মতামত

উপাচার্য সংকট: শিক্ষা ও জাতির ভবিষ্যত কোথায়?

উপাচার্য এখনো একটি ভয়ঙ্কর নাম। এটা তাঁর নিজের জন্য যেমন, তেমনি ছাত্রছাত্রীদের জন্য। হঠাৎ করে বাংলাদেশে উপাচার্যরা দেখছি টার্গেট! যার যার বেদনা, রাগ, মান-অভিমান সবকিছুর কেন্দ্রে এখন উপাচার্য। একের পর এক চলছে এই কাণ্ড। আনোয়ার হোসেনের মতো বিদগ্ধ নামে পরিচিত উপাচার্যরাও ছাড় পাননি। এখন চলছে জাহাঙ্গীরনগর পর্ব। কি দাবি, কি দাওয়া সেটা যত মূখ্য তার চেয়ে প্রকট আন্দোলনের নামে উগ্রতা। আমি এটা মানি, দেয়ালে পিঠ না ঠেকলে ছাত্রছাত্রীরা এমন করতো না। তাদের আমরা সন্তান জ্ঞান করি। তাদের দিকটা বিবেচনায় রেখেই কথা বলতে হবে।

এই লেখা যখন লিখছি বরাবরের মতো এবারও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মুখ খুলতে হয়েছে। তিনি বেশ রাগত হয়েই বলেছেন, আনীত অভিযোগগুলো প্রমাণ করা না হলে অভিযোগকারীদের শাস্তি পেতে হবে। আইনের চোখে এবং যুক্তিতে এটা খাঁটি কথা। একসময় ইংল্যান্ডের আইনে ছিল- আপনাকে আমি চোর বললে আপনি আদালতে নিজেকে চোর কি না তার প্রমাণ দেবেন। আমেরিকা সেটা পাল্টে দিয়েছে। যে আপনাকে চোর বলবে তার দায় তা প্রমাণ করার। না পারলে তাকেই শাস্তি পেতে হবে। জরিমানা দিতে হবে। আমরা যত আধুনিক হবো বা হচ্ছি ততো যেন জংলী হয়ে উঠছি। প্রধানমন্ত্রী আসল জায়গায় হাত দিয়েছেন।

কিন্তু একটা খটকা থেকেই যাচ্ছে। বারবার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উত্তপ্ত হচ্ছে কেন? এর কারণ কি এই যে, দেশের আর কোথাও রাজনীতি নেই, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নেই বলে ঘাপটি মেরে থাকা বিরোধী নামের অপশক্তি এখানে চক্রান্তের জাল বুনছে। ঘোলা পানিতে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার মৎস্য শিকার করতে চায় তারা? না কি আমরা মেনে নেব, দেশের আর সবকিছু যখন অচলায়তনের মতো স্থবির তখনো নবীন প্রাণ নতুন রক্তে আছে বলেই কিছু ভাঙার বা বলার চেষ্টা? খুশী হতাম যদি কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন বা এসব উত্তেজনায় বুড়োদের না দেখতাম। শব্দটা বুড়ো না বলে ‘বড়’ বলতে পারলে ভালো লাগতো। কিন্তু বিনয়ের সাথে প্রশ্ন করি- একজন মানুষ যেমন আনু মোহাম্মদ তিনি কি অরাজনৈতিক? যারা সবকিছু নষ্ট রাজনীতির কবলে বলে উপাচার্যবিরোধী মতামতকে আওয়ামী বিরোধিতায় নিয়ে যেতে আগ্রহী তারা কি অরাজনৈতিক মানুষ? আনু মোহাম্মদ তো বহুকাল থেকে একটি দলের সাথে যুক্ত। আমার ব্যক্তিগত মতে তিনি সবসময় সব কিছুতে না বলার লোক। ভালো হোক, মন্দ হোক, না বলাটা কিছু মানুষের স্বভাব। গ্রাম দেশে একটা প্রবাদ আছে- যারা নেগেটিভ মানুষ তারা নাকি ভরপেট দাওয়াত খেয়েও বলে, এত খাওয়ানোর কি দরকার এখন যে ঢেঁকুর উঠছে! আনু সাহেব একজন রাজনৈতিক লোক হয়ে আর একটি দল ও মতের ব্যাপারে ন্যায্য কথা বলবেন এটা কি আমাদের দেশে সম্ভব হয়েছে কোনো কালে? ফলে ছাত্রছাত্রীদের উত্তেজনা ঠিক খাতে প্রবাহিত কি না এটা দেখার দরকার আছে।

অন্যদিকে উপাচার্য পদটি আর কোনো কালে এমন বিতর্কের মুখে পড়েনি। লাগাতার চলছে পদটির ইজ্জত হনন। ক’দিন পর মানুষ ‘উপাচার্য’ শুনলে জানালা দরজা বন্ধ করে দিতে পারে ভয়ে। সঙ্গে জুটেছে ছাত্রলীগের নাম। ছাত্রলীগের রাজনীতি এখন এমন- আগে তারা কেউ মারামারি করলে অনুপ্রবেশকারী বা নামধারী বলতো। এখন আর তাও বলে না। এই বেপরোয়া মনোভাব সরকারে থাকার জন্য হলে এটাও মনে রাখতে হবে এক মাঘে শীত যায় না। আর সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ওপর হামলার ফল এদেশে কোনো কালে ভালো কিছু বয়ে আনেনি।

সরকারকে এ বিষয়ে মনোযোগী হতেই হবে। সাধারণত ছাত্রছাত্রীরাই হয় নিয়ামক। তাদের মা-বাবা, ভাই-বোন, অভিভাবক সবাই এর সাথে জড়িত। এই যে মেয়েদের হল ছাড়তে বলা; বিনা নোটিশে বাড়ি যেতে বলা, এতে লেখাপড়ার বারোটা বাজার পাশাপাশি নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত। তাদের কিছু হলে কে নেবে দায়? দেশে গিয়ে একটা জিনিস খেয়াল করলাম- কারো কোনো দায় বোধ নাই। কেউ মরলো কি বাঁচলো এটা যেন তাদের নিজস্ব দায়িত্ব। রাষ্ট্র সমাজ বাহিনী বা জনগণ কারো কিছু বলার নাই, করার নাই। এই পরিবেশকে আপনি কি উন্নয়ন বলবেন? উন্নয়নের পাশাপাশি শান্তি ও সহিষ্ণুতা আজ খুব দরকার। আবারো বলছি, দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে এমন উত্তেজনা আর অশান্তি অকল্পনীয়। জাহাঙ্গীরনগরের ছাত্রছাত্রীদের নিশ্চয়ই কিছু ন্যায্য চাওয়া আছে। তাদের কাছ থেকে সেগুলো জেনে তারপর সমাধান করা জরুরি। তাহলে নিশ্চয়ই সুবিধাবাদীরা সুযোগ নিতে পারবে না।

আমার মনে হয়েছে, কারো দোষ ধরার আগে উপাচার্য আর ছাত্রলীগের দিকে তাকানো উচিৎ। কেন তারা পেটোয়া বাহিনীর মতো কাজ করছে? কেন তারা এতো উগ্র? এর কারণ কি ধরাকে সরা জ্ঞান করা? না কি এর ভেতরেও গড ফাদারদের ইন্ধন আছে? উপাচার্যরা আজকাল কথাবার্তায়ও অসংযত। কেউ সরাসরি বলেন, যুবলীগের জন্য এই পদ ছেড়ে দেবেন। কেউ রাজনীতির মোসাহেব। কারো কথা বালখিল্য। যে ভদ্রমহিলা জাহাঙ্গীরনগরের উপাচার্য তিনি কেন অসহিষ্ণু আচরণে বারবার এমন উত্তেজনা তৈরি করছেন? কেন ঘুরে ফিরে আসছেন সংবাদ শিরোনামে? এরা কীভাবে এদেশ বা জাতির অভিভাবক হতে পারেন? আজ তাদের নিয়ে যে কথা বা যে আলাপ সামাজিক মিডিয়ায় প্রচার-অপপ্রচার তাতে যে কোনো সভ্য দেশের মানুষ হলে সঙ্গে সঙ্গে পদত্যাগ করতেন? আমাদের দেশে, আমাদের সমাজে সে কালচার, সে সংস্কৃতি নাই।

যতদিন কেউ না কেউ এমন পরিস্থিতির সামনে এসে বুক পেতে বলবেন: অনেক হয়েছে! এবার আমাকে যেতে হবে। তোমরা যা বলছো তার দায় আমার। বা বলবেন, এ আমি মানতে পারবো না, তাই চলে যাচ্ছি। ততদিন এসব সমস্যা থেকেই যাবে। আসলে লেখাপড়ার মান ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যত কিছুই আর গুরুত্ব পায় না এখন। কেবল হইহই আর উত্তেজনায় এক ধরনের আনন্দ চাইছে সকলে। সাথে জুটেছে ইন্ধন। একদিকে দম্ভ, অহঙ্কার, দাপট। আরেকদিকে না পাওয়ার যন্ত্রণা। মাঝখানে পড়ে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা মানুষের। এমন হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি কোনোদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে আর?

লেখক: প্রাবন্ধিক

 

অস্ট্রেলিয়া/তারা