মতামত

ধর্ষণ রাষ্ট্রদ্রোহী, সর্বোচ্চ শাস্তি ধর্ষকের প্রাপ্য

দেশ আজ ধর্ষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার। ধর্ষণবিরোধী মানববন্ধন ও বিক্ষোভে সামিল হচ্ছেন অনেকেই। কে জানে তাদের মধ্যেই হয়তো ঘাপটি মেরে আছে কোনো ধর্ষক-সত্তা! সভ্য সমাজের আড়ালে লুকিয়ে আছে সেই অসভ্য মানুষ!

সমাজে ধর্ষণ অতীতেও ছিল; এখন উদ্বেগজনক পর্যায়ে বেড়েছে। কিছু ঘটনা চমকে ওঠার মতো। এই কি আমাদের সমাজ? বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার একটি গ্রামে পাঁচ বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে চারজন শিশুকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ভাবা যায়! খবরটা পত্রিকায় পড়ার পর মনে একটাই প্রশ্ন জেগেছে- কীভাবে সম্ভব? আমিও একজন বাবা। তার থেকেও গর্বের জায়গা আমি কয়েকশ শিক্ষার্থীর শিক্ষক। তারা আমার সন্তানতুল্য। আমার কি এ ঘটনায় হতাশ হওয়াটা স্বাভাবিক নয়?

আপনি হয়তো ভাবছেন বাড়িতে সকলেই নিরাপদ। কিন্তু গত বছর মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলায় মামার দ্বারা অমানবিক নৃশংসতার শিকার হয়েছে দেড় বছরের এক কন্যা শিশু। শুধু শিশু কেন, নিরাপদে আছেন কি আমার স্নেহময়ী বৃদ্ধ মা? গত ৩০ সেপ্টেম্বর রাতে নামাজের জন্য ওযু করতে নিজ বাসা থেকে বের হন ৭২ বছর বয়সী এক নারী। এ সময় প্রতিবেশী কাদির তার মুখ চেপে ধরে বাড়ির ভেতরে নিয়ে ধর্ষণ করে।

এই প্রতিবেদনও খবরের পাতায় পড়েছি। আর ভেতরে ভেতরে রক্তাক্ত হয়েছি। মনে হয়েছে, সমাজের এই হিংস্র পশুদের কারণে আজ কেউ নিরাপদ নয়। শিশু থেকে বৃদ্ধ, বাড়ি থেকে রাজপথ, স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সবখানেই রয়েছে মানুষরূপী এই হিংস্র পশুগুলো।

সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে গণধর্ষণের ঘটনার পর গত কয়েক দিনে আরো কমপক্ষে দশটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ঘটনাগুলো মানুষের মনে এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি করেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- ধর্ষণসহ নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংস অপরাধের বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে ধর্ষণের প্রবণতা কেন রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না? প্রতিদিন ধর্ষণের খবর প্রকাশিত হচ্ছে, প্রকাশিত হচ্ছে না এমন ঘটনার সংখ্যা কত হতে পারে- তা অনুমান করাও সম্ভব নয়। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) দেওয়া তথ্য মতে, চলতি বছরে জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত দেশে ৮৮৯ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। আর ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন ৪১ জন।  প্রতিমাসে গড়ে ১১১ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। সম্প্রতি সংস্থাটির দেওয়া এ পরিসংখ্যান থেকে আরও জানা যায়, দেশে ধর্ষণসহ নারীর প্রতি সহিংসতা দিন দিন বাড়ছে। ২০১৯ সালে ১ হাজার ৪১৩ নারী ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন ৭৬ জন। আর আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ১০ জন নারী। ২০১৮ সালে ৭৩২ জন এবং ২০১৭ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮১৮ জন নারী। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে হার ক্রমশ বাড়ছে।

বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ ক্যাম্পাসে ধর্ষণ বা গণধর্ষণের অভিযোগ নতুন নয়। যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে তখন সেই দলের ছাত্রনেতাদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ ওঠে। তারা এতটাই বেপরোয়া থাকেন যে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে এমন মনে করেন না। ১৯৯৩ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের এক ছাত্রীকে তুলে নিয়ে গণধর্ষণ করে ছাত্রদল নেতাসহ কয়েকজন। ঘটনার পর ছাত্রীর বাবাকে ডেকে সমঝোতা করা হয়। ওই ছাত্রী ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যান; আর কোনো দিন তিনি ক্যাম্পাসে ফেরেননি। এখানেই শেষ নয়, ১৯৯৫ সালে পরিসংখ্যান বিভাগের এক ছাত্রীকে প্রকাশ্যে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করে আগের অভিযুক্ত ছাত্রদল নেতা। এই ঘটনায়ও তার কোনো বিচার হয়নি। এরপর ২০০০ সালের বাঁধনের ঘটনা তো ভুলে যাওয়ার কথা নয়। থার্টি ফাস্ট নাইটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বাঁধনকে লাঞ্ছিত করা হয়। তখনও ক্ষমতাসীন ছাত্রনেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে।

এভাবে কি জীবন যাপন সম্ভব? আমরা কতটা অনিরাপদের দিকে ধাবিত হচ্ছি? কেন এই জঘন্যতম অন্যায়গুলো বেড়ে চলেছে তা নিরূপণ করা প্রয়োজন। আমাদের শুধু সরকারের প্রতি তাকিয়ে থাকলেই হবে না। এলাকার ভালো-মন্দ আমিই ভালো জানব। সেক্ষেত্রে সরকারি নিরাপত্তা বাহিনীকে জানাতে হবে এলাকার কোন মানুষটি পশু মন নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ধর্ষণের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। আর রাষ্ট্রের জাতীয় সমস্যায় আমি মনে করি, সকল রাজনৈতিক দলের একাত্মতা প্রয়োজন। আমরা বিভিন্ন সময় দেখি জাতীয় সমস্যায় রাজনৈতিক দলগুলোর ভিন্নধর্মী বক্তব্য। যা সংকটময় সময়ে বিচলিত করে। অন্যায়-অপরাধ কোনো দলের কাছেই কাম্য নয়।

বাংলাদেশে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০’ নামে একটি আইন রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, যদি কোনো পুরুষ, কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তাহলে তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। অর্থদণ্ডের কথাও সেখানে রয়েছে। আমরা যদি বিভিন্ন দেশের ধর্ষণের শাস্তির আইন দেখি তাহলে দেখা যায়, সংযুক্ত আরব আমিরাতে যদি কারো বিরুদ্ধে ধর্ষণের অপরাধ প্রমাণিত হয়, তাহলে দেশটিতে সাত দিনের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। চীনে ধর্ষকের জন্য বরাদ্দ শাস্তি হলো মৃত্যুদণ্ড। সৌদি আরবে ধর্ষণে জড়িত থাকার প্রমাণ পেলে শাস্তি প্রকাশ্যে শিরচ্ছেদ। তবে তার আগে দোষীকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অচেতন করা হয়। উত্তর কোরিয়ায় ফায়ারিং স্কোয়াডে দাঁড় করিয়ে গুলি করে অপরাধীর বুক ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয়। আফগানিস্তানে আদালত রায় দেওয়ার চারদিনের মধ্যে অভিযুক্তকে গুলি করে হত্যা করা হয় কিংবা ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। মিসরে এখনও অনেক অপরাধে মধ্যযুগীয় শাস্তি প্রথা থাকলেও ধর্ষণের শাস্তি ফাঁসি। ইরানেও ধর্ষকের শাস্তি ফাঁসি অথবা প্রকাশ্যে পাথর মেরে মৃত্যু। মঙ্গোলিয়ায় ধর্ষিতার পরিবারের হাত দিয়ে ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

আমি সবসময় আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। কারণ, আইন হলো কতগুলো নিয়মের সমষ্টি যা ব্যক্তি বা সমাজের নিরাপত্তায় জরুরি। আইন ছাড়া সভ্য রাষ্ট্র চলতে পারে না। তথাপি সবকিছু জেনে-বুঝে আমি চাই- ধর্ষককে প্রকাশ্যে হত্যা বৈধ ঘোষণা করা হোক। কারণ, যে ধর্ষণ করেছে সে শুধু রাষ্ট্রের প্রচলিত আইনই অমান্য করেনি, খর্ব করেছে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি। কলঙ্কিত করেছে একটি নারীর ভবিষ্যৎ, একটি বাবার স্বপ্ন, একটি মায়ের অহঙ্কার। যে ব্যক্তি একসঙ্গে এতগুলো অপরাধ করতে পারে, তাকে কেন ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ বলা যাবে না? সে তো অবশ্যই সমাজের ক্ষতি করেছে। সমাজের ক্ষতি তো রাষ্ট্রেরই ক্ষতি। তাই আমি মনে করি, ধর্ষণ রাষ্ট্রদ্রোহী কাজ। ধর্ষকের রাষ্ট্রদ্রোহীর সাজা প্রাপ্য।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট