মতামত

অতিথি নয় শীতের পরিযায়ী পাখি

শীত মৌসুমে আমাদের দেশে বেশ কিছু নতুন প্রজাতির পাখি দেখা যায়। বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলের কাদাচর ও সিলেটের হাওরাঞ্চলের বিলগুলোতে। এ পাখিগুলোকে আমরা অনেকে ‘অতিথি পাখি’ বলে থাকি। আমরা ভাবি, যেহেতু সারাবছর দেখা যায় না, তাই এরা অতিথি বা অন্যদেশের পাখি। আমাদের এই ধারণা ভুল! পাখিগুলো মোটেই অতিথি নয়, এরা আমাদের দেশেরই পাখি। এদের বলা হয় ‘পরিযায়ী’। যেহেতু পাখিগুলো পর্যটকের মতো ঘুরে বেড়ায়, তাই এদের পরিযায়ী বলা হয়ে থাকে।

আমাদের দেশে পারিযায়ী পাখির প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ৩০০। আবাসিক পাখির প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ৩৫০। সব মিলিয়ে আমাদের তালিকায় প্রায় ৬৫০ প্রজাতির পাখি আছে। সাধারণত যে পাখি সারাবছর দেশে থাকে তাদের বলা হয় আবাসিক। আর যে পাখি বছরের কিছু সময় অন্য দেশে থাকে তাদের বলা হয় পরিযায়ী। পরিযায়ী পাখিদের অধিকাংশ শীত মৌসুমেই বেশি দেখা যায় এদেশে। আবার কিছু পরিযায়ী গ্রীষ্ম মৌসুমে এদেশে আসে। এদের প্রজাতির সংখ্যা ১০ থেকে ১২। এছাড়া কয়েকটি পাখি আছে বছরের বিভিন্ন সময় বিক্ষিপ্তভাবে ঘুরতে ঘুরতে এদেশে আসে এবং কিছুদিন থেকে চলে যায়। সেজন্য এদের বলা হয়- পান্থ-পরিযায়ী।

আবাসিক পাখি সারা বছর দেশে থাকতে পারলে পরিযায়ী পাখিরা পারে না কেনো? এমন প্রশ্ন অনেকের মনে আসতে পারে। পাখিরা মূলত খাবার, থাকা ও বাসা বানানোর জন্য এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যায়। যখন যেখানে খাবার ও থাকার নিরাপদ জায়গা থাকে, পাখিরা তখন সেখানেই বাস করে, বাসা বানায়, প্রজনন করে। আবাসিক পাখিদের খাবার সারা বছরই দেশে থাকে। সেজন্য এরা অন্য কোথাও যেতে চায় না। আর এদের খাবারও থাকে এদেশের বন-বাদারে, নদী-নালা, খাল-বিলে। খাবারের পাশাপাশি এসব স্থানেই আছে এদের নিরাপদ থাকা ও প্রজননের জায়গা। তাই অন্য কোথাও যাওয়ার কথা ভাবে না এরা। তাহলে বলতে পারেন আবাসিক পাখিরা খাবার খুঁজে পেলে পরিযায়ীরা পায় না কেনো? আসলে বেঁচে থাকার তাগিদে একেক পাখি একেক ধরনের খাবার খায়। কেউ মাছ খায়, কেউ সাপ খায়, আবার কেউ কেঁচো খায়, কেউ পোকা খায়। কেউ পানি থেকে মাছ ধরে খায়, কেউ গাছ থেকে পোকা ধরে খায়। কেউ ফুল খায়, কেউ ফল খায়। আবার কেউ খায় ফুলের মধু। এভাবে একেক পাখি একেক ধরনের খাবার খেয়ে বাঁচে।

   

শীতের সময় যে পরিযায়ী পাখিরা এদেশে আসে, তাদের অধিকাংশের বসবাস উপকূলীয় অঞ্চলের নরম কাদাচর ও সিলেটের হাওর অঞ্চলের বিলে। কারণ তখন এসব চর ও বিলে পানি অল্প থাকে। অল্প পানিতেই থাকে এসব পরিযায়ী পাখির খাবার। খাওয়া শেষ হলে চর বা বিলের আশপাশের ঘাসের মাঠ, বালুর মাঠ, বনভূমি বা বন-বাদারের নিরাপদ স্থানে এসব পাখিরা থাকে। এরপর গ্রীষ্ম মৌসুমে বর্ষার পানি যখন বাড়তে থাকে, তখন এসব চর ও বিল পানিতে তলিয়ে যায়। ফলে পরিযায়ী পাখিরা তাদের খাবার আর খুঁজে পায় না, থাকার জায়গাও হারায়, তাই তারা বাধ্য হয়ে খাবারের খোঁজে, নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে চলে যায় অন্য দেশে। আর এভাবেই কাটে পরিযায়ী পাখিদের সারাজীবন।

শীত শেষ হলে প্রায় আশি শতাংশ পরিযায়ী পাখি এদেশ থেকে চলে যায় হিমালয়ের কাছাকাছি অঞ্চলের দেশে। আর প্রায় বিশ শতাংশ যায় সুদূর সাইবেরিয়াসহ মধ্য ও উত্তর এশিয়ার বিভিন্ন দেশে।

পরিযায়ী পাখিদের অধিকাংশ আবার জলচর বা সৈকত। জলে থাকে বলেই জলচর। আর সৈকতের কাছাকাছি থাকে বলেই জলচর সৈকত বলা হয়। জলচর পরিযায়ী পাখিদের অধিকাংশ দেখা যায় বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষে এবং মেঘনা নদীসহ বিভিন্ন নদীর মোহনায় জেগে ওঠা কাদাচরগুলোতে। চরগুলোর অবস্থান- ভোলা, নোয়াখালী, পটুয়াখালী, বরগুনা, কক্সবাজারসহ আশপাশের অঞ্চলে। উপকূলের এসব চরের মধ্যে আছে- হাতিয়ার দমারচর, নিঝুমদ্বীপ, জাহাজমারার চর, মোক্তারিয়ার চর, গাজীপুরা চর, মদনপুরা চর, মধুপুরা চর, দাশের হাটের চর, মনপুরার চর, তুলাতুলী চর, মাঝের চর, বালুর চর, বগার চর, হাজীপুর চর, রগকাটার চর, লতার চর, যাদবপুর চর, উড়ির চর, শাহজালাল চর, আমানত চর, ঢালচর, ঠেংগার চর, কালাকাইচ্ছা চর, পিয়াল চর, পাতাইলা চর, ছোট বাংলার চর, চর মোন্তাজ, কালাম চর, খাজুর গাইচ্ছা চর, সামছু মোল্লার চর, বোয়ালখালীর চর, বড় রাণীর চর, ছোট রাণীর চর, টেগরার চরসহ আরও অনেক নতুন নতুন জেগে ওঠা নাম না জানা ছোট-বড় চর।

শীত মৌসুমে এসব চরে যেসব জলচর পরিযায়ী পাখি সচারচর দেখা যায় তার মধ্যে আছে- দেশি কানিবক, গো বগা, মাঝলা বগা, ধুপনি বক, কালামাথা কাস্তেচরা, পাতি চকাচকি, খয়রা চকাচকি, ইউরেশিও সিঁথিহাঁস, পাতি তিলিহাঁস, পাতি শরালি, উত্তুরে লেঞ্জাহাঁস, উত্তুরে খুন্তেহাঁস, পাকড়া উল্টোঠুটি, ছোট নথজিরিয়া, কালালেজ জৌরালি, নাটা গুলিন্দা, ইউরেশিও গুলিন্দা, ছোট পানচিল, ছোট পানকৌড়ি, জুলফি পানচিল, ছোট বগা, বড় বগা, পিয়ং হাঁস, গিরিয়া হাঁস, প্রশান্ত সোনাজিরিয়া, মেটে জিরিয়া, পাতি লালপা, পাতি সবুজপা, পাতি বাটান, টেরেক বাটান, জুলফি পানচিল, খয়রামাথা গাঙচিল, কাসপিয়ান পানচিল, চামচঠুঁটো বাটান, খুন্তেবকসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। অবশ্য সব চরে আবার সব জলচর পরিযায়ী পাখি থাকে না। তাই এসব চরের মধ্যে কিছু বিশেষ চরে বিশেষ কিছু পাখিও দেখা যায়। যেমন, হাতিয়ার দমারচর মহাবিপন্ন দেশি-গাঙচষা পাখির একমাত্র আবাসস্থল। আবার এ চরে মাঝেমধ্যে মহাবিপন্ন চামচঠুঁটো বাটান পাখিও দেখা যায়। এছাড়া কালামাথা কাস্তেচরা, ইউরেশীয় চামচঠুঁটি, নদীয়া পানচিলসহ আরও অনেক বিপন্ন পাখির বসবাস আছে এ চরে। উপকূলে জলচর পাখির অরেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান ভোলার চরফ্যাশনের চর শাহজালাল। ২০ থেকে ২২ বছর হবে এ চরের বয়স। শীতে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ প্রজাতির হাজার হাজার পাখি দেখা যায় এ চরে। এরমধ্যে অনেক বিপন্ন বা মহাপিবন্ন পাখিও আছে।

বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা পাখিবিদ ইনাম আল হকের নেতৃত্বে প্রতিবছর শীত মৌসুমে উপকূলের এসব চরে পাখিশুমারি করা হয়। শুমারির তথ্য অনুযায়ী উপকূলের প্রায় ৩০টি চরে প্রায় ৭৫ প্রজাতির প্রায় ৬০ হাজার পাখির দেখা মেলে। পরিযায়ী জলচর সৈকত পাখির আরেকটি বড় অংশ দেখা যায় কক্সবাজারের মহেশখালীর সোনাদিয়াদ্বীপসহ আশপাশের ছোট ছোট দ্বীপে। এ দ্বীপেও প্রায় ৪০ থেকে ৫০ প্রজাতির পাখি দেখা যায়। এর মধ্যে মহাবিপন্ন চামচঠুঁটো বাটান পাখিও আছে। এই পাখির জন্য দ্বীপটি আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত। পাখি গবেষকদের মতে পৃথিবীতে চামচঠুঁটো বাটান পাখি আছে প্রায় ২০০। এর মধ্যে সোনাদিয়ার সৈকত এলাকায় পৃথিবীর প্রায় ১০ শতাংশ চামচঠুঁটো বাটান পাখি বসবাস করে। সোনাদিয়াদ্বীপসহ উপকূলের অনেক চরেই এমন অনেক বিপন্ন বা মহাবিপন্ন পাখির বসবাস রয়েছে। এ পাখির তালিকায় আছে- নর্ডম্যান সবুজপা, কালামাথা কাস্তেচরা, এশীয় ডাউইচার, কালালেজ জৌরালি, ইউরেশিয় গুলিন্দা, বড় নট, দেশি গাঙচষা ইত্যাদি।

   

ইনাম আল হকের তত্বাবধায়নে ২০১০ সালে দেশে প্রথমবারের মতো সোনাদিয়া দ্বীপের কয়েকটি পরিযায়ী পাখির পাখায় ট্রান্সমিটার স্থাপন ও পাখির পায়ে রিং পরানো হয়। এটা ছিল এদেশে পাখি নিয়ে গবেষণার নব দিগন্ত। সোনাদিয়া দ্বীপের পাশাপাশি শাহপরীর দ্বীপেও শীত মৌসুমে অনেক প্রজাতির হাজার হাজার পাখি দেখা যায়। উপকূলের পাশাপাশি শীতে আসা পরিযায়ী জলচর পাখিদের আরেকটি বড় অংশ বসবাস করে সিলেটের হাওরাঞ্চলের বিলগুলোতে। এর মধ্যে মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জের হাকালুকি হাওর, হাইল হাওর, বাইক্কাবিল, টাঙ্গুয়ার হাওর অন্যতম। এসব হাওরে ছোট-বড় অনেক বিল আছে। শীতে এসব বিলের পানি কম থাকে বলে পরিযায়ী পাখিদের জন্য এসব বিল বসবাস ও খাবারের উপযোগী থাকে।

হাওরের মধ্যে হাকালুকি হাওরটি বেশ বড়। এ হাওরের অন্যতম বিল- জলা বিল, বালুজুড়ি, মাইসলা, কুকুরডুবি, ফুয়ালা, পোলাভাঙ্গা, হাওড়খাল, কোয়ার কোণা, মালাম বিল, গোয়ালজুড়, চাড়ুয়া, তেকোনা, ভাইয়া, গজুয়া, রঞ্চি, হারাম, বিড়াল খালসহ ইত্যাদি।

উপকূল ও হাওরের পাশাপাশি পরিযায়ী পাখিদের আরেকটি অংশ দেখা যায় সুন্দরবনের বিভিন্ন অংশে। পাখিবিদদের মতে সুন্দরবন প্রায় ৮০ থেকে ১০০ প্রজাতির পরিযায়ী পাখির নিরাপদ আবাসস্থল। এর মধ্যে আছে অনেক বিপন্ন বা মহাবিপন্ন পাখি। অন্যদিকে উপকূল, হাওর ও সুন্দরবনের পাশাপাশি রাজশাহীর পদ্মার চরাঞ্চলেও অনেক প্রজাতির পরিযায়ী পাখির দেখা মেলে। ওয়েটল্যান্ডস ইন্টারন্যাশনাল বিশ্বব্যাপী পাখি নিয়ে গবেষণা করছে। এ সংস্থার এশিয়া অঞ্চলের সংগঠনের নাম এশিয়ান ওয়াটার বার্ড সেনসাস। এ সংস্থা প্রতিবছর শীত মৌসুমে এশিয়ার দেশগুলোয় একযোগে জলচর পাখিশুমারি করে থাকে। এ সংস্থার বাংলাদেশের জাতীয় সমন্বয়ক ইনাম আল হক। তার তত্বাবধায়নেই বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের উদ্যোগে বাংলাদেশের বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকা ও হাওরের জলাশয়ে জলচর পাখি শুমারি করা হয়ে থাকে এবং বাংলাদেশে এ শুমারি হয়ে আসছে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে। অবশ্য বিশ্বে এ শুমারি হয়ে আসছে ৫০ বছরেরও আগে থেকে।

পরিযায়ী পাখি দেখতে সবার আগে চাই প্রকৃতিবান্ধব মন। অর্থাৎ পাখিদের বিরক্ত না করে এবং যেখানে পাখি দেখতে যাবেন সেখানকার থাকা-খাওয়া-যাতায়াত- সব কাজেই হওয়া চাই প্রকৃতিবান্ধব। তবেই পাখিরা যেমন বাঁচবে, তেমনি বাঁচবে প্রকৃতি। আর প্রকৃতি বাঁচলেই বাঁচব আমরা।

ছবি : লেখক

 

ঢাকা/তারা