মতামত

সম্প্রচার সম্মেলন এবং এ সময়ের গণমাধ্যম

আজ ৬ মার্চ, শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে মিলিত হয়েছেন বাংলাদেশের টেলিভিশন সংবাদের সঙ্গে জড়িত সংবাদকর্মীরা। দ্বিতীয়বারের মতো ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার বা সম্প্রচার সাংবাদিক কেন্দ্রের ব্যানারে অনুষ্ঠিত হচ্ছে সম্প্রচার সম্মেলন।

দেশে বহুদিন ধরে বেশ কিছু সাংবাদিক সংগঠন কার্যক্রম চালিয়ে এলেও, শুধু টিভি সাংবাদিকদের নিয়ে এমন সংগঠন এই প্রথম। পথচলা শুরুর সময়ে এই সংগঠনের দৃপ্ত উচ্চারণ ছিল টিভি সংবাদকর্মীর চাকরির সুরক্ষা। এক বছরে কতটা কী কাজ হয়েছে, বা আদৌ কোনো কাজ হয়েছে কিনা জানি না। তবে এখনই সুফল পাওয়ার প্রত্যাশার চেয়ে সংগঠনটির কাছে চাওয়ার বিষয় হওয়া উচিত- টিকে থাকা। বটবৃক্ষ হয়ে সব টিলিভিশন সাংবাদিকের মাথায় ছায়া হয়ে থাকা। যদি টিকে  থাকতে পারে, তবে নিশ্চিতভাবেই এই সংগঠন থেক কিছু পাবে বাংলাদেশের গণমাধ্যম।

আমার কাছে ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার সাধুবাদ পাবে এজন্য যে, তারা গণমাধ্যম নিয়ে ভাবছে। এই ভাবনা এখন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশে এই মুহূর্তে ভাবনার বিষয় অনেক। জাতীয় রাজনীতি, সামগ্রিক অর্থনীতি, শিক্ষাব্যবস্থা, ধর্ষণ, মাদক, বায়ু দূষণ, রোহিঙ্গা, বেকারত্ব। ভাবনাগুলো অন্য অনেকের ন্যায় গণমাধ্যমও ভাবে। গণমাধ্যম তার চিরাচরিত অভ্যাস থেকেই চিন্তা করে কীভাবে এসব বিষয়ের যাবতীয় সমস্যা এবং সম্ভাবনাকে সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহের সামনে তুলে ধরা যায়। সমাধান আংশিক হোক কিংবা নাই হোক- অন্তত সমস্যা চিহ্নিত করে জানানোর কাজটুকু গণমাধ্যম করে। কিন্তু নানা কারণে বাংলাদেশের গণমাধ্যমও যে এখন একটি ভাবনার বিষয়, সেই ভাবনাটি কেউ ভাবছে কি? অন্তত আমার কাছে দৃশ্যমান নয়।

আগামীতে বাংলাদেশের গণমাধ্যম কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, কার ওপর ভর দিয়ে দাঁড়াবে, ইতিহাস এই সময়ের গণমাধ্যমকে কীভাবে মূল্যায়ন করবে- এসব নিয়ে কেউ ভাবছে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশের একটি বড় সাংবাদিক সংগঠন ‘ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন’র নির্বাচন হলো ফেব্রুয়ারির শেষ দিনে। ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবে কয়েক হাজার সংবাদকর্মীর দেখাদেখি হলো। কিন্তু ঠিক উষ্ণ মিলনমেলা বলতে যা বোঝায় তেমন মনে হলো না। গুচ্ছ গুচ্ছ ভাগে বিভক্ত পক্ষগুলোর কথাবার্তা আলাপ-আলোচনায় ভোটের হিসাবের বাইরেও অনেক হিসাবের বাতচিৎ হলো। সেসব হিসাবের খাতায়ও গণমাধ্যম নিয়ে কোথাও কোনো উদ্বেগ দেখতে পেলাম না। স্বভাবতই আমার মনে প্রশ্ন জেগেছে- এইসব সংগঠন, বছর ঘুরে এইসব নির্বাচন আসলে কতটা গণমাধ্যমের জন্য?

প্রশ্ন হলো, গণমাধ্যম নিয়ে আসলে কি ভাবনার কিছু আছে? বা গণমাধ্যমকে কেন ভাবনার বিষয় করতে হবে? এজন্য আমাদের অনেকের কাছে যেতে হবে, অনেকের কথা শুনতে হবে। যারা গণমাধ্যমে কাজ করে, যারা গণমাধ্যমে আশ্রয় নেয়, যারা গণমাধ্যম চালায়। চা দোকানের দর্শক, ঘরের টিভির সামনে বসা দর্শক, সকালের পত্রিকা হাতে পাঠক কিংবা রেডিওতে কান পাতা অটোরিকশা চালক- বাংলাদেশের বর্তমান গণমাধ্যম নিয়ে তাদের ভাবনা কী, তারা গণমাধ্যমে বলা ঘটনার বিবরণকে সত্য বলে মানেন কি না, গণমাধ্যমে তারা আসলে কী পড়তে চান, কী দেখতে চান? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানলে আমাদের সুবিধা হবে- গণমাধ্যম আসলে এই মুহূর্তে ভাবনার বিষয় কি না তা বুঝতে। নির্মোহভাবে যদি বলি, অন্তত তিনজন মানুষের সাথেও যদি আমার এ বিষয়ে কথা হয়ে থাকে নিশ্চিত- তাদের দুজনই বাংলদেশের গণমাধ্যমের এখনকার ভূমিকায় সন্তুষ্ট নন, গণমাধ্যমে তাদের আস্থা নেই।

এই বক্তব্য অনেকে অবহেলা করতে পারেন, কিন্তু আখেরে এটিকে অবহেলা করার সুযোগ নেই। প্রতিটি মানুষেরই মূল্যায়ন ক্ষমতা থাকে, তা শিক্ষিত জনের একরকম আর শিক্ষা যার নেই তার আরেক রকম। তবে কোনোটিই আপনি ফেলে দিতে পারবেন না। আমাদের ভাবতে হবে, গণমাধ্যম নিয়ে লোকের এই মূল্যায়ন সঠিক কি না? নিজেদের প্রশ্ন করতে হবে। এটা যদি সঠিক না হয় তাহলে ভুল ভাঙানোর দায়িত্বও কিন্তু আমাদের। সাদা হওয়ার পরও আপনাকে কেউ ‘কালো’ বললে তার দেখার এবং বোঝার যে ভুল বা কমতি আছে তা ধরিয়ে দিতে হবে। চুপচাপ বসে থাকলে তার কাছে আপনি চিরদিনই কালো হয়ে বাঁচবেন।

যদি এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজি- গণমাধ্যমের কাছে আপনি কী চান? তাহলে লোকে যে উত্তর দেবে তাও এই মুহূর্তে আমাদের জন্য সন্তোষজনক হবে না। আমাদের কাছে বা অনেকের কাছে বিশ্বস্ত না হলেও, দিনে দিনে অনেকটাই বিকল্প গণমাধ্যম হয়ে উঠতে থাকা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মানুষের বলা কথামালা আমাদের বুঝতে ও জানতে শেখায় যে, অনেক বিষয়ই আছে যা নিয়ে গণমাধ্যমের কথা বলা, কাজ করা দরকার, কিন্তু গণমাধ্যম তা করে না। ফলে শিক্ষিত সাধারণ মানুষ অনেক ক্ষেত্রেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়- গণমাধ্যমের কী করা উচিত? কিছু কিছু এমন ক্ষেত্রে তখন আবার গণমাধ্যমের চোখ খুলতেও আমরা দেখি। সুতরাং আমাদের মানতেই হবে, মানুষ যা চায় তা গণমাধ্যম ঠিকঠাক বলছে না বা করছে না। তাহলে আস্থার সংকটটি যে আছে তা মানতে হবে এবং এ নিয়ে ভাবতে হবে। 

প্রশ্ন হলো কে ভাববে? গণমাধ্যমে যারা কাজ করেন তারা, নাকি গণমাধ্যম যারা চালান তারা? বাংলাদেশের গণমাধ্যম নিয়ে ভাবনার সচেয়ে বড় বিষয়টি এখন এটি। গণমাধ্যমে যা কিছু হচ্ছে তা কতটা কর্মীর ইচ্ছায় আর কতটা মালিকের ইচ্ছায়? আমরা জানি, গণমাধ্যমকর্মীমাত্র স্বাধীন। তিনি স্বাধীনভাবে মানুষকে সত্য খবর জানাবেন। কিন্তু এই স্বাধীনতা এখন বাংলাদেশের সংবাদকর্মীরা পান কিনা? জানি, এই প্রশ্ন প্রতিটি গণমাধ্যমকর্মী নিজেকে করেন। আমরা ধরেই নিয়েছি, এমন প্রশ্ন করলে বাংলাদেশে এখন সাংবাদিকতা করা যাবে না। যদিও এটি একটি ‘ইউটোপিয়ান’ ভাবনা, কিন্তু বাস্তবের কাছাকাছি।

দেশের গণমাধ্যমের এই বাস্তবতা সবাই জানি। কিন্তু এ নিয়ে যে ভাবনার দরকার, প্রতিকারের চিন্তা দরকার, তা আমাদের খুব একটা নেই। গত ৬ মাস বা এক বছরে দেশে কতজন সংবাদকর্মীর চাকরি গেছে, কত সংবাদকর্মী নিয়মিত বেতন পান না, তার খোঁজ সেই অর্থে আমরা নিতে পারছি না। অনেকের মনে হয়ত ইচ্ছা আছে কিন্তু সাহস নেই। যদি অন্যের খবর নিতে গিয়ে নিজের চাকরি চলে যায়! বাংলাদেশে আর কয়টি এমন পেশা আছে যাদের প্রতি মুহূর্তে চাকরি হারানোর ভয় আছে? তারপরও কিন্তু আমরা কথা বলছি না, তারপরও কিন্তু আমরা ভাবছি না।

গত বছর টিভি সংবাদকর্মীদের একটি প্লাটফর্ম দাঁড়িয়েছে- ‘ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার’। এখানে প্রধান কথাটিই বলা হচ্ছে- সাংবাদিকের কর্ম ও জীবনের সুরক্ষা নিশ্চিত করা দরকার। খুবই ভালো উদ্যোগ। কিন্তু প্রশ্ন হলো- সংবাদকর্মীর কর্ম ও জীবন কেন অরক্ষিত, কারা অরক্ষিত করল? একটি ওয়েজ বোর্ড কিছুদিন পরপর পাস করা হয়, কিন্তু কতজন সাংবাদিক এর আওতায় আসেন আর কতজন উপযুক্ত হওয়ার পরও বাইরে থাকেন তার হিসাব নেই। কয়টি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের মালিক ওয়েজ বোর্ড মানেন, কতজন মানেন না তার কোনো হিসাব নেই। কোনো জবাবদিহিতা নেই। পত্রিকায় ওয়েজ বোর্ড হলে টিভিতে কেন নয়? এই প্রশ্ন বহু বছর পরে উঠলেও সমাধান এখনো নেই।

এই যে নেই নেই আর নেই- এর মধ্যেও সাংবাদিকদের উচিৎ নিজেকেই প্রশ্ন করা- এ জন্য দায়ী আসলে কে? মানুষ যে কর্মই করুক না কেন, যে জীবনই নির্বাহ করুক না কেন, প্রত্যেকেই তার অধিকার নিয়ে সচেতন। অধিকার আর কর্তব্য থাকে পাশাপাশি। সাংবাদিক কর্তব্য পালন করবে, রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে কিন্তু অধিকারের বিষয়ে কথা বলতে পারবে না- এটা মানা যায় না। এই না বলতে পারাটা কতটা অন্যের আরোপিত আর কতটা স্ব-আরোপিত? গলদটা কোথায়? ভাবতে হবে এ দিক থেকেও।

আবার আমরা যখন অধিকারের কথা বলব- তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসবে- কার কাছে বলব? তিনি বা তারা কি এই বিষয়টি বোঝার ক্ষমতা রাখেন? পোশাক কারখানা আর গণমাধ্যম অফিস এক নয়- তাও তো বুঝতে হবে, বোঝাতে হবে! দেশের অন্তত ৬টি টেলিভিশনের মালিকের পোশাক কারখানা, ওষুধশিল্পসহ অন্য অনেক প্রতিষ্ঠান আছে। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে ঠিক সময়ে বেতন হলেও একই মালিক তার গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানটির কর্মীদের বেতন দিচ্ছেন না। এই ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিনেও কথা হয়েছে কয়েকজন সংবাদকর্মীর সঙ্গে, তারা সবশেষ মাসটির বেতন পাননি! এখানে স্পষ্ট যে, সংশ্লিষ্ট টেলিভিশন মালিকের সদিচ্ছার অভাব আছে। এই ধরনের মানসিকতার মালিক যতদিন আমাদের গণমাধ্যমে থাকবে ততদিন অধিকারের কথাটি বুঝবে কে, শুনবে কে?

সুতরাং ভাবনার বিষয় আরও আছে। আমাদের ভাবতে হবে গণমাধ্যম আসলে কাদের পরিচালনা করা উচিত, কারাই বা নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার রাখবেন? গণমাধ্যমের মালিক কারা হবেন, টেলিভিশনের লাইসেন্স কারা পাবেন, কী কী শর্ত একজন গণমাধ্যম মালিকের জন্য থাকা উচিত? একইভাবে এটাও দেখতে হবে- সাংবাদিক কোন যোগ্যতায় সাংবাদিক হবেন? অনলাইন নিউজ পোর্টালের সংজ্ঞা কী হবে? দেশের আয়তন আর জনসংখ্যার অনুপাতে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কত হওয়া উচিত? গণমাধ্যমকর্মীর ন্যূনতম বেতন কত হওয়া দরকার, ন্যূনতম যোগ্যতা/প্রশিক্ষণই বা কী কী থাকা দরকার?

হতে পারে অনেক প্রশ্ন, অনেক ভাবনা। তবু শুরু করতে হবে। একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজলে অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলতে শুরু করবে। বাংলাদেশের গণমাধ্যম যেভাবে চলা উচিত, দেশ ও জাতির গঠন ও সুরক্ষায় তার যে ভূমিকা রাখা উচিত তা যদি নিশ্চিত করতে হয় তাহলে আমাদের এসব প্রশ্ন করতে হবে, উত্তর খুঁজতে হবে। না হলে মানুষের কাছে, দর্শক-পাঠক-শ্রোতার কাছে আমাদের  হতশ্রী অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হবে না। যতদিন সাধারণের কাছে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ থাকবে ততদিন অধিকার প্রতিষ্ঠা অসম্ভব। অধিকারহীন কর্তব্য পালনে অভ্যস্ত হয়ে গেলে সেই কর্তব্য কখনোই ঠিকঠাক পালন করা হবে না। বাস্তব সত্য হলো- আমরা আমাদের কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করি না!

লেখক: সংবাদকর্মী

 

ঢাকা/তারা