মতামত

রক্ষিবাহিনীর ভাষ্যে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড (২য় পর্ব)

রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ে ফিরে সারোয়ার ও আমি চিন্তা করতে থাকলাম কী করা যায়। পরিস্থিতি দ্রুত পর্যালোচনা করে আমরা বুঝতে পারলাম, সরকার এবং সরকারের রাজনৈতিক ভিত্তি পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার সদস্যদের সবাই তাদের প্রিয় নেতা রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হয়েছেন জেনে বিস্মিত, ব্যথিত ও হতবাক হয়ে পড়েছেন। তাদের বেশির ভাগই দেশের এই চরম মুহূর্তে নিজেদের রাষ্ট্রীয় দায়িত্বভার নিজেরাই ত্যাগ করে জীবন বাঁচানোর তাগিদে নিরাপদ স্থানে চলে গেছেন। অথচ তাদের, বিশেষত উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীদের দায়িত্ব ছিল বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে সরকার ও দলের হাল ধরে হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। যেমনটা ১৯৭১ সালে তাজউদ্দীন আহমদ সাহসিকতা ও দৃঢ়তার সঙ্গে করেছিলেন।

একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন তোফায়েল আহমেদ। তিনি চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সফল হননি। আমাদের মনে হলো, এই দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে পরীক্ষিত রষ্ট্রনায়ক তাজউদ্দীন আহমদ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলে ১৯৭১ সালের মতো আবারও সরকারের হাল ধরে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিরুদ্ধে অনতিবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারতেন। আমরাও পেতাম দিকনির্দেশনা।

এদিকে সারা দেশের সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের অগণিত নেতা ও কর্মী নিশ্চুপ হয়ে পড়লেন; প্রতিবাদে কেউ একটা টু শব্দ পর্যন্ত করলেন না। প্রকাশ্যে কোথাও কোনো প্রতিবাদ হলো না। এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। আমি ভাবতে থাকি, বাঙালি জাতি কি এতই অকৃতজ্ঞ যে তাদের মুক্তিদাতা জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো অথচ একজন বাঙালিও প্রতিবাদে রাজপথে নেমে এলো না। ১৯৭১ সালের বীর বাঙালি ১৯৭৫ সালে এসেই ভীরু জাতিতে পরিণত হলো।

কোথাও কোনো প্রতিবাদ হয়েছে কিনা জানার জন্য বিভিন্ন জেলার রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পগুলোতে আমরা ফোন করতে থাকি। কিন্তু এমন কোনো খবর পাওয়া গেল না। অথচ জনগণের সমর্থন ছাড়া কোথাও কোনো প্রতিরোধ সফল হয়নি, সফল করা যায় না। অল্প কিছুসংখ্যক ছাড়া সাধারণ জনগণ এ ঘটনায় হতবাক হয়ে পড়েছিল। বঙ্গবন্ধুর মতো একজন মানুষকে বাংলাদেশে কেউ হত্যা করতে পারে, এটা তারা কল্পনাও করতে পারেনি। ঘটনার আকস্মিকতায় তারা হতভম্ব ও ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। তাদের সংগঠিত করে প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ করার দায়িত্ব ছিল রাজনৈতিক নেতৃত্বের। কিন্তু তারা তা করেননি।

তখন সেনানিবাসের ভেতরে কী অবস্থা, তা-ও স্পষ্ট বোঝা যায়নি। ৪৬ ব্রিগেড সদর দপ্তরে যেসব সেনা কর্মকর্তাকে দেখেছিলাম, তারা আমাদের কোনো উদ্যোগে সাড়া দেবেন বলে মনে হয়নি। বরং ফলাফল উল্টো হতে পারে বলেই আমাদের মনে হয়েছে। আমরা প্রতিরোধের উদ্যোগ নিলেই সেনাবাহিনী ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে, এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না। সেনাবাহিনী পক্ষে থাকলে সেনাপ্রধান নিজেই সেদিন ব্যবস্থা নিতে পারতেন। বিশ্বের পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মুক্তিযুদ্ধকাল থেকেই বাংলাদেশের বিরেধিতা করে এসেছে। আমি ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনে দিয়ে উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সরকারি বাসায় যাওয়ার সময় দেখেছিলাম, মার্কিন রাষ্ট্রদূতের গাড়ি হোটেল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রদূত সারা রাত হোটেলে কী করছিলেন তা রহস্যাবৃত। প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসা আমাকে বলেছেন, তিনিও ধানমন্ডি এলাকায় ওই দিন সকালে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিস ইউজিনকে গাড়িতে দেখেছেন।

আমাদের প্রধান কার্যালয়ের সামনে ট্যাঙ্ক। আমাদের কিছু রক্ষী সদস্য আছেন সাভারে প্রশিক্ষণকেন্দ্রে। রক্ষীবাহিনীর বেশির ভাগ অস্ত্রশস্ত্র পিলখানায়। আমাদের নিজস্ব শক্তি ও প্রতিরোধ ক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত হয়ে পড়ল। এই পরিস্থিতিতে সামনে করণীয় বিষয়গুলো নিম্নরূপ ছিল বলে আমাদের মনে হয়েছে:

১. বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা। এ বিষয়ে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি ছিল এই যে, রক্ষীবাহিনীর যেকোনো পদক্ষেপই সেনাবাহিনীকে নাড়া দিত। সেনাবাহিনীর অস্তিত্বের প্রশ্নে মুক্তিযোদ্ধা, পাকিস্তান-প্রত্যাগত ও অমুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের ভেদাভেদ ভুলে একত্র হয়ে রক্ষীবাহিনীকে মোকাবিলা করত। কারণ, সেনাবাহিনীর ভেতরে রক্ষীবাহিনী সম্পর্ক নেতিবাচক ধারণা ছিল। তখন সেনাবাহিনীর সামনে দাঁড়ানোর ক্ষমতা রক্ষীবাহিনীর হতো না। সব মহল থেকে বলা হতো, রক্ষীবাহিনী ভারতের হয়ে কাজ করছে। জনগণও তা বিশ্বাস করত। যদি সেনাবাহিনীর একটা উল্লেখযোগ্য অংশ রক্ষীবাহিনীর পদক্ষেপকে সমর্থন করে সক্রিয় হতো, তাহলে দেশে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের সূচনা হওয়ার আশঙ্কা ছিল। এটা কারও জন্য মঙ্গলজনক হতো না।

২. সেনাপ্রধান কে এম সফিউল্লাহ যদি সেনাবাহিনীর ওপর তার নেতৃত্ব ও কমান্ড অক্ষুণ্ন রেখে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারতেন, তাহলে সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়ে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা বা পদক্ষেপ নিতে পারতাম। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, সেনাবাহিনীর কমান্ডের ওপর সফিউল্লাহ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। কারণ, তাঁর সহকর্মী সেনাবাহিনীর উপপ্রধান জিয়াউর রহমান ও চিফ অব দ্য জেনারেল স্টাফ খালেদ মোশাররফকে তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তাদের তিনজনের মধ্যে গোপন দ্বন্দ্ব ছিল। তিনি আমাদের বারবার বলেছিলেন, ‘We are going to do something’. কিন্তু তিনি দৃশ্যমান ও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেননি।

৩. আমরা আরেকটা কাজ করতে পারতাম তা হলো, রক্ষীবাহিনীর সবাইকে নিয়ে যমুনা নদীর ওপারে গিয়ে প্রতিরোধ সৃষ্টি করা। নদীর ওপারে আমরা হয়তো বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর রংপুর ব্রিগেডের সহায়তা পেতাম। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ব্রিগেড কমান্ডার মীর শওকত আলীর নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর যশোর ব্রিগেড আমাদের বিরোধিতা করত। আমার এ অনুমানের কারণ হলো, ১৫ আগস্টের ঘটনার পর খুলনার রক্ষীবাহিনীর অ্যাডজুট্যান্ট লিডার মোজাফফর হোসেনকে সব রক্ষীসহ নিরস্ত্র করার একটা ফন্দি এঁটেছিলেন মীর শওকত আলী। কিন্তু রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের পূর্ণ প্রস্তুতি থাকায় এবং শৃঙ্খলার কারণে তিনি তা করতে পারেননি।

ঢাকা সেনানিবাসের ৪৬ ব্রিগেড থেকে ফিরে রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ে আমরা কয়েকজন যখন কথা বলছি, তখন খালেদ মোশাররফ আমাদের ফোন করেন। তিনি জানালেন যে রক্ষীবাহিনীর পক্ষ থেকে একজনকে রেডিও স্টেশনে যেতে হবে। আমরা বুদ্ধি করে খালেদ মোশাররফকে জানাই, পরিচালক তো দেশে নেই। সে সময় খালেদ মোশাররফ আমাদের জানালেন, সেনাবাহিনী-প্রধান কে এম সফিউল্লাহ, বিমানবাহিনী প্রধান এ কে খন্দকার, নৌবাহিনী প্রধান এম এইচ খান, পুলিশ বাহিনী প্রধান এ কে নুরুল ইসলাম ও বিডিআর প্রধান খলিলুর রহমান রেডিও স্টেশনে নতুন সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে ঘোষণা দিয়েছেন। তাঁদের ঘোষণা রেডিওতে প্রচারিত হয়েছে। তার কথা শুনে আমরা অবাক হয়ে যাই, এটা কীভাবে সম্ভব?

কিছুক্ষণ পর খালেদ মোশাররফ আবার আমাদের কার্যালয়ে ফোন করেন। এবার বলেন, পরিচালক এ এন এম নূরুজ্জামানের অনুপস্থিতিতে সারোয়ার ও আমি রেডিও স্টেশনে গেলেই হবে। আমাদের পাল্টা কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তিনি টেলিফোন রেখে দিলেন। সারোয়ার ও আমি আলোচনা করে ঠিক করলাম, আমরা দুজন যাবো না। পরিস্থিতির কারণে তখন আমাদের মনে হয়েছিল, সব বাহিনীপ্রধান যেহেতু নতুন সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছে, সেহেতু রক্ষীবাহিনীর আনুগত্য প্রকাশ না করে উপায় নেই। তাই আমরা ভারপ্রাপ্ত পরিচালক আবুল হাসান খানকে রেডিও স্টেশনে পাঠাই। তিনি রক্ষীবাহিনীর পক্ষ থেকে সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন। কিন্তু সারোয়ার আর আমার ওপর চাপ আসতেই থাকে। আমাদের দুজনকে রেডিও স্টেশনে যাওয়ার জন্য কয়েকবার বলা হয়। প্রতিবারই আমরা বলি, সব বাহিনীপ্রধান আনুগত্য স্বীকার করেছেন। আমাদের বাহিনীর ভারপ্রাপ্ত প্রধানও করেছেন। তাহলে আমাদের কেন আনুগত্য প্রকাশ করতে হবে? সেনাবাহিনী প্রধান আনুগত্য ঘোষণা করার পর উপপ্রধানকে তা করতে হয়নি। মনে হলো, আড়াল থেকে খন্দকার মোশতাক আমাদের ওপর চাপ দিচ্ছেন। কারণ, আমাদের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক খুব পরিচিত ছিলেন না। সবার ধারণা ছিল, পরিচালকের অবর্তমানে সরোয়ার আর আমি রক্ষীবাহিনী নিয়ন্ত্রণ করি।

চারদিক থেকে উপর্যুপরি সুপারিশের কারণে অনিচ্ছা সত্ত্বেও তখন আমাদের দুজনকেও রেডিও স্টেশনে যেতে হয়। এ ছাড়া আমাদের উপায় ছিল না। যাওয়ার পর দেখি, খন্দকার মোশতাক, তাহের উদ্দিন ঠাকুর ও খুনিরা কয়েকজন তখনো রেডিও স্টেশনে বসে আছে। তাদের উপস্থিতিতে আমাদের ঘোষণা রেকর্ড করা হয়। অবশেষে ইতিহাসের এই কালো অধ্যায়ের সঙ্গে অন্যান্য বাহিনীপ্রধানের পাশাপাশি আমাদের দুজনের নাম যুক্ত হয়।

রেডিও স্টেশন থেকে অফিসে ফিরে এসে আমরা ঠিক করি আওয়ামী লীগ ও সরকারের মধ্যম পর্যায়ের বিশেষত যুব নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা দরকার। এ চিন্তা থেকে আমরা প্রথমে আবদুর রাজ্জাককে ফোন করি। কিন্তু জানতে পারি তিনি বাড়ি থেকে বের হয়ে গছেন। ফোন করি আরও কয়েকজনকে। শুধু তোফায়েল আহমেদকে বাড়িতে পাওয়া গেল। তিনি আমাদের আহ্বানে রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ে আসতে আগ্রহ প্রকাশ করলেন। তখন আমরা লিডার দীপককুমার হালদারকে কয়েকজন রক্ষী সদস্যসহ তার বাড়িতে পাঠাই। তোফায়েল আহমেদ তার সঙ্গে রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয় আসেন। জাতির জনক সপরিবার নিহত হয়েছেন জেনে তোফায়েল আহমেদ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হলেও আমাদের প্রধান কার্যালয় থেকে সেনাবাহিনী প্রধান, সরকারের অন্যান্য নেতাসহ অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। কিন্তু কারও কাছ থেকেই ইতিবাচক সাড়া পাননি। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আমরা নিজেরাই অনেকের চেহারা পরিবর্তন হতে দেখেছি। দেখেছি, সরকারের ভেতরের অনেকেই উল্টো পথ ধরেছেন। বুঝতে পারছিলাম না দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে কাকে বিশ্বাস করব, কাকে করব না।

প্রতিটি মুহূর্তে আমাদের পরিচালক ব্রিগেড়িয়ার এ এন এম নূরুজ্জামানের অভাব বোধ করছিলাম। কারণ, সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে তিনি সেনাবাহিনীর নেতৃস্থানীয় কর্মকর্তা এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জানতেন। ফলে তার পক্ষে পরিস্থিতি অনুধাবন করে ব্যবস্থা গ্রহণ অনেক সুবিধাজনক হতো। তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে আমরা বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরবর্তী নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করলাম। সিদ্ধান্ত হলো সারোয়ার আর আমি সাভার যাব। লিডার শেখ দালিল উদ্দিনকে সাভারে যাওয়ার পথ রেকি করতে পাঠানো হলো। শেখ দলিল মিরপুর সেতু পর্যন্ত গিয়ে দেখেন, সেখানে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। এটা দেখে তিনি ফিরে আসেন। তার কাছ থেকে এ তথ্য পেয়ে বুঝতে পারলাম, সরাসরি আমাদের সাভারে যাওয়ার পথ বন্ধ। তখন কেন যেন আরও মনে হলো, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী বা সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে নজরদারিতে রেখে আমাদের; বিশেষত সারোয়ার ও আমার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। যাতে আমরা কোথাও যেতে না পারি। এটা হয়তো খালি চোখে আমরা বুঝতে পারছি না। কারণ, আমাদের কোনো গোয়েন্দা ইউনিট নেই। এ অবস্থায় উপায় না দেখে আমরা সাভারে যাওয়ার পরিকল্পনাও ত্যাগ করি। এর মধ্যে রক্ষীবাহিনীর সাভার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে একটি ঘটনা ঘটে। আমরা জানতে পারি, সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কর্নেল আমীন আহম্মেদ চৌধুরী একদল সেনা নিয়ে রক্ষীবাহিনীর সাভার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যান। তিনি রক্ষীবাহিনীর সাভার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে অবস্থানরত একজন ভারতীয় প্রশিক্ষককে ঢাকায় আমাদের প্রধান কার্যালয়ে নিয়ে আসেন এবং রেখে চলে যান। ভারতীয় প্রশিক্ষকের নাম ছিল বালা রেডিট। তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর ছিলেন। সেখানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর আরও কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা এবং এনসিও-জেসিও ছিলেন। তারা অনেক আগেই দেশে ফিরে যান। ছিলেন শুধু বালা রেডিউ।

সেদিন অর্থাৎ ১৫ আগস্ট আমীন আহম্মেদ চৌধুরী সাভার থেকে তাকে ঢাকায় আমাদের প্রধান কার্যালয়ে নিয়ে আসায় আমরা কিছুটা অবাক হই। আমরা ভেবেছি, তিনি হয়তো ঊর্ধ্বতন কারও নির্দেশে এটা করেছেন। কিন্তু পরে জানতে পারি, এ ব্যাপারে সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কেউ তাঁকে নির্দেশ দেননি। আমীন আহম্মেদ চৌধুরী তখন জয়দেবপুরে কর্মরত ছিলেন। তিনি স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই কয়েকজন সেনাসহ তার ইউনিট থেকে সেখানে যান এবং মেজর বালা রেডিউকে ঢাকায় রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ে নিয়ে আসেন। এ ঘটনা বেশ রহস্যাবৃত। মেজর বালা রেডিউকে আমরা ভারতীয় হাইকমিশনে পাঠিয়ে দিই। বেসামরিক প্রশাসনের পক্ষে সরকারিভাবে জাতীয় রক্ষীবাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব রুহুল কুদ্দুস ও প্রধানমন্ত্রীর সচিব আবদুর রহিম। সংকটময় ওই মুহূর্তে পরামর্শের জন্য তাদের আমরা পাইনি। তারাও আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। সারোয়ার ও আমি নিজেদের বুদ্ধিতে যতটুকু কুলিয়েছে, দেশ ও জাতির জন্য যা ভালো মনে হয়েছে, তা-ই করার চেষ্টা করেছি। আমরা জানতাম, জাতির জনক নিহত, তাকে আর ফেরত আনতে পারব না। কিন্তু বাঙালি জাতির জন্য তার সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান আমাদের বাংলাদেশ। সেই বাংলাদেশের আমরা ক্ষতি করতে পারি না। আমাদের দায়িত্বই হলো বাংলাদেশকে রক্ষা করা। বঙ্গবন্ধু বাঙালি আর বাংলাদেশের জন্য তার জীবন উৎসর্গ করেছেন। তিনি জীবিত থাকলে বাংলাদেশের কল্যাণকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে গুরুত্ব দিতেন। বাংলাদেশ রক্ষা পেলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চিরকাল বাঙালির জাতির পিতা হিসেবে থেকে যাবেন।

বিশ্বজুড়ে দেখা গেছে, ব্যর্থতার দায়ভার কেউ নিতে চায় না। সে জন্য ইংরেজিতে একটা কথা আছে ‘Success has many fathers, alure is an orphan.’ আমাদের ক্ষেত্রেও হয়েছে এই অবস্থা। জাতীয় রক্ষীবাহিনীর সাফল্য কেউ চোখে দেখে না। এমনকি বঙ্গবন্ধুকে রক্ষায় ব্যর্থতার দায়ও এই বাহিনীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে এ নিয়ে অনেকেই রক্ষীবাহিনীর সমালোচনা করেছেন। বঙ্গবন্ধুকে রক্ষায় যে ব্যর্থতা এবং প্রতিরোধ গড়ার যে ব্যর্থতা, তার দায়ভার যতটুকু রক্ষীবাহিনীর ওপর বর্তায়, ঠিক ততটুকু গ্রহণ করতে আমি বিন্দুমাত্র দ্বিধা করি না। রক্ষীবাহিনীর উপপরিচালক (প্রশিক্ষণ) হিসেবে আমার ওপর যতটুকু দায়ভার পড়ে, ততটুকু আমি বিনা দ্বিধায় মাথা পেতে নেব। কিন্তু প্রশ্ন দেখা দেয়, সেদিন যাদের দায়িত্ব ছিল তথ্য সংগ্রহ ও যথাস্থানে সরবরাহ করা, সেসব গোয়েন্দা সংস্থা যথা ডিজিএফআই, এনএসআই ও স্পেশাল ব্রাঞ্চের যে ব্যর্থতা, তার দায়ভার কি ওই সংস্থাগুলো ও তাদের তদানীন্তন কর্তারা নিয়েছেন? রাষ্ট্রের যারা কর্ণধার ছিলেন অর্থাৎ রাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতিতে আগেও যারা দায়িত্ব পালন করেছিলেন এবং সেদিনও অর্থাৎ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে দায়িত্ব পালন করার কথা ছিল, তারা কি তাদের দায়িত্ব পালন করেছেন? তারা দেশের উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদের ক্ষমতার আসনে বসে ছিলেন। জাতির ইতিহাসে সবচয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায়ে তাদের ব্যর্থতার দায়ভার কি তারা এড়াতে পারবেন? যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন তাঁরা তো সরাসরি জনগণের কাছে দায়ী। অনেকেই যখন খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভার সদস্য হলেন, এখন তাদের জবাবদিহি কোথায় থাকল?

যাদের ওপর রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিরাপত্তার দায়িত্ব ছিল, ১৫ আগস্ট তাঁরা যে সীমাহীন ব্যর্থতা দেখালেন, তার জন্য জবাব কে দেবে? যে কজন দেশপ্রেমী বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করতে গিয়ে জীবন দিয়েছেন, তাদের মধ্যে কর্নেল জামিল উদ্দিন ছাড়া আর কাউকে কি বীরত্বসূচক সম্মান দেওয়া হয়েছে? যারা সরাসরি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে, তাদের কি শাস্তি দেওয়া হয়েছে? আর বাকশাল ও আওয়ামী লীগের অগণিত নেতা ও কর্মীবাহিনী, যারা শ্লোগান দিতেন ‘বঙ্গবন্ধু যেখানে, আমরা আছি সেখানে’- তারা কোথায় ছিলেন? সামান্য কারণে তারা রাজপথে নেমে আসেন। অথচ দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেদনাদায়ক ঘটনার পর, জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যার পর তারা রাজপথে বেরোলেন না কেন? তাদের কি ভয় ছিল? তারা হাজারে হাজারে রাজপথে নামলেই তো বোঝা যেত জনগণ খুনিদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। জনগণের দৃশ্যমান সমর্থন থাকলেই সরকারি বাহিনীগুলো প্রতিরোধে দাঁড়াতে পারত।

১৫ আগস্ট সারাদিন রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ে বসে আমরা পরিস্থিতি পর্যালোচনা এবং সম্ভাব্য কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়, তা বিবেচনা করি। রক্ষীবাহিনীর প্রায় প্রতিটি ইউনিটের সঙ্গে যোগাযোগ করে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য সবাইকে তৈরি থাকার নির্দেশ দেই। এদিকে বিভিন্ন সূত্র থেকে আমরা তথ্য সংগ্রহ করতে থাকি এবং সেনাবাহিনীর ভেতরে কী অবস্থা জানতে চেষ্টা করি। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার সংবাদে জাতি এমনিতেই শোকাতুর কিন্তু তা প্রকাশ করার কোনো পথ খোলা ছিল না। কারণ, জাতীয় নেতারা তখন দিকনির্দেশনা দিতে ব্যর্থ হন। রেডিও-টেলিভিশন খুনিদের নিয়ন্ত্রণে ছিল; বিভিন্নভাবে তারা দেশে একটা ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। যে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছিল, সেই ধ্বনি হঠাৎ কোথায় যেন মিলিয়ে যায়। তার বদলে এলো ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ ধ্বনি। পাকিস্তানি আমল ও ধ্যানধারণা আবার যেন ফিরে আসে। পাকিস্তানই এ সময় সবার আগে খন্দকার মোশতাকের সরকারকে অভিনন্দন জানায়। কিছু লোক পাকিস্তানি ভাবধারা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। সুবিধালোভী ও সুযোগসন্ধানী একদল মানুষ এই সুযোগে ক্ষমতার রাজনীতিতে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালায়। পাকিস্তানি ভাবধারার লোকেরা স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট মোশতাককে অভিনন্দন জানাতে দেরি করেনি। বাকশাল ও আওয়ামী লীগের কিছু নেতা, বিশেষ করে তাহের উদ্দিন ঠাকুর, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, কে এম ওবায়দুর রহমান ও নূরুল ইসলাম মঞ্জুর যে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তা স্পষ্ট হতে থাকে। (চলবে)

পড়ুন প্রথম পর্ব :  রক্ষিবাহিনীর ভাষ্যে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড

লেখক: মুক্তিযুদ্ধকালীন কাদেরিয়া বাহিনীর বেসামরিক প্রধান ছিলেন। পরবর্তী সময়ে রক্ষীবাহিনীর ডেপুটি ডিরেক্টরের দায়িত্ব পালন করেছেন।