মতামত

লকডাউন ও নার্ভাস ব্রেকডাউন

শনির আখড়া থেকে সায়দাবাদ পর্যন্ত হেঁটে চলে এসেছেন ইমরুল হাসান। একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে ভিডিও এডিটরের কাজ করেন। সকাল ৯টায় অফিস। সায়দাবাদ আসতে আসতেই ১০টা বেজে গেল। কোনো গাড়িতে সিট পাওয়ার উপায় নেই। বাস এখন অর্ধেক যাত্রী বহন করে- এক সিটে এক যাত্রী। রাস্তায় গাড়ির স্বল্পতা, মানুষ অধিক।  বাকি যাত্রী কীভাবে যাবে তা কেউ জানে না। রিকশা-সিনজি ভাড়া চায় দ্বিগুণ। যাত্রাবাড়ি থেকে ‘পাঠাও’ তেজগাঁ সাতরাস্তা মোড় পর্যন্ত স্বাভাবিক সময়ে যায় একশ থেকে দেড়শ টাকায়, আজ ভাড়া চায় তিনশ থেকে চারশ টাকা।

রাস্তার হাজার হাজার মানুষের আজ এমন নাজেহাল অবস্থা। ৫ এপ্রিল সকাল ৬ টা থেকে ১১ এপ্রিল রাত ১২ পর্যন্ত সারাদেশে ৭ দিনের লকডাউন ঘোষণা করেছে সরকার। এই লকডাউন নিয়ে শুরু হয়েছে বিভ্রান্তি ও ভয়। সরকারি ঘোষণায় বলা হচ্ছে-  সন্ধ্যা ৬টা থেকে ভোর ৬ টা পর্যন্ত জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাইরে বেরোতে পারবে না। সব ধরনের যানবাহন, দোকানপাট, শপিংমল, খাবার হোটেল বন্ধ থাকবে। কিন্তু আবার বলা হয়েছে শিল্পকলকারখানাগুলো খোলা থাকবে। জরুরি প্রয়োজনে অফিসে করা যাবে সীমিত আকারে। তাহলে এটা কেমন লকডাউন? ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে চলাফেরা করা যাবে। যার ব্যক্তিগত গাড়ি নেই সে কী করবে?

একুশে ফেব্রুয়ারির বইমেলা নিয়েই এবার সবচেয়ে দুনোমন হলো। হবে কি হবে না করে ফেব্রুয়ারির বইমেলার সময়সীমা ঠিক করা হলো ১৮ মার্চ থেকে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত। করোনা রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় ৩১ মার্চ থেকে বইমেলার প্রতিদিনের নির্ধারিত সময় কমিয়ে দেয়া হলো বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬.৩০  পর্যন্ত। ৩ এপ্রিল সন্ধ্যা পর্যন্ত জানা গিয়েছিল আজই মেলা শেষ। পরে জানা গেল ৪ এপ্রিলও মেলা হবে। ৪ এপ্রিল দিনশেষে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ঘোষণা দিয়েছে বইমেলা বন্ধ হচ্ছে না। খোলা থাকবে দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। যানবাহন যদি বন্ধ থাকে বইমেলায় মানুষ যাবে কীভাবে!

লকডাউন কি ৭ দিনই থাকবে, নাকি আরো বাড়বে এই নিয়েও অনেকে চিন্তিত! পৃথিবীর কোথাও ৭ দিনের লকডাউন নেই। লকডাউন দিতে হবে কমপক্ষে ১৫ দিন। এর মধ্যে  ক’দিনের মধ্যেই আসছে রোজা। নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ছে হু হু করে। টেলিভিশনে খবরে দেখাচ্ছে চাহিদার তুলনায় মানুষ বেশি ক্রয় করছে। অর্থনৈতিকভাবে সক্ষম যারা অতিরিক্ত খাদ্য কিনে মজুদ রাখছে ঘরে। আর যারা দিনে এনে দিনে খায়; নিম্নমধ্যবিত্ত- তাদের মাথায় হাত। পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে, রোজা উপলক্ষে, ঈদ উপলক্ষে যাদের কিছু কর্মসংস্থান হয় তারা এখন অনিশ্চয়তার মুখে। লকডাউনের ঘোষণা আসতে না আসতেই নিউমার্কেটের দোকানমালিক সমিতি রাস্তায় নেমেছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে তারা দোকান খোলা রাখার দাবি জানাচ্ছে। পরিবহন শ্রমিক থেকে শুরু করে দোকানমালিক, স্বল্প বেতনের চাকরিজীবী কেউই এখন এই লকডাউন মানতে নারাজ। কিন্তু লকডাউন না দিয়েও তো উপায় নেই। প্রতিদিনই বাড়ছে করোনা রোগীর সংখ্যা, ছাড়িয়ে যাচ্ছে আগের দিনে শনাক্ত ও মৃত্যুর হার। আজ সর্বোচ্চ শনাক্ত ৭ হাজার ৮৭ জন, মৃত্যু ৫৩ জন।

গত বছর এ-সময়ে যখন করোনার প্রথম ঢেউ এলো তখন শুনেছিলাম ওই এলাকায় করোনা রোগী পাওয়া গেছে। এবার তো ঘরে ঘরে করোনা-আক্রান্ত রোগী। এমন একটি পরিবার বাকি নেই, পরিবারের মধ্যে না হলেও আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে কেউ না কেউ করোনা পজিটিভ হয়েছে। অনেকে হারিয়েছেন খুব কাছের মানুষ। সব মিলিয়ে এবার আতঙ্ক ও অস্থিরতা একটু বেশিই। কিন্তু তাতেও কি কেউ সাবধান হচ্ছে? বাজারগুলো লোকে লোকারণ্য, শপিংমলগুলো ঈদের কেনাকাটার মতো ভিড়। ট্যুরিস্ট স্পটগুলোতেও গত কয়েক মাস ফিরে এসেছিল স্বাভাবিক অবস্থা। মানুষ বোধহয় মনে করেছিল করোনা বিদায় নিয়েছে। এই সুযোগে করোনা দিলো দ্বিতীয় ছোবল।

এখন লকডাউন সত্যিই কতখানি কার্যকর হবে এ নিয়ে অনেকেই সন্দিহান। ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা মোটেই ভালো নয়। স্বল্প আয়ের মানুষ হুমকির মধ্যে পড়তে যাচ্ছেন। গত বছর লকডাউনের সময় অনেক রকম সরকারি-বেসরকারি সাহায্য-সহযোগিতা পেয়েছেন নিন্ম আয়ের মানুষ। এবারও তা পাবেন কিনা এমন নজির এখনো দেখা যায়নি। সবচেয়ে বড় কথা লকডাউন মানুষ কতখানি মানবে সেটাই দেখার বিষয়। এ-নিয়ে এখনো পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক চলছে। কেউ লকডাউনের পক্ষে, কেউ-বা বলছেন- লকডাউন না দিয়ে সাবধানতা দরকার। কিন্তু সাবধান  যে মানুষ থাকতে পারছে না তাও তো দেখা যাচ্ছে। এখন লকডাউন দিলেও বিপদ, না দিলেও বিপদ। লকডাউন দিলে অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। আর না দিলে জীবনের জন্য সংকট। দোষ দেয়া যায় কাকে! এ কি শুধু প্রাকৃতিক বিপর্যয়, নাকি আমাদেরও অসাবধানতার ফল! গত বছরের তুলনায় এবার করোনা রোগীর হার বহুগুণ বেশি। হাসপাতালগুলোতে রোগী উপচে পড়ছে। হাসপাতালগুলো শুধু করোনা রোগী নয়, অন্যান্য রোগীও ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে। চিকিৎসাক্ষেত্র একটা ভঙ্গুরদশায় পড়েছে। শুধু চিকিৎসাক্ষেত্র নয়, আমাদের সমস্ত কিছুই একটা ভগ্নদশায় পতিত হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কবে খুলবে তার কোনো ঠিক নেই। ঘরে বসে থাকতে থাকতে শিশু-কিশোরদের দম বন্ধ হয়ে আসছে। মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে সবারই। এ নিয়ে আমাদের দেশে গবেষণারও সুযোগ নেই, যে করোনা আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর কতোটা চাপ ফেলছে।

মানুষগুলোর যে কী হতবিহবল দশা সেটা রাস্তায় বেরোলেই দেখা যায়। প্রতিটা মানুষ কেমন দিশাহারা। তারা কী করবে, কোথায় যাবে কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। লকডাউনের কথা শুনে অনেকে গ্রামে রওয়ানা দিয়েছে। গ্রামে যে যাবে পর্যাপ্ত যানবাহনও নেই। ভিড় কমাতে বলছে অথচ বাসে, লঞ্চে প্রচণ্ড ভিড়। আবার গ্রামে না গিয়ে যে শহরে থাকবে, বিনা কাজে এক সপ্তাহ এই শহরে থাকার ক্ষমতাও নেই অনেকের। তাও বাধ্য হয়ে অনেকে আবার শহরেই দাঁত কামড়ে পড়ে আছে, গেলে যদি আর সহসা ফিরতে না পারে। তারা পড়েছে উভয় সংকটে।

সব মিলিয়ে করোনা আমাদের সবচেয়ে বড় যে শিক্ষাটা দিয়েছে তা হচ্ছে আমরা এখনো সচেতন হতে পারিনি। আমরা এখনো কোনো সিস্টেম দাঁড় করাতে পারিনি। আমাদের চারপাশেই কেমন একটা বিশৃঙ্খলা। সবাই কেমন একটা মানসিক অস্থিরতার মধ্যে পড়ে গেছেন। ধনি-গরিব, জ্ঞানী-অজ্ঞানী নির্বিশেষে এই অস্থিরতা এই মুহূর্তে সবার মধ্যেই দেখা যাচ্ছে। চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্যের অনিশ্চিত অস্থিরতা সবারই আছে, সে যত প্রতিষ্ঠিত হোক। কিন্তু সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সংকট যেটা কেউ বুঝতে পারছে না পর মুহূর্তে ঠিক কী হবে! প্রতি মূহূর্তে একটা অনিশ্চিত অবস্থা।

করোনা ভাইরাসও প্রতি মুহূর্তে নতুন নতুন আচরণ করছে। একেক দেশ থেকে সে একেকরকম মিউটেশন হয়ে আসছে। এখন করোনা হলে অনেকে বুঝতে পর্যন্ত পারছে না। হালকা জ্বর-ঠান্ডা হলে দুদিনেই সেরে যাচ্ছে। তিনদিন পর আবার লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে। এর মধ্যে আক্রান্ত রোগী নিজের অজান্তেই আরো অনেককে আক্রান্ত করে ফেলছে। অনেকের জ্বর-ঠাণ্ডাও হচ্ছে না। হয়তো খাদ্যে অরুচি কিংবা গন্ধ পাচ্ছে না। তা বুঝতে বুঝতেও দুদিন চলে যাচ্ছে। ওই দুদিনেই বিপদ যা হওয়ার হয়ে যাচ্ছে। ভাইরাসটা যে-বহন করছে সে হয়তো সুস্থ, কিন্তু তার থেকে আক্রান্ত হয়ে অনেকে মৃত্যুঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাচ্ছে।

তাই অনেকে আতঙ্কিত, আসলে বোধহয় এই ভাইরাসের হাত থেকে মানবসভ্যতার সহজে মুক্তি নেই। আজকের খবরে জানা গেল চীনে আবার নতুন করে সংক্রমণ বাড়ছে। অনেক দেশে ভ্যাকসিন ঠিক মতো কাজ করছে না। এখন পর্যন্ত একশ ভাগ নিশ্চিত কোনো ভ্যাকসিন আবিষ্কার করা যায়নি। তাই মানবসভ্যতা আরো কিছু কাল হুমকির মধ্যেই আছে। সাবধানতা ছাড়া গতি নেই। কিন্তু সাবধান থাকতে থাকতেও অনেকের নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। একদিনে লকডাউন আরেক দিকে নার্ভাস-ব্রেকডাউন, কোন দিকে যাবে মানুষ! দমবন্ধ পরিবেশে থাকতে থাকতে মানুষ কি স্নায়ুবিক বিকারের দিকেই যাচ্ছে!