মতামত

মিয়ানমারে সুচির বিজয় কোনো পার্থক্যই তৈরি করবে না

জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা অগ্রাহ্য করে রোহিঙ্গাদের ছাড়াই গত ৮ নভেম্বর মিয়ানমারে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। এতে  ক্ষমতাসীন অং সান সুচির দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) অবারও জয়ী হয়েছে। নির্বাচনে অং সান সুচি জয়ী হবেন বলে বিশ্লেষকগণ পূর্বেই মত প্রকাশ করেছিলেন। যদিও তথ্যপ্রবাহের বিধি-নিষেধ থাকায় নির্বাচনের সার্বিক চিত্র জানার সুযোগ সীমিত। এনএলডি মুখপাত্র মিয়ো নিয়ন্ত বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছেন সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় ৩২২টি সংসদীয় আসন তারা পেয়েছেন। তবে, সংঘাত কবলিত রাখাইন রাজ্যে হেরেছে দলটি। নির্বাচনের ফল নিয়ে সেনাবাহিনী সমর্থিত দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি তাৎক্ষণিকভাবে মন্তব্য করেনি।

তবে নির্বাচনে যারাই জয়লাভ করুক না কেন মিয়ানমারে সামরিক বাহিনীর প্রভাব আগের মতোই থাকবে। ২০১৫ সালের নির্বাচনে ত্রুটি থাকলেও সামরিক শাসন-পরবর্তী প্রথম নির্বাচন হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়েছিল। এবারের নির্বাচন ২০১৫ সালের চেয়েও ত্রুটিপূর্ণ হয়েছে। সংঘাতের আশঙ্কায় সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় নির্বাচন বাতিল করা হয়েছে। বার্মা ক্যাম্পেইন ইউকে নামে একটি সংগঠন অভিযোগ করে বলেছে, অং সান সুচির সরকার নির্বাচনের প্রাক্কালে ২২৯ জন রাজনীতিককে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠিয়েছে। ৫৮৪ জন রাজবন্দী বর্তমানে মিয়ানমারের কারাগারে বিচারের অপেক্ষায় আছেন। এর বাইরে এক লাখ ত্রিশ হাজারের মতো রোহিঙ্গা মিয়ানমারের বন্দী শিবিরে আটকে রাখা হয়েছে যারা কেউই ভোট দিতে পারেননি। এই ধরনের একটি নির্বাচন আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পারে না। 

এদিকে রোহিঙ্গাদের ওপর ‘জেনোসাইড’ চালানোর অভিযোগে নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগের আন্তর্জাতিক ন্যায় বিচার আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা চলছে। গত জানুয়ারি মাসে আইসিজে তার অর্ন্তবর্তী আদেশে মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে গণহত্যা থেকে সুরক্ষার উদ্যোগ নিতে নির্দেশনা দিয়েছিল। মিয়ানমারে ভোটাধিকার, নাগরিকত্বসহ সব অধিকার কেড়ে নেওয়ার পর ‘নির্মূল অভিযানের’ নামে দশ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন-নিপীড়নের মাধ্যমে তাদের নিজ দেশ ছাড়তে বাধ্য করাকে পরিকল্পিত গণহত্যা হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে আন্তর্জাতিক আদালতে রুজু করা মামলায়। রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ার বিষয়টি আদালত তার আদেশের লঙ্ঘন হিসেবেই বিবেচনা করছে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বড় একটি অংশ রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়ানোর পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে চাপে রেখেছে। এই চাপ আরও বাড়বে বলে কূটনৈতিক মহল ধারণা করছে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পশ্চিমাদের চোখে এ সময় গণতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে পরিচিত সুচি এখন আর আগের অবস্থানে নেই। কারণ তিনি রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর নৃশংসতার কোনো ব্যবস্থা নেননি। ফলে এই নির্বাচন নিয়ে তেমন কোনো উচ্ছ্বাস ছিল না। তা সত্ত্বেও এই নির্বাচন মিয়ানমারের রাজনৈতিক পরিবর্তন ও অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের একটি পরীক্ষা।

এনএলডি গতবার ক্ষমতায় এসে ঘোষণা করেছিল- তারা তিনটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করবে। একটি জাতীয় সমন্বয়, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সাংবিধানিক পরিবর্তন। জাতীয় সমন্বয় সাধন কাজে অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে সামান্যই। বেশির ভাগ লোকের কাছেই ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সাংবিধানিক সংশোধন সন্তোষজনক মনে হচ্ছে না। জাতিগত রাজনৈতিক দলগুলো ও এনএলডির মধ্যে লড়াই আরো তীব্র হয়েছে। পাশ্চাত্যের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক হ্রাসের ফলে সৃষ্ট চাপ হ্রাস করতে এনএলডি সরকার চীন, ভারত, জাপান ও অন্যান্য এশিয়ান প্রতিবেশীর সঙ্গে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা জোরদার করেছে। বিভিন্ন প্রকল্পে তারা সাহায্য, সহযোগিতা পেতে সক্ষম হয়েছে। বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছে। যদিও দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অবস্থা মোটেই স্থিতিশীল নয়। এবারও সুচিকে এই অবস্থা সামাল দিতে হবে।  

এবারের নির্বাচনে স্টেট এবং কেন্দ্রীয় সরকারের দুই কক্ষ মিলে ১,১১৭ জন প্রার্থী বৈধতা পেয়েছেন। রাখাইন অঞ্চলে রোহিঙ্গা বংশোদ্ভূত কেউ নির্বাচন করার সুযোগ পাননি। নাগরিকত্বের প্রশ্নে বাতিল করা হয়েছে। মূল দুটি দলই সংখ্যালঘু মুসলমান প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়নি। ছোট কিছু দল দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মোট ছয়জন মুসলমান প্রার্থীকে মনোনয়ন দিয়েছে। রাখাইনের অন্যতম জনপ্রিয় দল আরাকান ন্যাশনাল পার্টি ( এ এনপি)। উত্তর রাখাইন ও সিতওয়ে অঞ্চলে তাদের প্রভাব রয়েছে এবং গত নির্বাচনে এনএলডিকে প্রাদেশিক পরিষদে পরাজিত করেছিল তারা। এবারও এনএলডি রাখাইনে পরাজিত হয়েছে।

সেনাবাহিনীর সমর্থন ছাড়া বড় ধরনের কোনো পদক্ষেপ নেওয়া মিয়ানমার সরকারের পক্ষে সম্ভব হবে না। এ বাস্তবতায় মিয়ানমারের সংবিধানে কোনো পরিবর্তনও সম্ভব নয়। পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন ৭৫ শতাংশের সমর্থন। সুতরাং বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই নির্বাচন সে দেশে তেমন কোনো প্রভাব ফেলবে না। অথচ একটি নির্বাচন দেশে ও আন্তর্জাতিক মহলে এক ধরনের সম্ভাবনা তৈরি করে, সবাই আশা করে নতুন সরকার পরিবর্তন নিয়ে আসবে। গত নির্বাচনে অং সান সুচির দল বিজয় লাভ করলেও আইনের কারণে অর্থাৎ তার স্বামী বিদেশী হওয়ায় তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি। তবে স্টেট কাউন্সিলে পদ সৃষ্টির মাধ্যমে তিনি ডি ফ্যাক্টো সরকার প্রধান ছিলেন। এবারও সুচিই থাকবেন কার্যত মিয়ানমারের সরকারপ্রধান। কিন্তু তিনি কী সত্যিই রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান করতে পারবেন? পারবেন কি বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া দশ লাখ রোহিঙ্গাদের তাদের নিজেদের ভিটেমাটিতে ফিরিয়ে নিতে? যদি তা না পারেন তাহলে এই বিজয় কোনো পার্থক্যই তৈরি করবে না।

লেখক: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক