মতামত

করোনা পরিস্থিতি এবং বাঙালির চরিত্র

আমরা এমন কেন? প্রশ্নটা নিজেকে করছি। যে জাতির গল্প আমরা সবাইকে বলে বেড়াই, যে জাতির বীরত্বের কাহিনি আমরা সবাইকে শোনাই সেই জাতির আসল রূপ কি এমন? প্রশ্নটা আপনাদের কাছে। এই জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ থেকে শুরু করে আমলা, মন্ত্রীসহ সকলেই আছেন। এই বিশাল জনসংখ্যার দেশের মানুষগুলো আসলে কেমন? এই সংকটে তাদের আসল চরিত্র চেনা যাচ্ছে।

বঙ্গবন্ধু ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখেছেন: ‘‘আমাদের বাঙালির মধ্যে দুইটা দিক আছে। একটা হলো ‘আমরা মুসলমান, আর একটা হলো, আমরা বাঙালি।’ পরশ্রীকাতরতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে। …অনেক সময় দেখা গেছে, একজন অশিক্ষিত লোক লম্বা কাপড়, সুন্দর চেহারা, ভাল দাড়ি, সামান্য আরবি ফার্সি বলতে পারে, বাংলাদেশে এসে পীর হয়ে গেছে। বাঙালি হাজার হাজার টাকা তাকে দিয়েছে একটু দোয়া পাওয়ার লোভে। ভাল করে খবর নিয়ে দেখলে দেখা যাবে এ লোকটা কলকাতার কোন ফলের দোকানের কর্মচারী অথবা ডাকাতি বা খুনের মামলার আসামি। অন্ধ কুসংস্কার ও অলৌকিক বিশ্বাসও বাঙালির দুঃখের আর একটা কারণ।” [পৃ: ৪৭-৪৮]

বঙ্গবন্ধু অনেক আগেই এই জাতির রোগ চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। তিনি তখনই বুঝতে পেরেছিলেন, এই জাতি নিজেদের স্বার্থের জন্য যে কাউকেই পীর, উজির-নাজির মানতে প্রস্তুত। নিজের বোধ-বুদ্ধি, বিবেচনা দিয়ে অনেকেই বিষয়টি খতিয়ে দেখার প্রয়োজন মনে করেন না। দেশ স্বাধীন হয়েছে ঊনপঞ্চাশ বছর হলো। এতো দিন পরেও আমাদের চরিত্র এতোটুকু বদলায়নি।

২০২০ সালের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। এর আগে আমাদের এ বিষয়ে ভাবনা বা ভূমিকা কী ছিল? যে কোনো সংকটে আমরা প্রথমেই দেশের নীতি নির্ধারকদের বক্তব্য শুনতে চাই, কারণ তারা দেশ চালান। দেশের মানুষের সুবিধা-অসুবিধা দেখার দায়িত্ব তাদের। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় শুরু থেকেই বলে আসছে, করোনা নিয়ে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি আছে। করোনা মোকাবিলা করতে প্রস্তুত সবাই। অথচ বাস্তবে তেমনটা দেখা যাচ্ছে না। প্রস্তুতির পুরো বিষয়টিই প্রশ্নবোধক চিহ্নের মুখে পড়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা কম হলেও বাড়ছে। দিন যত যাচ্ছে বেরিয়ে আসছে প্রস্তুতির নানা রকম দুর্বলতা।

একজন চিকিৎসক যখন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা করবেন তখন তার নিরাপত্তার জন্য প্রাথমিক যে প্রস্তুতি দরকার সেই প্রস্তুতিতেও দেখা যাচ্ছে বিরাট ঘাটতি। মনে হচ্ছে- এ যেন টানাটানির সংসার। এদিকে গেলে ওদিকে হচ্ছে না। চিকিৎসকরাও চিকিৎসার ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। এতে তাদের দোষ দেওয়া যায় না। কারণ এই ভাইরাস এতোটাই শক্তিশালী যে, চিকিৎসক যদি প্রস্তুতি না নিয়ে চিকিৎসা শুরু করেন তাহলে তিনিও আক্রান্ত হবেন- এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। এরপর রয়েছে রোগ শনাক্তকরণ কিটের অভাব, রোগীকে বিশেষ যে নিরাপত্তা বেষ্টনীতে সেবা দিতে হবে তাও এখনো প্রস্তুত নয়। এই তথ্য শুধু রাজধানী ঢাকার। ঢাকার বাইরের অবস্থা আরো ভয়ানক।

বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের রোগী চিহ্নিত হয়েছে মার্চের শুরুতে। ২০২০ সালের জানুয়ারিতেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা কৌশল ঠিক করে দিয়েছিল, সতর্কও করেছিল। এই পুরো সময়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কতটা পরিকল্পনা করে প্রস্তুতি নিয়েছে তা এখন দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। তারা হয়তো ভেবেছে- আগে আসুক পরে দেখা যাবে। এই একই ভাবনা ছিল ডেঙ্গু পরিস্থিতির সময়। সেই সময়ের ভয়াবহতা আমাদের জানা।

হাঁচি, কাশি, থুথু এরপর করোনাভাইরাস ছড়ানোর সবচেয়ে বড় উপসর্গ হলো স্পর্শ। অর্থাৎ হাত, মুখ, শরীর ভালোভাবে ধোয়ার পরও জনসমাগম এড়িয়ে চলতে হবে। প্রয়োজনে অবশ্যই ঘরে স্বেচ্ছাবন্দি হয়ে থাকতে হবে। যেখানে সরকার থেকে বারবার এই কথাগুলো বলা হচ্ছে, সবাইকে সতর্ক করা হচ্ছে, তারপরও কেউ সামাজিক দূরত্ব মেনে চলছেন না। আপনি হয়তো নিরাপদ, সুস্থ আছেন কিন্তু আপনার পাশের জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কিনা বুঝতে পারা প্রায় অসম্ভব। সুতরাং বাঁচতে চাইলে ঘরে থাকতেই হবে। পুরো পৃথিবীর মানুষ তাই করছে।অথচ আমরা এই সহজ কথাটাই বুঝতে পারছি না। বিভিন্ন জায়গায় ওয়াজে বক্তারা মসজিদে নামাজ পড়ার কথা বলছেন। এ নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে মসজিদে নামাজ পড়তে যারা নিষেধ করছে তারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে কথাগুলো বলছে। এসব ইহুদি কাফেরদের চক্রান্ত। এতে কী হচ্ছে? এতে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। করোনার কারণে যেখানে সৌদি আরবের মক্কা-মদিনাতে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে, বলা হচ্ছে এবার হজ বাতিল হতে পারে সেখানে বাংলাদেশে মাইকে ডেকে মসজিদে নামাজে আসার জন্যে প্রচারণা চালানো হচ্ছে।

অবাক করা ব্যাপার হলো, এই বিষয়ে কেউই মুখ ফুটে কিছু বলছেন না। কারণ বিষয়টি স্পর্শকাতর।  সবাই যার যার জায়গা থেকে ভাবছেন- কিছু বললে যদি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা হয়। যারা এমন ভাবছেন, তারা বুঝতে চাইছেন না, অনুভূতিতে তখনই আঘাত আসবে যখন আপনি জীবিত থাকবেন। মৃত মানুষের কাছে অনুভূতির কোনো দাম নেই।

স্বভাবতই প্রশ্ন আসতে পারে, আমি কেন একথা বলছি? আমার যুক্তি সরল। নিজের তো বটেই, কারো ক্ষতি হোক আমি চাই না। আমরা সমাজবদ্ধ জীব। করোনার সংক্রমণ সমাজে ঘটলে তা কারো জন্যই মঙ্গলজনক হবে না।

আমাদের চরিত্রের একটা বড় অংশ স্বার্থপরতা; শুধু নিজের ভালো চাওয়া। উত্তরার দিয়াবাড়িতে স্থানীয়রা কোয়ারেন্টাইন করার প্রতিবাদ জানিয়েছে, ঢাকার খিলগাঁওয়ের কবরস্থানে স্থানীয় বাসিন্দারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মৃতের দাফন করতে দিতে চাননি।

রাজধানীর তেজগাঁওয়ে আকিজের নিজস্ব দুই বিঘা জমিতে করোনা রোগীদের জন্যে হাসপাতাল তৈরি করতে বাধা দেন স্থানীয়রা। এগুলোর অবশ্য পরে সমাধানও হয়েছে। কিন্তু এই যে আমাদের মানসিকতা, আমাদের স্বার্থপরতার চরিত্র- এটা বড় সাংঘাতিক। এখান থেকে আমরা কখনোই বের হতে পারবো বলে মনে হয় না।

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রবাসীদের বিষয়টি। যখন এয়ারপোর্ট লকডাউন করার কথা ছিল তখন করা হয়নি, অবাধে প্রবেশ করেছে প্রবাসী বাংলাদেশিরা। করারই কথা। কারণ এটি তাদের দেশ। বিশ্ব দুযোর্গে মানুষ তো নিজ দেশেই ফিরবে। কিন্তু পুরো বিষয়টি হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে। এয়ারপোর্টে নামার পর যথাযথভাবে স্বাস্থ্য পরীক্ষা না করে ছেড়ে দেওয়া, কি পরিমাণ প্রবাসী দেশে প্রবেশ করেছে তার সঠিক হিসাব না রাখা বিষয়টিকে আরো জটিল করে তুলেছে। অনেকে তো দেশে ফিরেই ফ্রি স্টাইলে চলতে শুরু করেছেন। বিয়ে থেকে শুরু করে সামাজিক সকল অনুষ্ঠানে যোগদান, বাজারে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডা- কী না করেছেন। যদিও পরিস্থিতি এখন অনেকটাই কঠোর হয়েছে। কিন্তু তত দিনে ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে।

এরপর আসি বাজারে পণ্য সংকট তৈরি করে বেশি মুনাফা লাভ, প্রয়োজনের অতিরিক্ত পণ্য কিনে বাসায় মজুদ করার বিষয়ে। এই বিষয়গুলোও কিন্তু আমাদের মানসিকতা প্রমাণ করে। রাষ্ট্রের নিম্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য আলাদা পরিকল্পনা খুব একটা নেই। এ দেশের ধনীদেরও যে এই বিষয়ে খুব আগ্রহ তাও বলা যাচ্ছে না। তবে ত্রাণ দিচ্ছেন অনেকে। সেলফির সদ্ব্যবহারও করছেন তারা। এ সব কিছুকে ছাড়িয়ে গেছে আমাদের ঘরে না থাকার মানসিকতার বিষয়টি। এই বোধ আমাদের মাঝে যত দ্রুত ফিরে আসবে তত মঙ্গল। নিজে, নিজ পরিবার এবং অন্যদের সচেতন করতে পারলেই আমরা এই ভয়ানক মহামারি মোকাবিলা করতে পারবো। না হলে আমাদের ব্যর্থতা নতুন ইতিহাসের জন্ম দেবে। ঢাকা/তারা