মতামত

সাহিত্য, সংগঠন ও প্রগতি লেখক সংঘ

|| সাখাওয়াত টিপু || তৃতীয় জাতীয় সম্মেলন সভার প্রাক্কালে আমার সাদর সম্ভাষণ জানবেন। আজ আমরা সাহিত্যের টানে একত্রিত হয়েছি। বড়ই নিষ্করুণ সময়ে আজ যে প্রাণের উদ্বেল হাওয়া বইছে, তা সম্ভব হয়েছে আপনাদের প্রেরণাগত সমাগমে। আজ আনন্দের দিন। আজ আহবানের দিন। কোন আহবান? কার আহবান? সৃষ্টিযজ্ঞের ভেতর দিয়ে আপনাদের সরব উপস্থিতিতে আজ বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘ সরু গলি থেকে রাজপথে পা ফেলছে। সাহিত্য সমাবেশের এই পথ সরল নয়, ছিল না কখনো। বিভিন্ন চড়াই-উৎরাই পেরুনো। সাংগঠনিকভাবে আমাদের পথ চলাও কখনো মসৃণ ছিল না। নানা সংকট, নানা প্রতিবন্ধকতা মাড়িয়ে আমরা কিছুটা পথ এগিয়েছি। কিভাবে সেটা? সাহিত্য সৃষ্টির অন্তর্লোকে একজন লেখক প্রথমত নিজেকে সংগঠিত করে। এই গঠন সমাজের অপরাপর ভাব-বস্তুর ভেতর দিয়ে নিজেকে সংগঠিত করা। দ্বিতীয়ত কাজ হলো, সাহিত্য সংগঠনের ভীত দিয়ে চেতনাগত জায়গায় সমাজ-মানুষ-প্রকৃতিকে সম্পৃক্ত করা। মনে রাখা দরকার, প্রকৃতি নিজেই সংগঠন। তাহলে আবার সংগঠনের দরকার কেন? নতুন করে বলবার প্রয়োজন নেই আর, পরিবার থেকে রাষ্ট্র সবই সংগঠন। ফলে মানুষ কোনো না কোনোভাবে সংগঠিত। প্রশ্ন হচ্ছে, সাহিত্য কি সংগঠিত হতে পারে? লেখক একাই লেখেন। কিন্তু পাঠক যখন পড়েন তখন চেতনাগত সংগঠনের ভেতর প্রবেশ করেন। কেননা ভাষা চিন্তা সৌন্দর্য শ্রেণীগত রুচি মিলেই এমন চেতনাগত সংগঠন সৃষ্টি করে। চেতনা কোনো স্থির ধারণা নয়, চলমান। সৃষ্টির ভেতর দিয়ে চলমান চেতনাগত জায়গায় মানুষ স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে চায়। এবং ঘটায়। সাহিত্য এই ক্ষেত্রে সমাজের অন্তর্গত আর উপরি-কাঠামোয় কাজ করে। মানুষকে জাগায়। জাগাতে অনুপ্রাণিত করে। স্বপ্নের বাস্তবায়নে পথ দেখায়। আর সাংগঠনিক তৎপরতা মুক্তির সেই স্বপ্নকে ত্বরান্বিত করে। প্রশ্ন হচ্ছে, এমন সৃষ্টিযজ্ঞে প্রগতি লেখক সংঘের ভূমিকা কী? গত শতাব্দির তিরিশের দশকে সাম্রাজ্যবাদ আর ফ্যাসিবাদের বিরোধিতা দিয়ে প্রগতি লেখক সংঘের উন্মেষ। শুরু থেকেই পৃথিবীর দেশে দেশে লেখক, শিল্পী আর মুক্তিকামী চিন্তাশীল গণতান্ত্রিক মানুষ সমবেত হয়েছিল সংগঠনটির ছায়াতলে। ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরালে দেখা যাবে, গেল শতাব্দির দশকে দশকে থেকে পৃথিবীর দেশে দেশে সাম্রা্জ্যবাদের বিপরীতে স্বাধীনতাকামী মানুষের জাগরণ আর ফ্যাসিবাদী শাসন-কাঠামোর বিপরীতে গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উত্থান। অনস্বীকার্য আজ, মুক্তিকামী মানুষের জাগরণের পেছনে চেতনাগত সংগঠনের কাজটি সুচারু করেছিল প্রগতি লেখক সংঘ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মানবিকতার স্লোগান আর উপমহাদেশে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের পেছনে স্বাধীনতাকামী মানুষের চেতনাগত পাটাতন নির্মাণেও সংগঠনটির ভূমিকা অগ্রগণ্য। আজ তৃতীয় সম্মেলনের প্রাক্কালে আমাদের কাছে দুটো দিক গুরুত্বপূর্ণ। একটি হলো, দীর্ঘদিনের অবশায়িত প্রগতি সংঘের পুনর্জাগরণ ঘটেছে। আরেকটি হলো, মুক্তির সম্ভাবনা নিয়ে সংগঠনটি ক্রমশ ভবিষ্যতের পথে অগ্রসর হচ্ছে। এটি শুভ লক্ষণ বটে! কিন্তু পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দুটো জিনিসকে গুরুত্ব দিতে চাই। সামনে আনতে চাই সংগঠনের পরিমাণগত আর গুণগত পরিবর্তনের দিকে। পরিমাণগত পরিবর্তন হচ্ছে, সৃজনশীল মানবতাকামী গণতন্ত্রীমনা লেখকদের সংগঠিত করা। কেন্দ্র থেকে প্রান্ত নাগাদ ‘নতুন লেখক নতুন এলাকা’য় সংগঠনের পরিসর বাড়ানো। এই গেলো সংখ্যাগত দিক। আর গুণগত পরিবর্তন মানে নিজেদের সৃষ্টিশীলতার মান বৃদ্ধি। এটা তখনই সম্ভব, যদি নিয়মিত আলোচনা, সমালোচনা, সভা-সেমিনার, পাঠাগার আন্দোলন ও পত্রিকা প্রকাশ সম্ভব হয়। মনে রাখতে হবে, কোনো সংগঠনই আদর্শ বিচ্যুত হয়ে টিকে থাকতে পারেনি। ইতিহাসে এমন নজির ভুরি ভুরি আছে। উদাহরণ টানব না। তবে আদর্শ চ্যুতিতে সবচেয়ে বড় বিভেদ ঘটে নেতৃত্বের চেতনাগত জায়গায়। যার ফলে সংগঠন স্তিমিত হয়ে পড়ে। এমন অভিজ্ঞতাও আমাদের ছিটে-ফোঁটা আছে। কিন্তু নানা বৈচিত্র্যের সাহিত্য চিন্তার সম্মিলিত রূপ আদর্শকে আরো বেশি সংগঠিত করতে পারে। একটি উদাহরণ দিলে সেটা স্পষ্ট হবে। একক ফুলের বাগান থেকে কোনো বাগানে যদি নানান জাতের বৈচিত্র্য ফুলের সমাহার ঘটে, সেটা নানাভাবে সৌন্দর্যকে ঋদ্ধ করে। কারণ বাগানকে আদর্শ হিসেবে নিলে, নানা ফুলের ভেতর আমরা সৌন্দর্য চেতনার সম্মিলন হিসেবে দেখতে পাবো। চেতনার এই সম্মিলন সমাজ বদলের প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে। এই সম্মিলন অতীতে করেছে, বর্তমানে করছে, ভবিষ্যতেও করবে। তাতে সংগঠনের ব্যাপ্তি ও কাঠামোগত জায়গায় নতুন চিন্তার উদ্ভাবনী পরিসরকে আরো সুদৃঢ় করবে।  দেশের জনসমষ্টি আর লেখক-শিল্পীর পরিমাণগত জায়গায় হয়তো প্রগতি লেখক সংঘ বৃহৎ সংগঠন নয়। আমাদের সংগঠন আপামর সমাজে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে খুব যে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে, তা নয়। এটা আমাদের সাংগঠনিক দুর্বলতা। তার কারণ আমাদের দেশে সাহিত্যের শ্রেণী বিভাজন খুব স্পষ্ট নয়! দেশের সাহিত্যের কর্মকাররা প্রধানত মধ্যবিত্ত সমাজের। নিম্নবিত্ত আর উচ্চবিত্তের সাহিত্যধারা খুবই ক্ষীণ! ফলে দৃশ্যমান চেহারায় মধ্যবিত্ত সমাজের লেখক ও সাহিত্যধারা অগ্রগামী হয়ে আছে। কিন্তু ক্রমে ক্রমে মধ্যবিত্ত ধারাটি ম্রিয়মান ভবিষ্যতের দিকে যাচ্ছে। কারণ মধ্যবিত্ত সমাজের লেখককুল জানে না মুক্তির পথ কোথায়? দিশাই-বা কোথায়?  তদুপরি, একদিকে দেশি-বিদেশি লগ্নী পুঁজির বিকাশ, অন্যদিকে বৈষম্যপূর্ণ সমাজকাঠামো শ্রেণী বিভাজন বাড়িয়ে তুলছে। শাসকশ্রেণী গণতান্ত্রিক কাঠামোর বিপরীতে একতান্ত্রিক শাসন কাঠামোর দিকে ধাবিত হচ্ছে। ফলে নতুন সংকটের মুখে সাহিত্য কি দিশা দেবে সেটাই গুরুতর প্রশ্নের বিষয়। পুঁজির অবাধ বিকাশের ফলে দেশে জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণী সৃষ্টি হওয়ার কথা ছিল। দুঃখের বিষয় সেটি হয়নি। কারণ দেশের পুঁজিপতি শ্রেণী এতই দেউলিয়া যে, আপন মাতৃভাষা ছেড়ে ইংরেজির দিকে ঝুকে পড়ছে। আমরা বিদেশি সাহিত্যের বিরোধী নই, পৃথিবীর যে কোনো দেশের, যে কোনো ভাষার, স্বাধীনতাকামী মানব মুক্তির স্বপ্নাকাঙ্ক্ষী সাহিত্যের পক্ষে। তবে শঙ্কার বিষয়, দেশের উচ্চশ্রেণীর ইংরেজির দিকে অতিধাবমান অবস্থা নয়া-ঔপনিবেশের রাস্তা প্রশস্ত করছে। আর অন্যদিকে আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির লোকজধারার সাহিত্য ক্রমশ বিলুপ্ত হওয়ার পথে ধাবিত হচ্ছে। মনে রাখতে হবে, শেকড় ছিন্ন করে কোনো বৃক্ষ যেমন বেঁচে থাকতে পারে না, ঠিক তেমনি জাতীয় সংস্কৃতির সাহিত্য ছাড়া ভাষা কিংবা জাতি টিকে থাকতে পারে না। এমন সংকটময় মুহূর্তে আমাদের কাজ কী? জাতীয় সংস্কৃতির সাহিত্যের লড়াই অস্তিত্বের টিকে থাকার লড়াই। এটি বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর বেলায় যেমন সত্য, ঠিক তেমনি চাকমা, মারমা, হাজং, মুরং, সাঁওতাল, মনিপুরি, কুচিসহ অপরাপর ভাষা সাহিত্যের জাতিগোষ্ঠীর বেলায় সত্য। আজ আমরা আরো বেশি গর্ববোধ করতে পারতাম, যদি না আমাদের এই প্রগতির আন্দোলনে তাদের সামিল করতে পারতাম। বাংলাদেশ বহুভাষীর দেশ। বহু জাতির দেশ। আমরা যদি জাতীয় সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখতে চাই, তাহলে সকল ভাষার ভাবসম্পদ আর মানসসম্পদের দিকে মুখ ফেরাতে হবে। তাদের ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতির অধিকার নিয়ে সামনে পা বাড়াতে হবে। সেই লড়াই করতে পারে সাহিত্যের অগ্রগামী সংগঠন প্রগতি লেখক সংঘ। জাতীয় দায়িত্বও বর্তায় সংগঠনটির উপর। আমাদের সীমাবদ্ধ সামর্থ নিয়ে আজ এটুকুই এগিয়েছি। কখনো হয়তো ভুল ছিল, কখনো হয়তো নানা ইস্যুতে সাহিত্যকে জাগিয়ে তুলবার মতো পরিস্থিতি ছিল, কখনো হয়তো ইচ্ছার সঙ্গে বাস্তবতার মেলবন্ধন ঘটেনি। আমাদের সাংগঠনিক সকল সংকট কাটিয়ে সামনের দিকে আগাতে হবে। তাহলে আমাদের করণীয় কী? কিংবা সাহিত্যেরই-বা করণীয় কী? সাহিত্যের প্রধান কাজ সঙ্গে থাকা। মানুষের সঙ্গে থাকা। মানুষের অধিকার, মুক্তির আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্নের সঙ্গে থাকা। পুঁজিবাদের যে অস্তনিমিত চেহারা আজ দেখতে পাচ্ছি, তেমনি ভোরের লাল টুকটুক সূর্যের প্রভা জ্বলে উঠছে ভবিষ্যতের আকাশে। আর সাহিত্য হচ্ছে সেই আলোকচ্ছটা, যা সামনের পথ দেখায়। পথের ভাষা দেয়। আর প্রগতির নিশানাই সেই পথের দিশা। কারণ আমরা চেতনায় সংগঠিত। আদর্শের দৃঢ়তায় অটল। মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় অবিচল। ফলে ভবিষ্যত বিজয় ঠেকায় কে? [নোট: ১৫ মার্চ ২০১৯, প্রকাশিত লেখাটি বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘের তৃতীয় জাতীয় সম্মেলনে কাউন্সিল অধিবেশনে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্য আকারে পঠিত। বক্তব্যটি ঈষৎ সংশোধিত।] লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও তাত্ত্বিক রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ মার্চ ২০১৯/তারা