মতামত

বাস্তবতাকে মাপকাঠি করেই অভিনয় করেছেন সৌমিত্র

কলকাতার সাংবাদিক বন্ধু স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায় গত বছরের ঠিক এই সময় ঢাকায় এক আড্ডায় কথাপ্রসঙ্গে জানালেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ক্যানসারে আক্রান্ত। কলকাতার ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকার অবসরপ্রাপ্ত সাংবাদিক স্বপনকে বললাম পরেরবার কলকাতা গেলে তাঁর সঙ্গে দেখা করব। স্বপনের সঙ্গে তাঁর রয়েছে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। কলকাতার টিভি পর্দায় তাঁকে প্রায় নিয়মিত দেখা যায়; পুরনো চলচ্চিত্রে এবং নতুন টিভি ধারাবাহিক নাটকে। তাঁর ৮৫ বছরের অবয়বের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে ‘অপুর সংসার’-এর সৌমিত্রকে মেলানো যায় না। কিন্তু একটু গভীরভাবে অভিনয়ের ধারা লক্ষ্য করলে বুঝা যায়- হ্যাঁ এ তো সৌমিত্রই!

বাংলা সিনেমার এই মহীরুহ উত্তমকুমার আর বিশ্বজিৎ-এর বাণিজ্যিক ছবির লাখো দর্শকের কাছে ক্রমে অভিনয় ধারায় নতুন রূপকার হিসেবে প্রিয় হয়ে ওঠেন। এই ‘লো-টোন এক্সপ্রেসিভ’ অভিনয় দিয়েই তিনি কলকাতার বাংলা সিনেমায় ‘নায়কের’ একটি আলাদা আসন স্থায়ী করে নিয়েছেন।

তাঁর মৃত্যু সংবাদ টিভিতে দেখে আবার মনে পড়ল ৫০ বছর আগের একটি সন্ধ্যার স্মৃতি। ১৯৭১ সালে কলকাতায় কলেজ স্ট্রীটের কফি হাউজে প্রথম দেখা হয়েছিল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। কথা হয়েছিল কিছুক্ষণ। সবটা এখন মেন নেই। চোখে ভাসে স্বপন পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর তিনি সামনের চেয়ারে বসতে বলে কফি অফার করলেন। আলাপের এক পর্যায়ে বলেছিলেন, “আমরা একই ভাষায় কথা বলি অথচ কত দূরে অবস্থান করি। রাজনীতি আর রাষ্ট্রনীতি এমন করেছে।” এই সচেতনতা তাঁর মধ্যে ছিল বরাবর। তাই তিনি শুধু সিনেমার প্রিয় অভিনেতা নন, তিনি সংস্কৃতিকর্মী, লেখক, সম্পাদক, একইসঙ্গে নট ও নাট্যকার, বাচিক শিল্পী, গায়ক, চিত্রশিল্পী এবং কবি।

বিভিন্ন লেখায় নিজের জীবনের কথা বলেছেন। অভিনয় জীবনের শুরুটা এভাবেই বর্ণনা করেছেন তিনি: ‘বাবা সংস্কৃতিমনা মানুষ ছিলেন। অভিনয় ও আবৃত্তির প্রতি ঝোঁক ছিল। কিন্তু তখন অভিনয়কে পেশা হিসেবে নেওয়ার প্রশ্ন ওঠেনি। সে কারণেই হয়তো বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে ওকালতি পেশায় নিযুক্ত ছিলেন। কিন্তু একান্ত নিমগ্নতায় বাবাকে অভিনয় আর আবৃত্তিটাই করতে দেখেছি। এ সব দেখেই এক সময় অভিনয় ও আবৃত্তির প্রতি আগ্রহ বাড়ে আমার।’

কবিতার একাধিক গ্রন্থ রয়েছে তাঁর। ‘দ্রষ্টা’ গ্রন্থের ভূমিকায় কবি শঙ্ঘ ঘোষ লিখেছেন: ‘সৌমিত্র নিজে যে দীর্ঘকাল অন্তর্নিবিষ্টভাবে কবিতা লিখে চলেছেন, তাঁর অভিনয় ক্ষমতার আড়ালে সে কথাটা অনেকখানি চাপা পড়ে গেছে।’

চলচ্চিত্রে অভিনয়ের শুরুটাও খুব মসৃণ ছিল না। ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকা লিখেছে: ‘‘১৯৫৬ সালে সত্যজিৎ যখন ‘অপরাজিত’ বানাচ্ছেন, তখন সৌমিত্রের ২০ বছর। আলাপ হলেও তখন তাঁর মধ্যে অপুর ‘কৈশোর’ দেখতে পাননি সত্যজিৎ। কিন্তু দু’বছর পর ‘অপুর সংসার’-এ সত্যজিতের ‘অপু’ হলেন তিনি। ‘জলসাঘর’-এর শ্যুটিংয়ে ক্লান্ত বিশ্বম্ভর রায়ের সামনে দাঁড় করিয়ে সটান বললেন সত্যজিৎ, ‘এই হলো সৌমিত্র চ্যাটার্জি। আমার পরের ছবির অপু।’ তাঁর চেহারা সম্পর্কে তখন এতটাই মুগ্ধতা ছিল সত্যজিতের; বলেছিলেন, ‘তরুণ বয়সের রবীন্দ্রনাথ।’’ আর সৌমিত্র? তিনি বলেছেন, ‘আমি তখন অল ইন্ডিয়া রেডিওতেও কাজ করি। অভিনয়ের প্রতি বেশ আগ্রহী। তা জেনেই তিনি আমাকে ডাকলেন। গেলাম। সত্যজিৎ বাবু আমাকে দেখামাত্র বললেন, ‘আরে না-না! তোমার বয়সটা একটু বেশি মনে হচ্ছে।’ প্রথমে না বললেও পরে নিজেই আগ্রহভরে নিলেন। সুধীজনের আগ্রহ ও দর্শকপ্রিয়তা পাওয়ায় ছবিটির পর তিনি আবার পরবর্তী সিনেমা নির্মাণের কাজে হাত দেন। সেটির নাম ‘অপুর সংসার’। আমার সঙ্গে কোনওরকম কথা না বলেই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, অপুর সংসারে আমার কাজ করতে হবে। এভাবেই শুরু। তারপর একের পর এক হাঁটা অভিনয় জগতে।’ একে একে সত্যজিৎ রায়ের ১৪টি ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি।

সব মিলিয়ে প্রায় আড়াইশোরও বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন সৌমিত্র। অনেকেরই মনে আছে ‘সাত পাকে বাঁধা’, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘ঝিন্দের বন্দি’, ‘একটি জীবন’, ‘কোনি’, ‘হীরক রাজার দেশে’, ‘দত্তা’। নায়ক হিসেবে তিনি তাঁর সমসাময়িক সব নায়িকার বিপরীতেই সাফল্য পেয়েছেন। সম্ভবত তাই তেমন করে কারও সঙ্গে ‘জুটি’ গড়ে ওঠেনি। সুচিত্রা সেনের সঙ্গে ‘সাত পাকে বাঁধা’ এবং ‘দত্তা’ ছবিতে সৌমিত্র হয়ে উঠেছিলেন অনন্য। তেমনই সাবিত্রী, সুপ্রিয়া, অপর্ণারাও সৌমিত্রের সঙ্গে মিশেছেন অবলীলায়।

২০০৪ সালে ‘পদ্মভূষণ’, ২০০৬ সালে ‘পদক্ষেপ’ ছবিতে জাতীয় পুরস্কারে সম্মানিত সৌমিত্র ২০১১ সালে ভারতীয় সিনেমার সর্বোচ্চ সম্মান ‘দাদাসাহেব ফালকে’ পান। ঘটনাচক্রে, তার ছ’বছর পর ২০১৮ সালে তিনি ভূষিত হন ফরাসি সরকারের সেরা নাগরিক সম্মান ‘লিজিয়ঁ দ’নর’-এ। তাঁর মানসপিতা সত্যজিতের ঠিক ৩০ বছর পর।

২০১৯ সালে ‘সাঁঝবাতি’ হয়ে রইল মুক্তিপ্রাপ্ত তাঁর শেষ পূর্ণাঙ্গ ছবি

ভারতের দুজন বিশিষ্ট চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব অপর্ণা সেন ও শর্মিলা ঠাকুরের প্রথম ছবির নায়ক সৌমিত্র। তারা স্মৃতিচারণ করেছেন এভাবে। শর্মিলা বলেছেন, ‘সৌমিত্রর সঙ্গে আউটডোরের শ্যুটিংয়ের অভিজ্ঞতার একটা বড় স্মৃতি হলো ওঁর গান। জনসমক্ষে পারফর্ম করতেন না। কিন্তু নিয়মিত গলা সাধা বজায় রাখতেন। ‘আবার অরণ্যে’-র শ্যুটিংয়ের সময়েও দেখেছি ভোরবেলা উঠে ব্যায়াম করছেন। সেই সঙ্গে চলছে গলা সাধা। গানটাও যেন ব্যায়াম করারই অঙ্গ। আমার মায়ের সঙ্গেও সৌমিত্র-দীপাবৌদির খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। মা প্রায়ই নিমন্ত্রিত হতেন ওঁদের পার্টিতে। মায়ের কাছ থেকেও সৌমিত্রর গল্প শুনতাম। সৌমিত্র বড় মাপের অভিনেতা। খুব বড় মাপের অভিনেতা। এ কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু শুধু তো অভিনয় নয়। তাঁর লেখালেখি, তাঁর কবিতা, কাব্যপাঠ, বিপুল পড়াশোনা আর সব কিছুকে ছাপিয়ে তাঁর একটা শিশুর মতো মন ছিল। শিশুর মতো বিস্ময়াবিষ্ট হতে পারতেন ওই বয়সেও। শিশুর মতোই একটা হাসি ছিল। সব মিলিয়ে এমন একটা মানুষ, যাঁকে ঘিরে বিস্ময় যেন ফুরোয় না। মনে হয়, বিভূতিভূষণের অপুর মতোই ছিলেন সৌমিত্র। বিস্মিত হতে জানতেন। বিস্মিত করতে জানতেন।’

অপর্ণা বললেন, ‘সত্যজিৎ রায়ের 'সমাপ্তি' ছবির এ বার ৫৯ বছর। এতগুলো বছর পরে অমূল্য-মৃণ্ময়ী জুটি আবার ফিরেছিল সুমন ঘোষের 'বসু পরিবার'-এর হাত ধরে। এর পরে আমরা করেছি ‘বহমান’। আসলে তাঁর মৃত্যু সংবাদ শোনার পরে কিছুতেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছিল না। খুব আশা করেছিলাম, উনি যুদ্ধে জিতে ফিরবেন। মানিককাকা অনেক বছর আগেই চলে গিয়েছেন। তার পর একে একে চলে গেলেন আমার মা-বাবা, মৃণালকাকা। এবার সৌমিত্র-ও। কাকে যেন বলছিলাম, আমার চেনা জগৎটা আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে। মাথার উপর থেকে বিশাল ছাতাটা হঠাৎ করে সরে গেল।’

পরিচালক শিবপ্রসাদ লিখেছেন, ‘১৪ ডিসেম্বর ২০১২, প্রথম শ্যুটিং করেছিলাম ওঁর সঙ্গে। ব্যস, সেই থেকে আমার সব শীতকাল আর ডিসেম্বরের ওপর অধিকার যেন ওঁরই হয়ে গেল। ২০১৪-র ডিসেম্বর ‘বেলাশেষে’। ২০১৫ ‘প্রাক্তন’। ২০১৬ ‘পোস্ত’। ২০১৭ ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’। ২০১৮ ‘বেলাশুরু’। ২০১৯ সালে শ্যুটিং করিনি। ২০২০-র ১৪ ডিসেম্বর থেকে ডেট চেয়েছিলাম দু’মাসের জন্য। বলেছিলেন, ‘থিয়েটারের জন্য আলাদা করে ডেটগুলো সরিয়ে রাখতে হবে। বাকিটা অ্যাডজাস্ট করে নেব।’ কথা ছিল, বড় একটা কাজ শুরু হবে। আপনার মনে পড়ছে স্যর, আপনাকে বলতাম, একজনকে আপনি ১৪টা ছবির সময় দিয়েছেন। আমাদের অন্তত ১০টা দেবেন। আপনি বলেছিলেন, ‘পারব নাকি! আরও ৫ বছর মানে ৯০। অসম্ভব! তখন হয়তো স্মৃতিই কাজ করবে না।’ কিন্তু এ-ও বলেছিলেন, ‘প্রম্পট করে দিলে সংলাপ কোনওদিন ভুলব না। ওটা শিশিরবাবুর থেকে পাওয়া।’ ৫টা ছবির ডেট বাকি আছে স্যার। আপনার দেখাদেখি আমিও লাল ডায়েরি রাখি এখন। কিন্তু আমার ডায়েরিতে ডিসেম্বরের ডেট এবার ফাঁকা। কবে থেকে রাখব ডেট স্যর? থিয়েটারের ডেটগুলো আলাদা করে রাখব। কথা দিচ্ছি।’

তিনটি উদ্ধৃতি কিছুটা দীর্ঘ হয়ে গেল। তবে এই তিন ব্যক্তির স্মৃতিভাষ্যে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যেন পূর্ণাঙ্গ রূপে আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠেন। সৌমিত্র ‘অপুর ডায়েরি’-তে লেখেন: ‘বাস্তবতাকে মাপকাঠি করে অভিনয়ের ওই যে চেষ্টা, ওটাই অভিনয়ের আসল অভিপ্রায়’। তাঁর একাডেমিক ইন্টেলিজেন্সের জন্যই তিনি আমাদের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

বি.দ্র.: উদ্ধৃতিগুলো ভারতীয় পত্রিকা থেকে নেওয়া