মতামত

আমাদের কেন আইন মানতেই হবে?

‘ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টকে কাছে পেলে তাঁকে আমি হত্যা করে ফাঁসির মঞ্চে যেতে চাই।’ সম্প্রতি ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রকে হত্যার ইচ্ছা প্রকাশ করে বক্তব্য দিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ-৩ (সোনারগাঁ) আসনের সাংসদ লিয়াকত হোসেন (প্রথম আলো ০৪.১১.২০২০)। এরপরই তিনি বলেছেন, ‘বক্তব্যটি সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত। আমার এ বক্তব্যে যেকোনো শাস্তি হলে আমি মাথা পেতে নেব।’

একটি দেশের জনপ্রতিনিধির বক্তব্য, আচরণ কেমন হবে তার অবশ্যই একটা সঠিক মানদণ্ড বা দিকনির্দেশনা আছে। সেই নির্দেশনা সবাই মানবেন এটাই শিষ্টাচার। লিয়াকত হোসেন কেন সেই নির্দেশনা মানলেন না, তা আসলে আলোচনার বিষয় নয়। আলোচনার বিষয় হলো, যদি একটি দেশের জনপ্রতিনিধির বক্তব্য এমন হয়, তাহলে দেশের সাধারণ জনগণের বক্তব্য কেমন হবে তা সহজেই অনুমেয়।

বক্তব্য দিয়ে লিয়াকত কি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হতে চেয়েছেন? না। তবে কি বিশেষ কোনো মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন? না। লিয়াকত নিজের ভেতরের রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। এই বক্তব্য থেকে তার চিন্তাভাবনা সম্পর্কে জানা যায়। বোঝা যায় তার মানসিকতা। এই বক্তব্য থেকে আরো বোঝা যায়, সাংসদ লিয়াকত আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নন। অথচ জনপ্রতিনিধিদের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতেই হয়।

২০২০ সালের ৩০ অক্টোবর লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলায় বুড়িমারী স্থলবন্দরে একটি মসজিদে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে পিটিয়ে ও আগুনে পুড়িয়ে মারা হয় আবু ইউনুস মোহাম্মদ শহীদুন নবী জুয়েলকে। ২০১৯ সালের ২০ জুলাই বাড্ডায় স্কুল প্রাঙ্গণে ছেলেধরা গুজবে তাসলিমা বেগম ওরফে রেনুকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ২০১৯ সালের ২৬ জুন বরগুনার কলেজ রোড এলাকায় দিনের বেলা কয়েকজন যুবক রিফাত শরীফের ওপর ধারালো অস্ত্র দিয়ে হামলা চালায়। পরে রিফাত মারা যায়। ২০১৯ সালের ৬ এপ্রিল ফেনী জেলার সোনাগাজীর মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি টিএসসির সামনে দুর্বৃত্তরা মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা করে। এরপর একে একে হত্যার শিকার হন ব্লগার নীলাদ্রী নিলয়, অনন্ত বিজয় দাশ, ওয়াশিকুর বাবু, প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন। ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর বিএনপি-জামায়াতকর্মী সন্দেহে বিশ্বজিৎকে কুঁপিয়ে হত্যা করা হয়।

এগুলো হলো আলোচিত কয়েকটি ঘটনা। এর বাইরে অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। সবগুলো গণমাধ্যমেও আসেনি। এই ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, নারায়ণগঞ্জ-৩ (সোনারগাঁ) আসনের সাংসদ লিয়াকত হোসেন এবং উল্লিখিত ঘটনাগুলো যারা ঘটিয়েছেন তাদের মানসিকতা অনেকটা কাছাকাছি। প্রশ্ন হলো, এই আলোচিত ঘটনাগুলোর মধ্যে কতটির বিচার হয়েছে? উত্তর নিশ্চয়ই আপনাদের জানা। পরিসংখ্যান বলছে ২০১১-২০১৮ পর্যন্ত গণপিটুনিতে বাংলাদেশে প্রায় ৮০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে, যেগুলোর কোনোটায় ছেলেধরা বা ডাকাত সন্দেহে, আবার কোনো ঘটনায় সামান্য চোর সন্দেহেও পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। (বিবিসি, ০৭.১১.২০২০)

২.

আইন মেনে চলা বা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া বা আইন নিজের হাতে তুলে না নেওয়ার জন্য বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে বিভিন্ন সচেতনামূলক প্রচার, প্রচারণা চালানো হয়। কখনো কখনো আবার রাস্তায় মাইকিং ও কাগজ বিলি করা হয়। এটি একটি চলমান কর্মকাণ্ড। এরপরও মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে। কেন? এর মূল কারণ হলো, এ দেশের প্রায় প্রত্যেকেই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নন। শুনতে বিস্ময় লাগছে! বিস্ময়ের কোনো কারণ নেই। সবচেয়ে ভয়াবহ হলো, অধিকাংশ মানুষ আইনের প্রতি ভরসা রাখতে পারেন না। ফলে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বা আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে।

বাংলাদেশে গণপিটুনিতে হত্যার ক্ষেত্রে খুব কমই বিচার হয়। গত তিন বছরে গণপিটুনির শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন ১৫৪ জন। কিন্তু এ নিয়ে দায়ের করা কোনো মামলারই উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই। নতুন করে আবার গণপিটুনিতে হত্যার প্রবণতা বাড়ছে (ডয়চে ভেলে, ১৩.০১.২০২০)। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ সালে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ৩৯ জন। ২০১৯ সালে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ৬৫ জন। ২০১৯ সালে গণপিটুনিতে সবচেয়ে বেশি হত্যার ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রামে। ২৫ জন মারা গিয়েছেন। ঢাকায় নিহত হয়েছেন ২২ জন। ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত গণপিটুনিতে অন্তত ৩০জন নিহত হয়েছেন।

মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, একজন মানুষের আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু বিচার না হওয়ার কারণে এ ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। এটা খুবই উদ্বেগের বিষয়। আর মব সাইকোলজিতে যেটা হয় সেটা হচ্ছে- সবাই মনে করে এত লোক যেহেতু জড়িত, সেজন্য পুরো দায়িত্ব কারো একার ঘাড়ে আসবে না। কোনো একজন ব্যক্তি যখন এককভাবে কোনো অপরাধ করতে যায়, তখন সে জানে এজন্য তাকেই দায়িত্ব নিতে হবে। কিন্তু মব সাইকোলজির ক্ষেত্রে সেটা হয় না।

২০২০ সালের অক্টোবর মাসে সিলেটের মহানগর পুলিশের বন্দরবাজার ফাঁড়িতে রায়হান মারা যান। হত্যার প্রধান অভিযুক্ত এসআই আকবর। ময়নাতদন্তে তার শরীরে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যাওয়ার কথা জানায় মামলার তদন্তকারী সংস্থা (বিবিসি, ০৯.১১.২০২০)। প্রশ্ন হলো, এসআই আকবর কি আইন মেনেছে বা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন? নিশ্চয় নয়। এরকম আরো এস আই আকবর এদেশে রয়েছেন। তাদের দ্বারা সাধারণ মানুষ অত্যাচারের শিকার হচ্ছেন। শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাই নন, আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে অন্য ধর্মের উপাসনালয় এবং বাড়িঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে একশ্রেণীর ধর্মান্ধ মানুষ। বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের তথ্যানুযায়ী, ২০২০ সালের জানুয়ারি-জুন পর্যন্ত দেশে ৫৯২টি সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন ৭২ জন, আহত হয়েছেন ৫১২ জন, বসত বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে ৪৮৯টি পরিবার, উচ্ছেদের চেষ্টা করা হয়েছে ১ হাজার ৪৬০ টি পরিবারকে, উচ্ছেদের হুমকি পেয়েছে ১ হাজার ৮০১ পরিবার।

উল্লিখিত নির্যাতনের ঘটনার পেছনে যারা জড়িত তারা প্রত্যেকেই আইন অমান্যকারী। প্রশ্ন হলো, এই ধরনের আইন অমান্যকারী কি একদিনে তৈরি হয়েছে? নিশ্চয়ই নয়। দিনের পর দিন আইন অমান্যকারীদের শাস্তি দেওয়া হয় না দেখে তারা আইন ভঙ্গ করতে বা আইন নিজের হাতে তুলে নিতে সাহস পাচ্ছে। মানুষকে সুষ্ঠু, স্বাধীন এবং সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনার জন্য যে নিয়ম-কানুন তৈরি করা হয় তাই আইন। আইন হলো নিয়মের একটি পদ্ধতি, যাকে নাগরিক বাধ্যতা, রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সমাজের ভিত্তি নির্মাণ করতে ও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কার্যকরী করতে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ৩৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিক দার্শনিক অ্যারিষ্টটল বলেছিলেন, ‘আইনের শাসন যে কোনো ব্যক্তি শাসনের চেয়ে ভালো।’ অ্যারিষ্টটল সুশাসন ফিরিতে আনতে এই কথা বলেছিলেন। দেশ থেকে আইনের শাসন চলে গেলে দেশে অপরাধ বাড়ে। যেমনটা এখন হয়েছে। তবে এর থেকে মুক্তি পাওয়ার একটা পথ হলো আইন মেনে চলা। সুতরাং যাই ঘটুক না কেন আমাদের আইন মানতেই হবে। এবং কোনো অবস্থায় আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া যাবে না।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক