মতামত

৭ মার্চের ভাষণ ছিল স্পষ্ট কথার চেয়েও ব্যঞ্জনাবহ

১৯৭১ সালের মার্চ মাসের গোড়া থেকেই বাংলাদেশের অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতার সমস্ত কর্তৃত্ব চলে এসেছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপর। বঙ্গবন্ধুর উপর ভরসা করেই বাঙালি  জাতি পাকিস্তানের শাসনের অবসান ঘটানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। কাজেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথাই সেদিন ছিল সকলের জন্য মুখ্য কথা। এবং সেই কথাকে অবলম্বন করেই মানুষ অগ্রসর হয়েছিল। ৭ মার্চ ছিল এ-রকম একটি কথামালার জন্মদিন। অন্য অনেক জন্মদিন আমরা অনেকে পালন করে থাকি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশও পালন করে। কিন্তু একটি বিশেষ কথামালা এ-রকমভাবে জাতির সমস্ত অন্তকরণের আশা আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করতে পারে এবং সেই আশা আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে তারা যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়তে পারে; এমনটি বোধ হয় পৃথিবীর আর কোনো দেশে ঘটেনি।

আমার মনে আছে, ৭ মার্চের ভাষণটি শোনার জন্য অসীম আগ্রহে আমরা রেডিওর সামনে অপেক্ষায় বসেছিলাম। কারণ তখন টেলিভিশনের এত প্রচলন ছিল না। কিন্তু দেখা গেল, ভাষণটি প্রচার করতে দেয়া হলো না। আর তা দেয়া হলো না বলেই রেডিওতে তখন যারা কাজ করতেন- তারা সকলেই অফিস থেকে বেড়িয়ে গেলেন। আমরা ৭ মার্চের ভাষণ সরাসরি শুনতে পেলাম না। পরদিন সকালে রেডিও চালু করেই শুনলাম ৭ মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ। পুরোপুরি ভাষণটি প্রচার করতে তখন বাধ্য হয়েছিল কর্তৃপক্ষ। সেই ভাষণ আমাদের মনে যে কী আশা এবং আশ্বাসের বা উৎসাহের জোগান দিয়েছিল- সে কথা আজকের দিনের অনেকে হয়তো অনুমানও করতে পারবেন না। এই ভাষণটি নিয়ে অনেক বদমতলবের কথা অনেকে বলেছেন। এই ভাষণে নাকি স্বাধীনতার ষোষণা ছিল না ইত্যাদি ইত্যাদি। ২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন- এমন কথাও বলা হয়েছে। তবে আমরা জানি, এই জিয়াউর রহমানই ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ ‘দৈনিক বাংলা’য় এবং ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’য় ‘একটি জাতির জন্ম’ নামে প্রবন্ধে লিখেছেন:

‘৭ই মার্চের রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ঘোষণা আমাদের কাছে এক ‘গ্রিন সিগন্যাল’ বলে মনে হলো। আমরা আমাদের পরিকল্পনাকে চূড়ান্ত রূপ দিলাম। কিন্তু তৃতীয় কোনো ব্যক্তিকে তা জানালাম না। বাঙালি ও পাকিস্তানী সৈনিকদের মাঝেও উত্তেজনা ক্রমেই চরমে উঠেছিল।’

এই কথাগুলোর পরে ‘জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা করেছিলেন’, ‘৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতার কোনো ঘোষণা ছিল না’ ইত্যাদি কোনো কথাই আর চলে না। এসব কথা বলার কোনো অর্থই থাকে না। ৭ মার্চের সেই কথামালায় অনেক স্পষ্ট কথা যেমন ছিল, তেমনি অনেক অনেক ইঙ্গিত ছিল যা স্পষ্ট কথার চেয়েও অনেক বেশি ব্যঞ্জনাবহ। ওই সব ব্যঞ্জনাই কথামালাটিকে অবিস্মরণীয় কবিতায় পরিণত করেছিল। এ যেন কথাকে অর্থের বন্ধন হতে ভাবের কল্পলোকে পৌঁছে দেয়া। কবি নির্মলেন্দু গুণ এই কারণেই সেই ভাষণটি নিয়ে ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’ শিরোনামে একটি চমৎকার কবিতা লিখেছেন এবং বঙ্গবন্ধুকে বলেছেন সেই কবিতার কবি। কবিতার এমন ব্যঞ্জনাময় রাজনৈতিক কৌশলের কাছে সেদিন চূড়ান্ত মার খেয়েছিল পাকিস্তানি জেনারেলদের রণকৌশল। ১৯৭২ সালে মার্কিন সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট করেই বলেছিলেন:

‘‘৭ই মার্চ যখন আমি ঢাকা রেসকোর্স মাঠে আমার শেষ মিটিং করি, ঐ মিটিং-এ উপস্থিত ১০ লাখ লোক দাঁড়িয়ে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানকে স্যালুট জানায় এবং ঐ সময়েই আমাদের জাতীয় সঙ্গীত চূড়ান্ত রূপে গৃহীত হয়ে যায়। আমি জানতাম কী ঘটতে যাচ্ছে, তাই আমি ৭ই মার্চ রেসকোর্স মাঠে চূড়ান্তভাবে ঘোষণা করেছিলাম- এটাই স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য যুদ্ধ করার মোক্ষম সময়। আমি চেয়েছিলাম তারাই [অর্থাৎ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী] প্রথম আমাদের আঘাত করুক। আমার জনগণ প্রতিরোধ করার জন্য প্রস্তুত।’’

এই প্রতিরোধ করার প্রস্তুতি কীভাবে গ্রহণ করা হয়েছিল এবং কীভাবে প্রতিরোধ করা হয়েছিল তা আমরা অনেকেই জানি। বর্তমান প্রজন্মের মানুষকে এই বিষয়গুলো নিয়ে নতুনভাবে ভাবতে হবে বলে আমি মনে করি।

অনুলিখন : সঞ্জয় সরকার

 

   

ঢাকা/তারা