মতামত

বঙ্গবন্ধুর তর্জনীর গর্জন

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে যে ভাষণ দেন, বাঙালির ইতিহাসে তা তুলনারহিত। এ বছর এই ঐতিহাসিক ভাষণের ৫০ বছর পূর্ণ হলো। ১৯ মিনিটের অলিখিত ভাষণে তিনি বাংলার মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস যেমন  বর্ণনা করেছেন; অনুরূপ সেখানে পরবর্তী লড়াইয়ের জন্য জনতাকে জাগিয়ে তোলার প্রয়াস ছিল। এক হাজার একশ সাত শব্দে তিনি বাঙালিকে প্রস্তুত করেছেন মুক্তি ও স্বাধীনতার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য। এই ভাষণে তিনি তাঁর প্রিয় জনগণের উদ্দেশ্যে জানিয়েছেন ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা।

৭ মার্চ অকস্মাৎ আমাদের সামনে আসা দিন নয়; বরং বাংলার রাজনৈতিক ধারাবাহিকতায় এক বিশেষ পরিস্থিতিতে তিনি ভাষণ দিয়েছিলেন। ১ মার্চ দুপুর ১টা ০৫ মিনিটে বেতার ভাষণে ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। উল্লেখ্য, তখন আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠক চলছিল। অধিবেশন স্থগিত ঘোষিত হলে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের কাছে কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তিনি জানান যে ৭ মার্চ রেসকোর্সে ভাষণ দিবেন।

৭ মার্চের ভাষণের আগে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চাপ ছিল বঙ্গবন্ধুর ওপর। একই সঙ্গে জনসভাস্থলে উপস্থিত লাখো মানুষের নিরাপত্তাবিধান করাও তাঁর দায়িত্বের অংশ। তিনি জানতেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাঁর প্রতিটি শব্দ বিশ্লেষণ করবে। স্বাধীনতা ঘোষণা করামাত্র তাঁকে ‘বিচ্ছিন্নবাদী’ আখ্যা দিয়ে দেশজুড়ে হত্যা-লুণ্ঠন শুরু করবে। বিচ্ছিন্নবাদী হিসেবে তিনি আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন ও সহায়তা পাবেন না। ত্রিশঙ্কু অবস্থায় বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। সেদিনের স্মৃতিচারণে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বলেন:

‘এখানে আমার মায়ের কথা একটু না বললেই নয়-যখনি আব্বা কোনো বড়ো ভাষণ দিতে যেতেন, কোনো গুরুত্বপূর্ণ কোথাও যেতেন, আমার মা একটা কাজ করতেন, কিছুক্ষণের জন্য সকলের কাছ থেকে তাকে আলাদা করে বলতেন, একটু ১০টা মিনিট, ১৫টা মিনিট তুমি রেস্ট নিয়ে নাও। সেইদিনও দরজা বন্ধ করে মা বলেছিলেন, একটু শুয়ে থাক। আমি আব্বার মাথার কাছে বসে আস্তে আস্তে মাথায় হাত বুলাচ্ছিলাম। মা পাশে বসলেন। বললেন, ‘আজ সারা দেশের মানুষ তোমার দিকে তাকিয়ে আছে। সামনে তোমার বাঁশের লাঠি, জনগণ আর পেছনে বন্দুক। এই মানুষদের তোমাকে বাঁচাতেও হবে-এই মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে হবে। অনেকে অনেক কথা বলবে- তোমার মনে যে চিন্তাটা থাকবে- তুমি ঠিক সেই কথাটা বলবে।’  

৭ মার্চের এই আয়োজনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একাধারে সঞ্চালক, একক বক্তা ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। সাধারণত জনসভায় একজন সভাপতি ও বেশ কয়েকজন বক্তা থাকে। সভা শুরু করেন সঞ্চালক বা উপস্থাপক, তিনি প্রত্যেক বক্তাকে সভায় উপস্থিত জনতার সামনে পরিচয় করিয়ে দেন এবং আমন্ত্রণ জানান। ৭ মার্চের সভায় সে আয়োজন ছিল না। অনেকে বক্তৃতা দিলে মূল ভাবনা সাধারণের কাছে পৌঁছুতে সমস্যা হতে পারে। তাই একজনই জনতার কাছে তাঁর ভাবনা প্রকাশ করেছে। এই ভাবনা আর একক ব্যক্তির ভাবনা থাকে নি, বাঙালির ভাবনা হয়ে তাঁর ভাষণে প্রকাশিত হয়েছিল। এই সভার এটাও একটা বিশেষ দিক। জনগণকে জাগিয়ে তোলার দায়িত্ব যার তিনিই কথা বললেন সে সভায়।

বক্তৃতার শুরুতেই বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ভাইয়েরা আমার’। এই সম্বোধনের মাধ্যমে তিনি জনতার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। বঙ্গবন্ধু শ্রোতাদের প্রস্তুত করে নেন ভাষণের মূল অংশে প্রবেশের আগে। প্রস্তাবনায় তিনি বলেন যে ‘দুঃখভারাক্রান্ত মন’ নিয়ে জনসভায় উপস্থিত হয়েছেন। তারপরই বলে দেন: ‘আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়।’ অধিকার প্রত্যাশী মানুষের কথা বলার পরই তিনি নির্বাচনে জয়ী নেতা হিসেবে সমবেত জনতাকে বলেন, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা শাসনতন্ত্র তৈরি করবে। দীর্ঘ সময়ের আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি যে দেশের স্বপ্ন সাধারণের মনে বুনে দিয়েছিলেন সে দেশকে গড়ে তোলার কথা জানান। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির পাশাপাশি সাংস্কৃতিক মুক্তির কথা বলেন।

বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ যখন ভাষণ দিচ্ছেন তখন তাঁর পরিচয় তিনি শুধু বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনের নেতা নন, পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনের নেতা। সে হিসেবে তিনি ইয়াহিয়া খানকে অনুরোধ করেছিলেন ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করার জন্য। কিন্তু সামরিক শাসক তখন জুলফিকার আলি ভুট্টোর (১৯২৮-১৯৭৯) পরামর্শে অধিবেশন আহ্বান করলেন। শুধু তাই নয়, ভুট্টোর চাপে অধিবেশন স্থগিত করা হলো। পাকিস্তানি শাসক ও তাদের তাবেদাররা বুঝে নিয়েছিলেন জনমত তাদের পক্ষে নেই। বাঙালি আর বাঙালির নেতাকে প্রতিপক্ষ করে বন্ধ করা হলো অধিবেশন। এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, অধিবেশন বন্ধ করে দেওয়ার পরও আক্রমণাত্মক কর্মসূচি ঘোষণা করলেন না বাঙালির নেতা। তিনি শান্তিপূর্ণ হরতালের আহ্বান জানালেন।

আন্দোলন দমাতে পাকিস্তান অস্ত্রের ব্যবহার করেছে। ৭ মার্চের ভাষণে তিনি জনতাকে জানিয়ে দিলেন, বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কেনা অস্ত্র জনগণের ওপর ব্যবহার করা হচ্ছে। কৌশলে জনসভাস্থলের পাশে থাকা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যদেরও তিনি জানিয়ে দিলেন এই অস্ত্র ব্যবহার সম্পর্কে নিজের ভাবনা। তিনি জনতার কাছে জানতে চাইলেন- ‘কী পেলাম আমরা?’ সভাস্থলে উপস্থিত জনতা যেন তুলনামূলক বিচারে নিজের পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে পারে। পাকিস্তানের পশ্চিম ও পূর্ব অঞ্চলের মাঝে যে বৈষম্য সেটি উপস্থিত জনতার চিন্তন থেকে যেন মুছে না যায় সে বিষয়টি তার ভাবনায় ক্রিয়াশীল ছিল।

জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে তাঁর ভাবনায় বাঙালির অধিষ্ঠান। তিনি গভীর আবেগ নিয়ে বললেন, ‘আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ, আমরা বাঙালিরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি তখনই তারা আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।’ ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পর বাঙালির রাজনৈতিক শক্তি যুক্তফ্রণ্ট ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে গণমানুষের নির্বাচিত প্রতিনিধিকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ১৯৬৬ সালে ৬দফা ঘোষণার পর মামলা ও গুলি চালনার মাধ্যমে এই আন্দোলনকে দমানোর চেষ্টা করেছে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসকগণ।

৭ মার্চের ভাষণ আলোচনায় বলা যায়, এই ভাষণ যেমন লিখিত নয় তেমনি এর লেখা পাঠের চেয়ে শ্রবণে ভাষণের আবেগ পাওয়া যায়। কণ্ঠস্বরের ওঠা নামার মধ্য দিয়ে বক্তার আবেগ ও শ্রোতার আবেগ উভয়ই উপলব্ধি করা যায়। সম্ভবত এ কারণেই মার্চ এলেই বাংলাদেশের অসংখ্য স্থানে এই ভাষণ বহুবার বেজে ওঠে। সাধারণ মানুষ নিজের ভালোবাসার কারণেই এই ভাষণের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গত ৪৯ বছর ব্যক্তিগত উদ্যোগ, সামাজিক ও রাজনৈতিক উদ্যোগে এই ভাষণ শুনেছে।

১৯৭১ সালের ৬ মার্চ সারারাতসহ একটানা ৩৬ ঘণ্টা আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক চলে। শুধু তাই নয়, অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু যা বলবেন তার একটি বাংলা ও ইংরেজি খসড়া বঙ্গবন্ধুর হাতে দিয়েছিলেন।  সে পথে হাঁটলেন না বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি নিজের আবেগ ও রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার মিশেলে জাতির সামনে তুলে ধরলেন এক অসামান্য ভাষ্য। ভাষণটি এক অনন্য শৈল্পিক উচ্চতায় উত্তীর্ণ হলো। যাকে লঙ্গিনুসের ভাষায় ‘সাবলাইম’ বলা যায়। কোনো অপ্রয়োজনীয় শব্দ বা বাক্য নেই। এক দ্বান্দ্বিক অবস্থার বিবরণ দিচ্ছেন, যার একপাশে পশ্চিম পাকিস্তানিরা আর অন্যপাশে নির্যাতিত ও নিপীড়িত বাঙালি। দুয়ের দ্বন্দ্বকে রেখে তিনি নাটকীয় উত্তেজনা তৈরি করেছেন। এ সবের পেছনে মূল উদ্দেশ্য স্পষ্ট- জাতিকে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত করা।

৭ মার্চ পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করার সময় গরিব-দুঃখী মানুষের কষ্ট যাতে না হয় সেদিকেও নজর দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই তাই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ বন্ধ ঘোষণা করলেন। প্রধান বিচারালয়, সচিবালয়, আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ এই বন্ধের আওতায় ছিল। কিন্তু রিকশা, ঘোড়ার গাড়ি, রেল ও লঞ্চ সচল রাখলেন। গরিব মানুষের আয় ও যাতায়াত যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিক বিবেচনায় এগুলো খোলা রাখলেন। তিনি জানতেন সাধারণ জনগণ তাঁর শত্রু নয়।  এই বিষয়টি বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল ও নেতারা ভাবতে পারেন। গণমানুষের নেতা হিসেবে কেমন করে জনতার কথা মনে রেখে আন্দোলনের কর্মসূচি প্রনয়ন করা যায়। একই সঙ্গে কর্মচারীদের নির্দেশ দিলেন তারা যাতে ২৮ তারিখে বেতন নিয়ে আসে। যেহেতু তিনি বাংলাদেশের মুক্তির জন্য লড়াই করছেন সেহেতু দেশের মানুষের যাতে কষ্ট না হয়, সেদিক কড়া নজর রেখেছেন। একই সঙ্গে সরকারি প্রশাসনকে অকার্যকর করে দিতে চেয়েছেন। বাংলার সাধারণ মানুষের নেতা হিসেবে শ্রমিকদের বেদনাও তিনি উপলব্ধি করেছেন। তাই মালিকদের অনুরোধ করেছেন যাতে হরতালে অংশ নেওয়া শ্রমিকদের বেতন পৌঁছানো হয়।

বাংলার সাধারণ মানুষের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু গভীর যোগ অনুভব করতেন। যার মধ্য দিয়ে বাংলার সমাজ-জীবন ও সংস্কৃতি তাঁর ভাবনায় সকল সময় ক্রিয়াশীল ছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনী বন্দুক দিয়ে জনতার আন্দোলনকে দমাতে চেয়েছে। তিনি এর বিরুদ্ধে ভবিষ্যৎ প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান নিয়ে বলেছেন: ‘আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের উপর আমার অনুরোধ রইল : প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো।’ এই দুর্গ গড়ে তোলার সময় তিনি নিজ জনতাকে নির্দেশ দিচ্ছেন আঞ্চলিক ভাষায়। ব্যাকরণ সিদ্ধ নিয়মে বলছেন না, ‘তোমাদের প্রতি আমার অনুরোধ রইল...’ এখানে ব্যবহার করলেন ‘উপর’। তিনি রেসকোর্সে উপস্থিত জনতার আবেগ ও চেতনা নিয়েই এমন উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন। জনতার কাছে পৌঁছানোর জন্য তিনি জনতার ভাষাকেই অবলম্বন করেছিলেন। তিনি বলছেন ‘জীবনের তরে’ রাস্তাঘাট বন্ধ করে দেবার জন্য। বাঙালি জাতি আর নিজেকে এক রেখায় দাঁড় করিয়ে বললেন, ‘কিন্তু আর আমার বুকের উপর গুলি চালাবার চেষ্টা কোরো না।’ তখন আর ব্যক্তি মুজিব থাকেন না; সমগ্র বাঙালি হয়ে যান। সাড়ে সাত কোটি মানুষকে নিজের শরীরে স্থান দেন।

৭ মার্চের ভাষণ বাঙালির আবেগ-অনুভূতির প্রকাশ। পাকিস্তানিদের হাতে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নিপীড়িত জাতির কণ্ঠস্বর হয়ে যান মুজিব। তাই এই ভাষণে আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। এ বিষয়ে কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বলেন:

‘‘ভাষণের অনেক বাক্যে ক্রিয়াপদের ব্যবহারে প্রমিত বাংলা না রেখে আঞ্চলিক মিশেল ঘটিয়েছেন। যেমন বলেছেন, ‘শাসনতন্ত্র তৈয়ার করব’- প্রমিত বাংলায় বললে বলতেন ‘তৈরি করব’। বলেছেন, ‘আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দেবার চাই’- প্রমিত বাংলা বললে বলতেন ‘দিতে চাই’। এমন আরও বাক্য আছে এই ভাষণে মনে হয় গণমানুষের আবেগকে বুকের ভেতর রেখে তিনি দেশীয় ভাবনার এক কালজয়ী কবি। সময় তাঁকে আড়াল করে দিতে পারেনি। পারবে না।’’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাত কোটি মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে বললেন, ‘৭ কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবা না।’ এখানে ‘দাবায়ে’ শব্দটির বিকল্প পাওয়া যায় না। এই আঞ্চলিক শব্দটি একই সাথে আবেগ ও দেশজ চেতনা জাগানোর কাজে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বাক্যটি জনগণের কাছে বার্তা পৌঁছানোর পাশাপাশি বক্তার আবেগকেও বহন করে। বঙ্গবন্ধু ভাষণের এ স্থানে শৈল্পিক সমুন্নতিতে নিয়ে যান তাঁর শ্রোতাদের। পূর্ববাংলার নেতা হিসেবে এই নদী বিধৌত অঞ্চলের আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার ঐতিহ্যের সাথে যুক্ত করে শ্রোতাদের।

৭ মার্চের ভাষণে তিনি গভীর প্রত্যয় নিয়ে বলেন, ‘মনে রাখবা: রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব- এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ।’ তিনি মুক্ত করার কথা বলছেন, কিন্তু সরাসরি ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি উল্লেখ করলেন না। তিনি যদি বলতেন ‘বাংলাদেশ স্বাধীন করব’। তখনই সেখানে পাকিস্তানি অস্ত্র গর্জে উঠতো। অভিযুক্ত হতেন বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের নেতা হিসেবে। যেমন ঘটেছিল নাইজেরিয়ার বায়াফ্রায়। নাইজেরিয়ার পূর্বাঞ্চল ১৯৬৭ সালে ‘রিপাবলিক অব বায়াফ্রা’ রাষ্ট্র গঠিত হয়। গিবন, হাইতি, আইভরি কোস্ট, তাঞ্জানিয়া এবং জাম্বিয়া এই নতুন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিলেও বিশ্বের আর কোনো দেশ তাদের স্বীকৃতি দেয়নি। আফ্রিকার সবচেয়ে বড়ো উপজাতি ইগবোরা  এই স্বাধীনতার লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেয়। আড়াই বছরের এই যুদ্ধে নাইজেরিয়ার সেনাবাহিনী বায়াফ্রা অবরোধ করেছিল। যার ফলে দুর্ভিক্ষে প্রায় কুড়ি লক্ষ সাধারণ মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। যার তিন চতুর্থাংশ ছিল শিশু।

বিশ্বের কোনো রাষ্ট্র থেকে সহায়তা না পাওযার কারণে ১৯৭০ সালে স্বাধীনতাকামীরা আত্মসমর্পন করে। বায়াফ্রার এই অভিজ্ঞতা সামনে ছিল বলে বঙ্গবন্ধু সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন নি। জাতি তাঁর ভাষণের মর্মার্থ উপলব্ধি করতে পেরেছিল। তিনি স্বাধীনতার পথে পা রেখেছেন। কর ও খাজনা বন্ধ করে দেওয়া; সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বিচারালয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইত্যাদি বন্ধ ঘোষণার নির্দেশ প্রদান তো প্রচলিত রাষ্ট্রকে অস্বীকার করা। এরপরই তিনি বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম- এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ জনসভাস্থলে উপস্থিত জনতা এবং পরদিন বেতারের মাধ্যমে জাতি জেনে গেল তাঁর অভিপ্রায়। ৭ মার্চের ভাষণে তিনি কতটা কৌশলী ছিলেন তা তাঁর ভাষণ পাঠে উপলব্ধি করা যায়। ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’ কথার আগে ‘আমাদের’ শব্দটিও তিনি উচ্চারণ করলেন না। কিন্তু স্বাধীনতার সংগ্রাম কথাটি জনতাকে জানিয়ে দিলেন। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী তাঁকে অভিযুক্ত করতে পারলো না। আবার তিনি তাঁর ঘোষণা ঠিকই দিয়ে রাখলেন।

৭ মার্চের ভাষণ আলোচনায় বলা যায়, জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মানসে তিনি লড়াই করেছেন। সে সময়ে তিনি ইচ্ছে করলে পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে পারতেন। তা না করে বাঙালির মুক্তির কথা বলেছেন। পাকিস্তানের অধীন থাকলে জাতি হিসেবে বাঙালির বিকাশ ঘটবে না। পরাধীন জাতির ভাষার মূল্য নেই। সেটা ১৯৫২ সালেই বাঙালি উপলব্ধি করেছে। নিজ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সাধনা সম্ভব হয় না, সেটা পাক-ভারত যুদ্ধের সময় রবীন্দ্রনাথ নিষিদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে বোঝা গেছে। অর্থনৈতিক বৈষম্য নিয়ে ১৯৭০-এর নির্বাচনের সময় জাতি দেখেছিল পোস্টার ‘সোনার বাংলা শশ্মান কেন?’ আর বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পরও রাষ্ট্রক্ষমতায় বাঙালিরা যেন বসতে না পারে সেজন্য গণপরিষদ স্থগিত করা হলো। তিনি অসহযোগ আন্দোলন নামে নতুন এক কর্মসূচি ঘোষণা করলেন যা কিনা বিশ্বের ইতিহাসে রাষ্ট্র গঠনের জন্য অহিংস আন্দোলনের উদাহরণ।  এই ভাষণ স্বাধীনতার ঘোষণাই নয় স্বাধীনতার পর নতুন রাষ্ট্রর কাঠামো সম্পর্কেও জাতিকে ধারণা দিয়েছে। কোনো সন্দেহ নেই, আজ অর্ধশত বছর পরেও ৭ মার্চের ভাষণ প্রাসঙ্গিক। শোষণমুক্ত রাষ্ট্র গঠনে এই ভাষণের শব্দগুলি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের প্রাণে আলোড়ন তুলবে।

তথ্যসূত্র:  শেখ হাসিনা (২০০৪), জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট আয়োজিত সেমিনারে সভাপতির ভাষণ, ৪ মার্চ ২০০৪, [শামসুজ্জামান খান ও অন্যান্য (২০১৫) সম্পাদিত, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ : বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ, বাংলা একাডেমি, ঢাকা,  ১৫৪-১৫৫]  আগের দিন রাত ৪টা পর্যন্ত জেগে আমরা তাঁর জন্য ৭ই মার্চের ভাষণ ও তার ইংরেজি তরজমা করলাম। কিন্তু ভাষণ দেয়ার সময় দেখা গেল আমাদের প্রস্তুত করা খসড়া তাঁর সামনে নেই। এবং যে ভাষণ দিলেন তার সঙ্গে আমাদের খসড়ার কোনো কোনো পয়েন্ট ছাড়া আর কোনো মিলই নেই। [তদেব, পৃ. ২১] The Igbo People_Origins and History ww(w.faculty.edu.retrieved-2020-05-22)

লেখক: নাট্যকার ও গবেষক, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়