মতামত

বায়ুদূষণ: গভীর অসুখে বাংলাদেশ

ঢাকা পৃথিবীর বসবাস অনুপযোগী, দূষিত শহরগুলোর মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেছে। এই প্রথম হওয়ায় আনন্দ নেই, গৌরব নেই; আছে গ্লানি ও অপমান। এ অপমান কেউই আমাদের করেনি, বরং নিজেরাই ‘যেচে পড়ে’ অপমানিত হয়েছি, ঘাড় পেতে নিয়েছি কলঙ্কের ভার। সারা দেশই নানাভাবে হুমকির মুখে, ঢাকায় এ মাত্রা অনেকাংশেই বেশি। ঢাকার বাতাসে সীসা, যেটা ক্ষণে ক্ষণে গলগল করে ঢুকছে বাসিন্দাদের দেহে। এর উপর ফরমালিনসহ নানা ভেজাল খাদ্য প্রতিনিয়ত গলাধঃকরণ করছেন রাজধানীবাসী। এছাড়া উপায়ও নেই। ঢাকার বাইরে কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকায় দেশের মানুষ জড়ো হচ্ছেন এখানেই। বৈধ বা অবৈধ পন্থায় অনেকেই খুঁজে নিচ্ছেন জীবনধারণের পথ ও পরিসর।

রাজধানী ঢাকার রয়েছে চারশ বছরেরও বেশি সময়ের গৌরবময় ঐতিহ্য। সেই ঐতিহ্য এখন ধূলি ধূসরিত। ধূলি চাপা পড়তে পড়তে পুরু হচ্ছে গ্লানি। দুই দশক আগেও শাসকশ্রেণির মুখে শোনা যেতো ‘তিলোত্তমা ঢাকা’ গড়ার প্রতিশ্রুতি। এখন শব্দদ্বয় পারতপক্ষে কেউই উচ্চারণ করেন না। বিপ্রতীপ পরিবেশ-পরিস্থিতিতে ঢাকা পড়ে গেছে সেই সুমধুর প্রতিশ্রুতি। অবস্থা দাঁড়িয়েছে- কোনোভাবে মান বাঁচলেই হয়।

সরকারের পক্ষ থেকে অনেক সময়ই প্রকৃত পরিস্থিতি আড়ালের চেষ্টা করা হয়। বায়ু দূষণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টরা সেটা অন্তত করেননি। সরকারিভাবেও এটা সমস্যা হিসেবে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। যদিও বাধ্য হয়ে। তবুও ভালো, সমস্যা শনাক্ত করা গেলে প্রতিষেধক প্রয়োগ সম্ভব। গত সোমবার (২৫ নভেম্বর) পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ঢাকার বায়ু ও শব্দদূষণ বিষয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেছেন ‘ঢাকা সিটিতে বায়ুদূষণের মাত্রা অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। মূলত তিন কারণে ঢাকাসহ সারা দেশে বায়ুদূষণের মাত্রা বাড়ছে। সেগুলো হলো- ইটভাটা, মোটরযানের কালো ধোঁয়া এবং যথেচ্ছ নির্মাণকাজ।’

প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএন’র বরাত দিয়ে মন্ত্রী জানান, বায়ুদূষণ মোকাবেলায় প্রথম কাজ হচ্ছে দূষণের উৎস বন্ধ করা; শহরের বিভিন্ন স্থানে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলা; জলাশয়গুলো রক্ষা করা। সবার আগে বায়ুদূষণকে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সংকট হিসেবে দেখলে গড়ে তোলা যাবে নিরাপত্তা ব্যবস্থা।

ক্রমশ ঢাকা শহর যেভাবে ইট পাথরের জঞ্জালে পরিণত হচ্ছে, তাতে কাটা পড়ছে অবশিষ্ট গাছও। নতুন করে গাছ লাগানোর উদ্যোগ নেই, অবশ্য অবকাঠামোও নেই। ঢাকার পঞ্চাশটির বেশি খাল চলে গেছে দখলদারদের জিম্মায়। বিভিন্ন সময়ে খাল উদ্ধারের বিষয়ে সরকার হুঁশিয়ারি দিলেও তা থেকে গেছে কথার কথা হিসেবেই। দখলদারদের যে শক্তি-সামর্থ্য যেখানে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে এক ধরনের অসহায় আত্মসমর্পণই করতে হচ্ছে। জবরদখল থেকে নৈরাজ্য সবকিছুই হয় রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে। এর সঙ্গে জড়িত থাকে একশ্রেণির অসৎ কর্মকর্তা। সর্ষের ভেতরেই ভূত থাকায় শেষপর্যন্ত সবকিছু থেকে যায় ফাঁকা আওয়াজ হিসেবেই!

ঢাকাবাসীকে বড় স্বপ্ন দেখিয়েছিল হাতিরঝিল। সেই জলাশয়ও এখন স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। স্বচ্ছ পানি চেহারা পেয়েছে কালোরূপে। দুর্গন্ধসহ নানা সমস্যায় আক্রান্ত হাতিরঝিল। এর চারপাশের সড়কে ঘটছে ছিনতাইয়ের মতো অনাকাঙ্খিত ঘটনা। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার ও অবকাশযাপনের একচিলতে পরিসরও ক্রমশ বেহাত হয়ে যাচ্ছে। টিকে আছে শুধু সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, রমনা পার্ক, বোটানিক্যাল গার্ডেন ও বলধা গার্ডেন।

বর্তমানে সবুজ বেষ্টনী গড়ার কথা বলা হচ্ছে, সেটাও বা কীভাবে সম্ভব? গাছ লাগানোর জন্য ‘নিষ্কণ্টক জমি’ কোথায়? ঢাকা সিটি করপোরেশন সবুজায়ন প্রকল্পের অংশ হিসেবে ফুটওভার ব্রিজে ফুলের চারা লাগিয়েছিল। সেই গাছে ফুল ফোটার আগেই বিবর্ণ পাতাগুলোর দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া নগরবাসীর উপায় কী! রাস্তার পাশে যেসব ধাতব ডাস্টবিন করে দেয়া হয়েছিল, সেগুলোরও অস্তিত্ব মেলে না এখন! বাসার ছাদে গাছ লাগানো হলে হোল্ডিং ট্যাক্স মওকুফ করার ঘোষণায় মেলেনি প্রত্যাশিত সাড়া। সব মিলিয়ে ঢাকা এখন বিবর্ণ শহর, ভুগছে গভীর অসুখে। বলার অপেক্ষা রাখে, দিনে দিনে বায়ু আরো দূষিত হবে, সমস্যা দেখা দেবে প্রকট আকারে।

অস্বাস্থ্যকর জনজীবনে সঙ্গত কারণেই দেখা দিচ্ছে নানা ধরনের রোগের প্রকোপ। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে থাকে উপচেপড়া ভিড়। এসব কিছুর পেছনে অনেকাংশে দায়ী ভেজাল খাবার, দূষিত বায়ু। কয়েক কোটি মানুষের চাপে-ভারে নীরব আর্তনাদ করে চলেছে ঢাকা শহর। প্রাণহীন শহরের মর্মন্তুদ ইতিকথা হৃদয়ঙ্গমের কান যেন কারোরই নেই। ঢাকা থেকে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, অফিস আদালত, শিল্পকারখানা দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দেয়ার কথা বলা হলেও বাস্তবায়ন করা যায়নি এখনো। ট্যানারি শিল্প সাভারে স্থানান্তর করা হলে সেখানে নদীদূষণসহ অনেক রকম অভিযোগ রয়েছে।

সভ্যতার উল্লম্ফন দেখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন: ‘দাও ফিরে সে অরণ্য লহ এ নগর।’ সেটা কীভাবে সম্ভব? আমরা এখনও বন কেটে নগর বানাই! বর্তমানের লাভ-লোভে কুড়াল মারি ভবিষ্যতের পায়ে। ‘উন্নয়নের’ সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নাগরিক দুর্ভোগ। কাটা পড়ছে গাছপালা, সবুজ উধাও হয়ে যাচ্ছে। বড় বড় ভবনের আড়ালে চাপা পড়ে যাচ্ছে আকাশ, বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বাতাসের গতি, চাপা পড়ছে প্রকৃতি। দূষিত বাতাসও পাচ্ছে না ‘স্বাধীনভাবে’ প্রবাহিত হওয়ার সুযোগ। যথেচ্ছ নির্মাণকাজ যেভাবে চলছে, কেউ কাউকে পরোয়া করছে না। বছরজুড়েই রাজধানীতে চলে খোঁড়াখুঁড়ির মচ্ছব। একটি রাস্তা একবার সিটি করপোরেশন খুঁড়লো তো কিছুদিন পরে খুঁড়বে ওয়াসা, তারপর গ্যাস কর্তৃপক্ষ। সেই ধুলাবালি আবার ‘সফলভাবে’ ছিটিয়ে চলেছে গণপরিবহন। বাতাসেও যে ধুলাবালি ওড়ে, নগরবাসীর সাধ্য কী সেটা থেকে নিজেকে রক্ষা করে! সরকারি সংস্থাগুলোর পারস্পরিক সমন্বয়হীনতা ও সহযোগিতামূলক মনোভাবের অভাবে বেড়ে চলে দোষারোপের সংস্কৃতি।

বিশুদ্ধ বাতাস না পেলে, বুকভরে শ্বাস টানতে না পারলে কীভাবে বাঁচবে মানুষ? পরিবেশ ও প্রকৃতিবাদীরা এ নিয়ে গলা ফাটালেও সংশ্লিষ্টদের তোড়জোড় নেই। কেউ কেউ বড়জোর গোলটেবিলের আয়োজন করেন, বক্তারা বলে যান গৎবাঁধা বুলি। কিন্তু গোড়ায় হাত দিচ্ছেন না কেউ। যে কারণে খোদ সরকারের মন্ত্রীকেও উচ্চারণ করতে হয় অপ্রিয় সত্য।

লেখক : সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক

 

আরো পড়ুন  > 

 

ঢাকা/তারা