মতামত

জনপ্রিয় সাহিত্য কেন টিভি সিরিজে রূপান্তরিত হচ্ছে?

ব্যাপারটা যে একেবারেই নতুন তা নয়। জনপ্রিয় লেখকদের গল্প-উপন্যাস থেকে টেলিভিশন নাটক অথবা চলচ্চিত্র তৈরি করার প্রচলন বেশ পুরনো। শুধু শেক্সপিয়রের ম্যাকবেথের দিকে তাকালেই দেখতে পাবো এই বিখ্যাত ছোটগল্প (প্রথমাবস্থায় ছোটগল্প হিসেবেই লিখেছিলেন, পরে মঞ্চনাটক) নিয়ে নির্বাক চলচ্চিত্রের যুগেই দুটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছিল। প্রথমটি ১৯০৮ সালে নির্মাণ করেছিলেন মার্কিন পরিচালক স্টুয়ার্ট ব্ল্যাকটন। এরপর ১৯১৬ সালে নির্মাণ করেন আরেক মার্কিন পরিচালক জন এমারসন। 

সবাক চলচ্চিত্রের যুগেও ‘ম্যাকবেথ’ নিয়ে অসংখ্য সিনেমা নির্মিত হয়েছে। বিশ্বখ্যাত পরিচালক রোমান পোলানস্কি থেকে শুরু করে ওরসান ওয়েলস, আর্থার অ্যালান সেইডেলম্যান, জেরেমি ফ্রিসটন, ব্রায়ান ব্লেসড, জেফরি রাইট, জাস্টিন কার্জল প্রমুখ পরিচালক নির্মাণ করেছেন ম্যাকবেথ নিয়ে সিনেমা। এমনকি ম্যাকবেথ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন ভারতীয় পরিচালক বিশাল ভরদ্বাজ। তিনি অবশ্য নাম দিয়েছেন ‘মকবুল’।

এখন টেলিভিশন সিরিজের যুগ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ওয়েব সিরিজের ঢেউ। সেই ঢেউয়ে টালমাটাল বিশ্ব। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, এখন যেসব বই বেস্ট সেলার হচ্ছে, সেসব বই নিয়েই নির্মিত হচ্ছে টেলিভিশন সিরিজ কিংবা ওয়েব সিরিজ। এই ট্রেন্ডে শামিল হয়েছে এইচবিও, নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন প্রাইম থেকে শুরু করে বিবিসি টেলিভিশন পর্যন্ত। নিউইয়র্ক টাইমস বেস্ট সেলার বইয়ের তালিকায় উনিশবার স্থান পেয়েছে জুলি পটিংগারের লেখা ‘ব্রিজারটন’ উপন্যাসটি। এটি নিয়ে সিরিজ নির্মাণ করেছে নেটফ্লিক্স। ভারতীয় লেখক বিক্রম চন্দ্রের জনপ্রিয় উপন্যাস ‘সেক্রেড গেমস’ নিয়েও ওয়েব সিরিজ বানিয়েছে নেটফ্লিক্স। অ্যামাজন প্রাইম নির্মাণ করেছে মার্কিন ইতিহাসবিদ ফিলিপ কে ডিকের তুমুল জনপ্রিয় উপন্যাস ‘দ্য ম্যান ইন দ্য হাই ক্যাসল’ নিয়ে সিরিজ।

বাংলাদেশের গায়েও লেগেছে ওয়েব সিরিজ নির্মাণের ঢেউ। তরুণ নির্মাতারা মনোযোগী হচ্ছেন ওয়েব সিরিজ নির্মাণের দিকে। সৈয়দ আহমেদ শাওকী নির্মিত ‘তাকদির’ দর্শকদের মধ্যে বেশ সাড়া ফেলেছে। পরিচালক এটি মুক্তি দিয়েছেন ওটিটি প্ল্যাটফর্ম হইচইয়ে। এছাড়া রায়হান রাফি নির্মিত ওয়েব ফিল্ম ‘জানোয়ার’, সঞ্জয় সমাদ্দার নির্মিত ‘ট্রল’ ও আশফাক নিপুণের ‘কষ্টনীড়’ বেশ প্রশংসিত হয়েছে। প্রথম দুটি ওয়েব ফিল্মই দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশি ওটিটি প্ল্যাটফর্ম সিনেমাটিকে। অন্যদিকে ‘কষ্টনীড়’ দেখা যাচ্ছে ভারতীয় ওটিটি প্ল্যাটফর্ম হইচইয়ে। তরুণ নির্মাতাদের এই প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন জনপ্রিয় নির্মাতা মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী। তিনি বলেছেন, সৈয়দ শাওকীর ‘তকদীর’, রায়হান রাফির ‘জানোয়ার’, আশফাক নিপুনের ‘কষ্টনীড়’ এরকম আরো অনেকগুলো কাজ আমাদের তরুণ ফিল্মমেকারদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা আর আস্থাকেই আরো পোক্ত করেছে। আই ফিল হ্যাপি অ্যান্ড ইলেটেড! 

একই ধরনের প্রশংসা করেছেন আরেক নির্মাতা অরণ্য আনোয়ার। তিনি ‘জানোয়ার’ দেখে বলেছেন, আচ্ছা, আমাদের টেলিভিশনের অনুষ্ঠান বিভাগ কি এখান থেকে কিছু শিখবে?

তবে বাংলাদেশে জনপ্রিয় বইয়ের গল্প থেকে ওয়েব সিরিজ এখনো কেউ তৈরি করেননি। কলকাতার পরিচালক সৃজিত অবশ্য বাংলাদেশের সাহিত্যিক নাজিম উদ্দিনের একটি জনপ্রিয় উপন্যাস ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি’কে ওয়েব সিরিজে রূপ দেবার ঘোষণা দিয়েছেন। প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশের পরিচালকরা কেন নন? তারা কী ভালো গল্প খুঁজে পাচ্ছেন না? আমরা তো দেখছি এই সময়ের কোনো কোনো তরুণ লেখক প্রায় হুমায়ূন আহমেদের মতো জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। তাদের বই হাজার হাজার কপি বিক্রি হচ্ছে। সেসব বইয়ের গল্প নিয়ে কেন ওয়েব সিরিজ কিংবা টিভি সিরিজ তৈরি হচ্ছে না? এখনো তৈরি না হলেও অচিরেই হয়তো কোনো নির্মাতা তৈরি করে ফেলবেন। কারণ বৈশ্বিক ট্রেন্ড যেদিকে যাচ্ছে সেদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখার কোনো উপায় নেই। কিন্তু বৈশ্বিক প্রবণতা কেন এমন হলো সেটা নিয়ে ভাবছেন বিশ্বের অনেক চিন্তক ও গবেষক। সম্প্রতি কানাডার কুইন্স ইউনিভার্সিটির জার্নালে এ সংক্রান্ত একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে কবি ও সাংবাদিক আলিশা মোহামেদ লিখেছেন, এই প্রবণতার সঙ্গে সাহিত্যের কোনো যোগ নেই, বরং যোগ রয়েছে অর্থ-কড়ির। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো সেই বইকেই বেছে নিচ্ছে পর্দায় দেখানোর জন্য যে বইগুলোর গল্প ইতোমধ্যে জনপ্রিয় হয়েছে। অর্থাৎ এটা ঝুঁকিহীন অর্থলগ্নির একটি কৌশলমাত্র।

কথা সত্য। দেখুন, টিভি সিরিজের জন্য এইচবিও চ্যানেল বেছে নিয়েছে লিয়েন মরিয়ার্টির ‘বিগ লিটল লাইস’ ও ব্রিথ বেনেথের ‘দি ভ্যানিশিং হাফ’ উপন্যাস দুটি। অপরদিকে হুলু টেলিভিশন নেটওয়ার্ক নিয়েছে সেলেস্ট এনজির ‘লিটল ফায়ার্স এভরিহয়্যার’ উপন্যাসটিকে। এই উপন্যাসগুলো ইতোমধ্যেই বিশ্বব্যাপী তুমুল জনপ্রিয়। ফলে এই গল্পগুলোর পেছনে অর্থ লগ্নি করে সিরিজ নির্মাণ করার মধ্যে কোনো ঝুঁকি নেই। কারণ গল্পগুলোর জনপ্রিয়তা প্রমাণিত। বিপুলসংখ্যক মানুষ পর্দায় এই গল্পগুলোর রূপায়ণ দেখতে চাইবে তাতে সন্দেহ নেই।

নতুন যে গল্প এখনও মানুষ জানে না, সেই গল্প দর্শকের সামনে নিয়ে আসার মধ্যে এক ধরনের ঝুঁকি থেকেই যায়। কারণ গল্পটা মানুষ গ্রহণ করবে কিনা তা অনিশ্চিত। কিন্তু বেস্ট সেলার বইয়ের গল্প নিয়ে এই অনিশ্চয়তা নেই। কারণ গল্পটা ইতোমধ্যেই মানুষ গ্রহণ করেছে। ফলে আলিশা মোহামেদ ভুল বলেননি। এটি সত্যিকার অর্থেই একটি বাণিজ্যিক কৌশল ছাড়া অন্য কিছু নয়।

এতে কী সাহিত্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে? কিছুটা হচ্ছে বৈকি। ওয়েব সিরিজ তৈরির এই প্রবণতা সাহিত্যিককে ভীষণভাবে প্রভাবিত করছে। তিনি যখন একটি উপন্যাস লিখছেন তখন এটিও মাথায় রাখছেন যে পরবর্তীতে উপন্যাসটি নিয়ে যেন ওয়েব সিরিজ কিংবা টেলিভিশন সিরিজ তৈরি করা যায়। কাহিনি বিন্যাসের সময় এই ভাবনা তার মাথায় রাখতে হচ্ছে, সংলাপ রচনার সময় এই ভাবনা তাকে মাথায় রাখতে হচ্ছে, চরিত্র নির্মাণের সময়ও তাকে এই ভাবনা মাথায় রাখতে হচ্ছে। অর্থাৎ লেখালেখির পুরোটা সময় তাকে ভাবতে হচ্ছে গল্পটা সিরিজ উপযোগী হচ্ছে কিনা? এতে সাহিত্য স্বাভাবিকতা হারাচ্ছে। কাহিনি স্বাভাবিক গতি হারাচ্ছে। লেখককে অনেক আরোপিত নাটকীয়তা, আরোপিত দৃশ্য যুক্ত করতে হচ্ছে উপন্যাসের শরীরে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই প্রবণতার মাধ্যমে সাহিত্যিক ক্রমশ স্ক্রিপ্ট রাইটারে পরিণত হচ্ছেন।

স্ক্রিপ্ট রাইটিং নিঃসন্দেহে ছোট কোনো কাজ নয়। কিংবা এটি সাহিত্যের তুলনায় খুব অসৃজনশীল কাজ তা-ও নয়। দুটিই সৃজনশীল মাধ্যম। তবে বুঝতে হবে, সিনেমার পর্দা এবং বইয়ের পাতা যেমন এক নয়, তেমনি উপন্যাস লেখা আর চিত্রনাট্য লেখাও এক নয়। দুটিই সৃজনশীল মাধ্যম বটে, তবে দুটি মাধ্যমের মধ্যে পার্থক্যও বিস্তর। সাহিত্যিকরা যদি এই পার্থক্য অনুধাবন করতে না পারেন, তবে আখেরে তা সাহিত্যের জন্যই ক্ষতি বয়ে আনবে।

তথ্যঋণ: কুইন্স জার্নাল, টিনভয় ওয়েব, ইনডালজ এক্সপ্রেস