুখী পাটপণ্যের উৎপাদন ও ব্যবহারের মধ্যেই লুকায়িত আছে বাংলাদেশের সমৃদ্ধি, উন্নয়ন এবং উন্নত দেশের কাতারে বাংলাদেশের অর্ন্তুভুক্তির উজ্জ্বল সম্ভাবনা! বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ ও উন্নত দেশের তালিকায় উন্নীত করা এবং এসডিজি’র লক্ষ্য বাস্তবায়নের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি তথা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হলে বহুমুখী পাটপণ্যের বাজার সম্প্রসারণ এবং উন্নয়ন একান্ত অপরিহার্য। লেখক : নির্বাহী পরিচালক, জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টার (জেডিপিসি) রাইজিংবিডি/ঢাকা/৬ মার্চ ২০১৯/আসাদ/এনএ