মতামত

সড়ক দুর্ঘটনা ঠেকাতে 

দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলো নিরাপদ হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। মহাসড়কগুলোয় দূরপাল্লার বাস থেকে শুরু করে মালবাহী ট্রাক-কাভার্ডভ্যান যেন দানব রূপে আভির্ভূত হচ্ছে। আর গণপরিহন-সিএনজিও মুহূর্তে প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে। যেকোনো সময় বাস-ট্রাক-সিএনজি যে কাউকে চাপা দিতে পারে, সংঘর্ষ ঘটতে পারে দুই যানবাহনের মধ্যেও—এমন আতঙ্ক-শঙ্কা নিয়েই জনগণকে রাস্তায় নামতে হয়। যেতে হয় কর্মস্থলে, কখনো কখনো এক জেলা থেকে আরেক জেলায়ও।

এক সময় দুর্ঘটনার জন্য সড়ক-মহাসড়কের রোড ডিভাইডার না থাকাকে দায়ী করা হতো। বর্তমানে অধিকাংশ সড়ক-মহাসড়কে রোড ডিভাইডার বসানো হয়েছে। এখন যানবাহন একদিকে চলার কথা। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, যানবাহন একমুখী চলে না। উল্টোদিক থেকেও চলে।  ফলে একই লেনে দ্রুতগামী দুটি যানবাহনের মধ্যে প্রায়ই মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এছাড়া, ধীরগতির গাড়ি রাস্তার মাঝ বরাবর চলার কারণে পেছন থেকে দ্রুতগতির যানবাহন এসে ধাক্কা দেওয়ার কারণেও দুর্ঘটনা ঘটছে।

তবে, মোটা দাগে সড়ক দুর্ঘটনার জন্য বেশকিছু কারণকে দায়ী করা যায়। এর মধ্যে সবার আগে বলতে হয়, একই লেনে যান্ত্রিক-অযান্ত্রিক বাহন চলাচল করার কথা। একই লেনে দ্রুত গতির বাস-ট্রাকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অযান্ত্রিক-ব্যাটারিচালিত রিকশা কিংবা কমগতির যান্ত্রিক বাহন লেগুনা-নসিমন করিমনও চলে।  এতে দুর্ঘটনা ঘটে সবচেয়ে বেশি। এছাড়া, মহাসড়কের পাশে দোকানপাট থাকায় সেখানে জটলা তৈরি হয়। অনেক সময় সেসব দোকানপাটের সামনে চালকরা গাড়ি পার্কিং করেন।  পার্কিংয়ের গাড়িগুলোও বড় ধরনের জটলার কারণ হয়ে ওঠে। আর সেই জটলা বিপজ্জনক হয়ে ওঠে দ্রুতগামী দূরপাল্লার বাস-ট্রাক-কাভার্ডভ্যানের কারণে। এর বাইরে আরও একটি বড় কারণ হলো, ওসব দোকানপাট ও সড়কের পাশে বসা হাটবাজারগুলোয় প্রায় ফুটওভার ব্রিজ থাকে না। থাকে না সড়কের একপাশ থেকে অন্য পাশে যাতায়াতের জন্য আন্ডারপাসও। ফলে পথচারীরা রাস্তার ওপর দিয়ে চলতে গিয়ে দুর্ঘটনার কবলে পড়েন।

আরও আছে। চলন্ত গাড়িতে চালকরা প্রায় হয় মোবাইলফোনে কথা বলেন, না হয়, পাশের হেল্পার কিংবা সুপারভাইজারের সঙ্গে খোশগল্পে মেতে ওঠেন। এতটাই খোশগল্পে মগ্ন থাকেন যে, সামনে কী ঘটতে যাচ্ছে, তাও বুঝে উঠতে পারেন না।  ফলে, অনেক সময় তাল সামলাতে না পেরেও দুর্ঘটনায় পড়েন তারা।  এসব দুর্ঘটনায় অনেকের প্রাণহানি ঘটে, কেউ কেউ সারাজীবনের জন্য হয়ে পড়েন পঙ্গু। এই সড়ক দুর্ঘটনা দেশের বহু পুরনো রোগগুলোর একটি।  বিষয়টি সড়ক-পরিবহন সংশ্লিষ্টরা যে জানেন না, তা নয়। সব জেনেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ যে কেন নেওয়া, তা-ই বোধ করি পৃথিবীর সপ্তাচার্যকেও হারা মানাবে।

সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনা ঠেকাতে হলে অন্তত ৯টি উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। এগুলো হলো:

১।  চালকের শিক্ষাগত যোগ্যতা ন্যূনতম এসএসসি পাস। ২।  লাইসেন্স দেওয়ার আগে ৬ মাসের পেশাগত ও মানবিক বিষয়ে সিলেবাসভিত্তিক কোর্স। ৩।  সড়কে ভারী-মাঝারি-হালকা, এই মান ও গতি অনুযায়ী আলাদা লেন করা। ৪।  মান-গতি অনুযায়ী লেন মেনে চলা।  ৫।  চালকদের লাইসেন্স দেওয়ার আগে ডোপটেস্ট করানো। ৬। ফিটনেসবিহীন গাড়ি সড়ক-মহাসড়কে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা।  ৭। ওভারটেকিং না করা এবং দ্রুতগতির গাড়ির সামনে দিয়ে ডান কিংবা বাম দিকে টার্ন না নেওয়া। ৮।  উল্টোদিকে গাড়ি চালানো নিষিদ্ধ করা। ৯।  রাস্তার ওপর পার্কিং না করা।

বর্তমানে গাড়িচালকদের মধ্যে নামেমাত্র সাক্ষর থেকে হয়তো অষ্টম শ্রেণিপর্যন্ত শিক্ষিত রয়েছেন। এসব স্বল্পশিক্ষিত চালক অনেক সময় রোড সাইন, ট্রাফিক সিগন্যাল, গতিরোধ সংক্রান্ত সাইনবোর্ড-বিলবোর্ড পড়তে পারেন না। পড়লেও মর্ম উপলব্ধি করতে ব‌্যর্থ হন। এ কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই—প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা মানুষের অভ্যাস-রুচি-মেজাজ পরিবর্তন ও গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। শিক্ষাহীন ব‌্যক্তি সাধারণত যুক্তি মানতে চান না। তারা নিজের মর্জিমতো চলেন। শিক্ষা মানুষকে যুক্তিবাদী করে তোলে। ন্যায়-অন্যাায়, যৌক্তিক-অযৌক্তি বিষয়ে সচেতন করে। এসব যোগ্যতা অর্জনের জন্যও চালককে ন্যূনতম এসএসসি পাস হওয়া দরকার।

কেবল শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন করলেই হবে না, ড্রাইভিং লাইসেন্সপ্রার্থীদের আবেদনের পর নির্বাচিতদের পেশাগত বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। ওই প্রশিক্ষণ হতে হবে ৬ মাস মেয়াদি সিলেবাসভিত্তিক। এতে অবশ্যই মানবিক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।  এখন প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে—কী থাকবে সেই মানবিক বিষয়ে?

যা থাকবে, তার মধ্যের প্রথমত সড়কে পথচারীর দিকে খেয়াল রাখা। পথচারীর গা-ঘেঁষে গাড়ি চালানো যাবে না। কারও গা-ঘেঁষে গাড়ি চালানোর সময় হর্ন দেওয়া যাবে না। এতে পথচারী হঠাৎ হকচকিত হয়ে চলার ভারসাম্য, হারিয়ে গাড়ির নিচে পড়ে যেতে পারেন। ছিটকে পড়তে পারেন রাস্তার বাইরেও। এ কারণে এই বিষয়ে চালককে সতর্ক থাকতে হবে। সেই সতর্কতা নিছক রোবটিক হলে চলবে না, সেখানে থাকতে হবে মানবিকতাও। 

সহৃদয়-হৃদয়সংবেদনশীলতা। স্বামী বিবেকানন্দের ‘জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর!’ চালকদের মর্মমূলে এই পৌঁছাতে হবে। তাহলে কেবল মানুষ নয়, অন্যাদন্য প্রাণীর প্রতিও তাদের মনে প্রেম জন্মাবে। আর প্রেমিক হৃদয় কখনোই বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে মানুষ কিংবা কোনো প্রাণী হত্যা করতে পারবে না।

পাঠ দিতে হবে, মানুষই যদি না থাকে বেঁচে, তাহলে কিসের পেশা, কিসের চাকরি? তাই আগে মানুষসহ সব ধরনের প্রাণীর প্রতি চালকদের মনে প্রেম জাগাতে হবে।  সেই প্রেমই চালকদের করে তুলবে সংবেদনশীল। 

ছয় মাসের প্রশিক্ষণ শেষে তত্ত্বীয় ১০০ নম্বরের ও ব্যবহারিক ১০০ নম্বরের পরীক্ষা নিতে হবে।  উভয় পরীক্ষায় ন্যূনতম পাসের হার হতে হবে ৮০ নম্বর।  নির্ধারিত নম্বরের চেয়ে এক নম্বর কম পেলেও তাকে লাইসেন্স দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে কর্তৃপক্ষকে।

কেবল চালককে মানবিক ও শিক্ষিত করে তুললেই হবে না, একইসঙ্গে তাদের লাইসেন্স দেওয়ার আগে ডোপটেস্ট করাতে হবে। ডোপটেস্টের রেজাল্ট যদি নেগেটিভ আসে, তবেই লাইসেন্স পাওয়ার জন্যে বিবেচিত হবেন তারা। এছাড়া, লাইসেন্স পাওয়ার পর পেশাগত দায়িত্বপালনের সময়ও তারা মাদক নিচ্ছেন কি না, তার জন্যও প্রতি মাসে একবার ডোপটেস্ট করাতে হবে।  

এর পাশাপাশি সড়ক ব‌্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনতে হবে। হালকা-মাঝারি-ভারী যানবাহনের ধরন ও গতি অনুযায়ী সড়ক-মহাসড়কে অন্তত তিনটি আলাদা লেন তৈরি করতে হবে। নির্দিষ্ট মান-গতির গাড়িগুলোকে স্ব-স্ব লেনে চলতে হবে। কোনোভাবেই লেন পরিবর্তন করা যাবে না। এই নিয়ম মেনে চললে ওভারটেকিংয়ের প্রবণতাও কমে যাবে। আর ওভারটেকিং বন্ধ হলে এক গাড়ি আরেক গাড়িকে পেছন থেকে ধাক্কা দেওয়ারও আশঙ্কা থাকবে না। ফলে দুর্ঘটনার আশঙ্কাও থাকবে না। চালকরা গতি-লেন মেনে চলছেন কি না, তা নিরীক্ষার জন্যে সড়কে নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর বসাতে হবে ওজন ও গতিমাপক যন্ত্র। 

এছাড়া থাকতে হবে সিসি ক্যামেরাও। কেউ নিয়ম লঙ্ঘন করলে শনাক্তকারী স্টেশন থেকে পর্ববর্তী স্টেশনকে সতকর্তবার্তা পাঠাবে। পরবর্তী স্টেশনে দায়ী চালক-হেলপার-সুপারভাইজারকে আটক বিচারের মুখোমুখি করবে। একইসঙ্গে ওই গাড়িও জব্দ করে ডাম্পিং স্টেশনে পাঠাতে হবে। তাহলে চালক-মালিকপক্ষ সবই আইন মানতে বাধ‌্য হবে।

সড়ক দুর্ঘটনার একটি কারণ হলো ফিটনেসবিহীন গাড়ি। এসব গাড়ি রাস্তায় চলতে হঠাৎ মাঝ রাস্তায় বন্ধ হয়ে যেতে পারে, ব্রেকফেল হতে পারে। হয়ও। ব্রেকফেল করে পড়ে যায় খাদে কিংবা খালে। কখনো কখনো রাস্তার পাশের গাছ-বাড়িঘর-দোকানের সঙ্গে ধাক্কা লেগেও প্রাণহানি ঘটায়। তাই সড়ক-মহাসড়কে যেন ফিটনেসবিহীন গাড়ি উঠতে না পারে, সে ব্যাপারে ট্রাফিক পুলিশ ও হাইওয়ে পুলিশকে সতর্ক থাকতে হবে।

সড়ক-মহাসড়কে যেসব কারণে দুর্ঘটনা ঘটে, এর মধ্যে সবচেয়ে দায়ী ওভারটেকিং।  এই ওভারটেকিং দুইভাবে হয়। প্রথমত প্রতিযোগিতামূলক। কিভাবে অন্যকে পেছনে ফেলে নিজে সামনে যাবে, এই ধরনের প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব কাজ করে চালকের মনে। ফলে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালান তিনি।

ওভারটেকিংয়ের দ্বিতীয় কারণ হলো, টার্ন নেওয়া।  এ ক্ষেত্রে যেকোনো দ্রুতগামী গাড়ির পেছন দিক থেকে অন্য গাড়ি টার্ন নিলে দুর্ঘটনার কোনো কারণ থাকে না। কিন্তু অধিকাংশ চালক এই সড়ক-শিষ্টাচার মেনে চলেন না।  তারা টার্ন নেওয়ার সময় সামনের গাড়িকে ওভারটেকিং করে তবেই টার্ন নেন। এতে সোজাপথে চলতে থাকা দ্রুতগামী গাড়ির চালক ঘটনার আকস্মিকতায় ব্রেক কষতে দেরি করে ফেলেন। ফলে ওভারটেকিংরত গাড়িকে ধাক্কা মারেন।  এই ধাক্কা মারার কারণে উভয় গাড়িই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

দুর্ঘটনার আপাতত সবশেষ কারণ হলো—উল্টোদিকে গাড়ি চালানো ও রাস্তার ওপর পার্কিং করা। প্রায় দেখা যায়, সড়কে উল্টোদিক থেকে দ্রুতগতির যান্ত্রিক বাহন ছুটে আসে। এমনকী অযান্ত্রিক বাহনও। এই উল্টোদিক থেকে ছুটে আসা বাহনের সঙ্গেই সাধারণত সোজা পথে চলা দ্রুতগতির যানবাহনের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। আর এতেই ঘটে যত বিপত্তি।  বেঘোরে প্রাণ হারায় অনেকে।  এছাড়া, সড়কের পাশে শপিংমল ও মহাসড়কের পাশে গড়ে বাজারে পার্কিং এখন নিত্যঘটনা। এই পার্কিংয়ের কারণে রাস্তায় একদিকে জ্যামের সৃষ্টি হয়।  অন্যদিকে চলন্ত গাড়ি এসে ধাক্কা দেওয়ার ঘটনাও ঘটে।

উল্লিখিত, নিয়মগুলো সাধারণত চালকরা মেনে চলতে চাইবেন না। এজন‌্য সড়ক-মহাসড়কে নিয়মিত ভ্রাম‌্যমাণ আদালতের অভিযান চালাতে হবে। অভিযানের সময় নিয়মভঙ্গের অভিযোগ পেলে তাৎক্ষণিক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।  এই শাস্তির আওতায় কেবল চালককে আনলে হবে না, সঙ্গে হেল্পার, সুপারভাইজার ও গাড়ির মালিককেও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কারণ, অদক্ষ-অপেশাদার চালক-হেল্পার-সুপারভাইজার নিয়োগ দেওয়া ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তার নামানোর জন‌্য মালিকদের দায়ই বেশি। ফলে মালিকদের শাস্তির আওতার বাইরে রেখে সড়ক নিরাপত্তায় সুশাসন বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। প্রয়োজনে  ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’-কে সংশোধন করে সময়োপযোগী করতে হবে। যুগোপযোগী আইন-বিধিমালা তৈরির পাশাপাশি এর যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ‌্যমেই সড়কে শৃঙ্খলা-নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। ব‌্যত‌্যয়ে সবই কর্মনাস্তি। তাই এ বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে এখনই উদ‌্যোগ নিতে হবে। 

লেখক: কবি-প্রাবন্ধিক-সাংবাদিক