মতামত

ধর্ষণবিরোধী সমাবেশে ধর্ষিতা উপেক্ষিত

রাজধানীর শাহবাগে ধর্ষণবিরোধী ‘মহাসমাবেশ’ থেকে নয় দফা দাবি জানিয়েছে বামধারার ছাত্র সংগঠনগুলো। তাদের অনেকগুলো দাবির সঙ্গে আমার দ্বিমত নেই। তবে, ‘ব্যানার’ বামধারার হলেও আন্দোলনের কলাকৌশল নির্ধারিত হয়েছে পর্দার আড়াল থেকে, যা নিয়ে ইতোমধ্যেই বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। ধর্ষিতা নারীকে বীরাঙ্গনার সঙ্গে তুলনা করা, বঙ্গবন্ধুকে অবমাননা-অশ্রদ্ধা ও মুজিব কোর্টে আগুন লাগানোসহ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে নিয়ে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে স্লোগান-প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন- এগুলো সরকারের সমালোচকরাও ভালো চোখে দেখেননি। বরং এসব কারণে আন্দোলনের উদ্দেশ্য নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন।

অন্যদিকে, অনেকে মনে করেন, আন্দোলন তথ্য-নির্ভর ছিল না। মূল সমস্যা চিহ্নিত না করে, অপরাধের উৎস না খুঁজে সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার সংস্কার দাবি না করে বরং আবেগতাড়িত হয়ে কিছু সিদ্ধান্ত সরকারের কাজকে সহজ করে দিয়েছে। সরকারও মেনে নিয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩)-এর ৯(১) ‘যাবজ্জীবন’ এর জায়গায় ‘ফাঁসি’র দিকেই এগুচ্ছে সরকার। এখন ধর্ষকের ফাঁসি হলেই ধর্ষণ কমবে- এ নিয়েও বিস্তর আলোচনা, সমালোচনা কিংবা গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে, যা সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার বিষয় ছিল।

মূল কথা হলো, বেছে বেছে কয়েকটি অর্থাৎ সিলেক্টিভ ঘটনার বিচার দাবি করে ধর্ষণবিরোধী সমাবেশের যৌক্তিকতা, গ্রহণযোগ্যতা এবং উদ্দেশ্য নিয়েই প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ধর্ষকের বিচার কিংবা ধর্ষণরোধের আন্দোলন হবে সার্বজনীন, যেখানে ধর্ষিতা উপেক্ষিত নয়, বরং ধর্ষিতার পাশে দাঁড়িয়ে সব ধর্ষকের বিচার দাবি করা হবে। এর প্রতিবাদের ভাষা হবে তথ্যনির্ভর, গ্রহণযোগ্য এবং পক্ষপাতহীন।

কিন্তু আমরা দেখেছি, সিলেট এমসি কলেজ ও নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের বর্বর ঘটনায় ‘ধর্ষণবিরোধী সমাবেশ’ যতটা সরব, ততটাই নীরব ভূমিকা কিংবা পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ছাত্রীর ধর্ষকদের ক্ষেত্রে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদক জলি তালুকদারের যৌন নিপীড়কের বিরুদ্ধেও কোনো প্রতিবাদ দেখা যায়নি! ধর্ষণবিরোধী সমাবেশ থেকে দাবি তোলা হয়নি, কোটাবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতা ধর্ষণের অভিযোগে মামলায় অভিযুক্ত হাসান আল মামুন ও নাজমুল হাসান সোহাগ কর্তৃক ধর্ষণ ঘটনা তদন্ত সাপেক্ষে বিচার করতে হবে। আওয়াজ তোলা হয়নি সিপিবির কেন্দ্রীয় নেত্রী জলির লিখিত অভিযোগে অভিযুক্ত নিপীড়ক জাহিদ হোসেন খানের শাস্তি দাবির!

আরেকটি ভয়ঙ্কয় দৃশ্য হলো, ধর্ষণবিরোধী সমাবেশ যারা সংগঠিত করেছেন, আন্দোলনে দাঁড়িয়েছেন তাদের অনেককে আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ছাত্রীর ধর্ষকদের রক্ষা করতে মাঠে-ময়দানে মিছিল-মিটিং করতেও দেখা গেছে! শুধু তাই নয়, ওই ছাত্রীর চরিত্রহনন করতে একদল মাঠেও নেমেছে। আরেকদল সোশ্যাল মিডিয়াতে অপপ্রচার করে বিষয়টি ভাইরাল করেছে। এভাবেই ধর্ষিতাকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছে তারা, যার দায়ভার ধর্ষণবিরোধী সমাবেশ, রাষ্ট্রযন্ত্র এড়াতে পারে না।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদক জলি তালুকদার লিখিত অভিযোগে জানিয়েছেন- ‘গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমাবেশে যোগ দিতে মুক্তি ভবন থেকে জাতীয় প্রেসক্লাবের দিকে যাওয়ার সময় পার্টির মিছিলে জাহিদ হোসেন খান আমার সঙ্গে যে ন্যাক্কারজনক নিপীড়নের ঘটনা ঘটিয়েছে, সে বিষয়ে স্পষ্টভাবে আমি আমার বক্তব্য সেই মিছিলে উপস্থিত কমরেড আবদুল্লাহ কাফী রতনকে আনুষ্ঠানিকভাবে অবহিত করেছি। সেই সঙ্গে আমি তাকে অনুরোধ করেছিলাম, এই নিপীড়ন বিষয়ে আমাকে বারবার জিজ্ঞাসাবাদের মধ্য দিয়ে নিজেরা যেন কোনো অসুস্থ চর্চা না করেন এবং আমাকেও নির্যাতনের মধ্যে না ফেলেন। কিন্তু আমি স্তম্ভিত, মর্মাহত এবং উদ্বিগ্ন এই দেখে যে, কেউ কেউ এই ঘটনাটাকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যে ভয়ঙ্কর নোংরামিতে লিপ্ত হয়েছেন।’

এখানে উল্লেখ্য, জলি তালুকদার এবং ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ছাত্রী তাদের ওপর ঘটে যাওয়া যৌন-নিপীড়ন ও ধর্ষণের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন, প্রতিবাদ করেছেন। অথচ তারা ন্যায় বিচারের দাবি তোলায় ধর্ষণবিরোধী সমাবেশের কতিপয় আন্দোলনকারী তাদের ‘পতিতা’ বানানোর ষড়যন্ত্র করছেন। তাদের চরিত্রহননের চেষ্টা চলছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। এই ঘটনাগুলো ধর্ষণবিরোধী সমাবেশের মূল উদ্দেশ্য ও গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের ওই নারী ভীত হয়ে নীরব থেকেছেন। অপ্রকাশিত অন্যান্য যৌন নির্যাতনের শিকার নারীর মতোই সয়ে যাওয়ার কৌশল নিয়েছেন। কিন্তু নির্যাতনকারী ধর্ষক হায়নাদের পশুত্ব প্রকাশ পেয়েছে ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর। আর তখনই মানুষ জেগে উঠেছে, বিচার চেয়েছে। অন্যদিকে নীরবে সয়ে যাওয়া নয়, নিজেই ধর্ষকের বিচারের দাবি করেছেন, ধর্ষকের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ওই ছাত্রী। আবার ‘সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ঢাকা কমিটি নিপীড়কের পক্ষ নিয়ে আমার প্রতি যে অন্যায় ট্রায়াল চালিয়েছে, তার বিচার চাই’- প্ল্যাকার্ডে লিখে গত ২০ সেপ্টেম্বর সিপিবির কার্যালয়ের অফিস ফ্লোরে জলি তালুকদার অনশনের মাধ্যমে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও করেছেন। অথচ ধর্ষণবিরোধী সমাবেশ থেকে তাদের দু’জনকেই রীতিমত উপেক্ষা করা হয়েছে। ওই সমাবেশ থেকে এ দু’জনকে নিয়ে কেউ কোনো কথা বলেননি, নিপীড়ক-ধর্ষকের বিচারের দাবি তোলেননি। ফলে যে ধর্ষিতা ছাত্রী দেশ ও জাতির সামনে তার ধর্ষণের বিবরণ তুলে ধরে ন্যায় বিচারের প্রত্যাশায় আইনের দরজায় দাঁড়িয়েছেন তাকে এড়িয়ে ধর্ষণবিরোধী সমাবেশ কতটুকু যৌক্তিক, ন্যায়সঙ্গত ও নিরপেক্ষ এটি বিচার-বিশ্লেষণ ও বিবেচনার দাবি রাখে।

আমি মনে করি, সব ধর্ষকের পাশাপাশি এই দু’জনের প্রতি যে অন্যায় হয়েছে; যারা অন্যায় করেছে তাদের বিচারের দাবিও জোরালোভাবে করতে হবে। অভিযুক্ত অপরাধীদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি তুলতে হবে। ধর্ষণবিরোধী সমাবেশ হবে সার্বজনীন। সকল ধর্ষকের বিরুদ্ধে আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমেই নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিতে হবে। আর এখানেই প্রয়োজন সম্মিলিত আন্দোলন এবং রাজনৈতিক ঐক্যমত।

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম (বোয়াফ)