মতামত

বাকশাল গঠনের নেপথ্যে

১৯৭৫ সালের আজকের দিনে অর্থাৎ ৪ আগস্ট জাতীয় পত্রিকা ‘দৈনিক ইত্তেফাক’-এর শীর্ষ খবর ছিল: ‘জেলা বাকশাল সম্পাদক ও যুগ্ম সম্পাদকদের নাম ঘোষণা’। এদিন ‘দৈনিক বাংলার’ শীর্ষ খবর ছিল: ‘জাতীয় দলের জেলা সম্পাদকদের নাম ঘোষণা’। ওই খবরের উপশিরোনামে বলা হয়, প্রতিটি কমিটিতে একজন সাধারণ সম্পাদক ও পাঁচজন যুগ্ম সম্পাদক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ৩ আগস্টের ঘটনা পরের দিন ৪ আগস্ট পত্রিকায় ছাপা হয়।

১৯৭৫ সালে আমাদের দেশে ১৯টি জেলা ছিল। এই ১৯ জেলাকে বঙ্গবন্ধু ৬০টি জেলায় রূপান্তর করেছিলেন। এর কারণ হলো, যাতে জেলাগুলো অর্থনৈতিক কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গড়ে ওঠে এবং তৃণমূলের মানুষ এর সুফল পায়। ৬০টি জেলায় ৬০ জন গভর্নর নিয়োগ দেওয়া হয়। এটা ছিল বঙ্গবন্ধু ঘোষিত জাতীয় রাজনৈতিক প্ল্যাটফরম-এর প্রশাসনিক কাঠামো। আগস্টে এই ৬০ জেলার গভর্নরদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়। সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ৭ জুন সর্বদলীয় জাতীয় রাজনৈতিক প্ল্যাটফরম গঠনের সিদ্ধান্ত হয়।  সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর ১১৭-ক অনুচ্ছেদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে একটি নতুন জাতীয় দল গঠন করার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। যার মূল কারণ একদিকে স্বাধীনতা-পরবর্তী দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে সংঘটিত নানা ধরনের অনাচার প্রতিরোধ করা। এবং অন্যদিকে যুদ্ধের ধ্বংসস্তুপের ওপর জাতি পুনর্গঠনের কাজ শুরু করা।

এমন সাংবিধানিক দায়িত্ব পেয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি জাতীয় দল গঠন করে এর নাম দেন ‘বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ বা ‘বাকশাল’ । বাকশালের বিধিবিধানে বিভিন্ন সরকারি চাকুরে ও সেনাবাহিনীর সদস্যসহ অন্যান্য সব দল ও সংগঠনকে জাতীয় দলে যোগ দিয়ে অপশক্তির মোকাবিলা করা এবং দেশ পুনর্গঠন ও পুনঃনির্মাণে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার কথা বলা হয়। বাকশালের বিভিন্ন দিক, কার্যক্ষেত্র এবং সম্ভাবনা সবিস্তারে বর্ণনা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর এই উদ্যোগকে দ্বিতীয় বিপ্লব হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

কোন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে বাকশাল গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সেই প্রেক্ষাপট সম্পর্কে একটু আলোচনা করা প্রয়োজন। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে যতটা না ক্ষতি হয়েছিল, বিজয়ের ঠিক আগ মুহূর্তে পাকহানাদার বাহিনী তাদের পরাজয় নিশ্চিত হয়ে পূর্ব বাংলার অবকাঠামোসহ  বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান অর্থাৎ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে একেবারে ধ্বংস করে দিয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরে এক বিধ্বস্ত পোড়ামাটির দেশ পান। প্রথমেই তিনি যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে মনোনিবেশ করেন।

বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘তিন বছর সময় দাও। এই তিন বছর কাউকে কিছু দিতে পারব না।’ কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রে যাঁরা যেখানে বসেছিলেন, তাঁদের অনেকেই রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা ভুলে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। অনেকেই অবৈধ ব্যবসা-বাণিজ্য করে অর্থের পাহাড় গড়েছেন। অথচ দেশের মানুষের মুখে অন্ন তুলে দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছিলেন বঙ্গবন্ধু। বিদেশী বন্ধু রাষ্ট্রগুলো বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে পাশে দাঁড়ায়। একদিকে তিনি বিদেশ থেকে সাহায্য আনেন, অন্যদিকে সেসব রিলিফের সামগ্রী লুটপাট করে খোলা বাজারে বিক্রি করে দিচ্ছিল লুটেরার দল। এমন এক অবস্থায় এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু অনেক আক্ষেপ করে বলেছিলেন: ‘আমি নানা দেশ থেকে ভিক্ষে করে আনি, আর চাটার দল সেগুলো খেয়ে ফেলে।’ এর পাশাপাশি দেশে এক অরাজকতার পরিবেশ বিরাজ করছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাজিত শত্রুদের ইন্ধনে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল।

শুধু ১৯৭৩ সালেই বিভিন্ন ধরনের গুপ্ত ও সশস্ত্র হামলায় ১৮৯৬ জন মানুষ নিহত হয়েছিলেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে পাটকল এবং গুদাম আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। খাদ্য জাহাজ পুড়িয়ে দেওয়া হয়। পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে নৈরাজ্যকর অবস্থার দিকে মোড় নিচ্ছিল। এই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় সংশোধনীয় মাধ্যমে জরুরি অবস্থা জারির বিধান পাস করা হয়। দ্বিতীয় সংশোধনী পাস হওয়ার পরপরই রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদউল্লাহ ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর মাসে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। সে সময় একজন সংসদ সদস্যকে হত্যা করা হয়। জরুরি অবস্থা জারির পরও পরিস্থিতির তেমন একটা পরিবর্তন হয়নি।

দেশে জরুরি অবস্থা থাকাকালেও ১৯৭৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দু’জন এমপিকে হত্যা করা হয়। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সংবিধান, সরকারের শ্রেণি-বিভাগ, গভর্নেন্স, গণমাধ্যম ও দলীয় ব্যবস্থা নিয়ে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পাস হয়েছিল। ছাত্রলীগের সম্মেলনকে কেন্দ্র করে সংগঠনটি দু’ভাগ হয়ে যায়। একটি অংশ বঙ্গবন্ধুকে সমর্থন দেয়। অন্য অংশটি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) নামে নতুন দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এই দলটিই বঙ্গবন্ধু সরকারের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়ায়। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, স্বাধীনতার পর জাসদ দেশের যে ক্ষতি করেছে তা না হলে দেশ এতো দিনে সত্যিকারের সোনার বাংলা হতো। জাসদের পাশাপাশি স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাজিত শক্তিসহ সর্বহারা পার্টিসহ আব্দুল হকরা সরাসরি সরকার পতনে সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করে। 

সম্পূর্ণ ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়া সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশকে পুনর্গঠন ও সম্পূর্ণ নৈরাজ্যকর অবস্থা থেকে উদ্ধার করে স্থিতিশীল ও অগ্রগতির দিকে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনে বঙ্গবন্ধু জাতীয় সংসদে বিল পাস করে বাকশাল ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন।

জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনীতে বিধান রাখা হয় যে, রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে বাকশালে যোগদান না করে কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য পদে বহাল থাকতে পারবেন না। দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক সংগঠন ও সংস্থার স্থলে একক দল হিসেবে নবগঠিত জাতীয় বাকশাল ১৯৭৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে সরকারিভাবে কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। বাকশাল পদ্ধতির বেশ কিছু বাধ্যবাধকতা ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মধ্যে একটি ছিল সংবাদপত্র অধ্যাদেশ। ১৯৭৫ সালের জুন মাসে জারিকৃত এই অধ্যাদেশে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় মাত্র চারটি সংবাদপত্র প্রকাশনার ব্যবস্থা রেখে অন্য সব পত্রপত্রিকা প্রকাশের অনুমতি বাতিল করা হয়।

সাংগঠনিক ক্ষেত্রে বাকশালের চেয়ারম্যান হিসেবে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় শ্রমিক লীগ, জাতীয় মহিলা লীগ, জাতীয় যুবলীগ ও জাতীয় ছাত্রলীগ নামে দলের পাঁচটি অঙ্গ সংগঠনকে মনোনয়ন দান করা হয়। নির্বাহী কমিটির সদস্যরা মন্ত্রীর পদমর্যাদা ভোগের অধিকারী ছিলেন।

দেশের প্রশাসন ব্যবস্থাকে গণমুখী করার লক্ষ্যে ঢেলে সাজানোই ছিল বাকশাল পরিকল্পনার উদ্দেশ্য। বাকশালের একটি বড় লক্ষ্য ছিল দেশের প্রভাবশালী আমলাতন্ত্রের সংস্কার। নতুন ব্যবস্থায় পুনর্গঠিত আমলাতন্ত্রকে দুটি ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো হয়েছিল। একটি ছিল জাতীয় পর্যায়ে কেন্দ্রীয় কমিটি এবং অপরটি জেলা পর্যায়ে প্রশাসনিক কাউন্সিল। এই ব্যবস্থায় বিদ্যমান প্রতিটি মহকুমাকে একজন নির্বাচিত গভর্নরের অধীনে জেলায় রূপান্তরের বিধান রাখা হয়। জেলার সংসদ সদস্যরা, বাকশালের প্রতিনিধি এবং সংশ্লিষ্ট জেলার বেসামরিক, পুলিশ ও নিরাপত্তাবাহিনীর কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত হওয়ার কথা ছিল জেলা প্রশাসনিক কাউন্সিল। গভর্নর হবেন জেলার প্রধান নির্বাহী এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হবেন গভর্নরের সচিব। উদ্দেশ্য ছিল, জেলা গভর্নর পদ্ধতির মধ্য দিয়ে শোষণমূলক ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে প্রশাসনকে জনগণের কাছাকাছি নিয়ে আসা। এবং স্বাধীনতাকে তাদের কাছে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে অর্থবহ করে তোলা। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং শোষণ-বঞ্চনার অবসানের লক্ষ্যে বাকশালের পরিকল্পনায় ব্যাপকভাবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের ওপরও গুরুত্বারোপ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দেশপ্রেমিক জনগণের এটি বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, বাকশাল ব্যবস্থা নিঃসন্দেহে দেশের জন্য স্থায়ীভাবে মঙ্গল বয়ে আনত। কিন্তু দেশের জন্য স্থিতিশীলতা ও দেশের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য যে কর্মসূচি বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন তা বাস্তবায়নের আগেই তাঁকে হত্যার মধ্য দিয়ে এর পরিসমাপ্তি ঘটানো হয়েছিল।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে দেশের উন্নয়নের গতিকে স্তব্ধ করার চক্রান্ত করা হয়েছিল। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধুর বড় কন্যা শেখ হাসিনা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। সেই পুরাতন ষড়যন্ত্রকারীরা এখনো সচেষ্ট। জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টাই এই অগ্রযাত্রার সব বাধা দূর করে অগ্রগতির ধারা সমুন্নত রাখবে।