মতামত

তারেক শামসুর রেহমান: বিদ্বজ্জনের বিদায়

অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানকে নিয়ে আজ লিখতে হচ্ছে। লিখতে হচ্ছে তখনই তিনি যখন আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন অদৃশ্যলোকে। অথচ তিনি ছিলেন দারুণ তারুণ্য আর সামর্থ্যে বলিষ্ঠ একজন।অধ্যাপক তারেকের ছিল মেধা, লেখার যোগ্যতা, স্ট্রং পারসোনালিটি, সহযোগিতার মনোভাব, নিয়মানুবর্তিতা, পঠন-পাঠন, গবেষণা ও তাঁর বিশ্লেষণী মনোভাব।

রাজনীতি বা বিশ্ব রাজনীতি ছিল তাঁর আগ্রহ কিংবা প্রকাশের মাধ্যম। রাজনীতি তাঁর লেখার বড় ক্ষেত্র। তিনি পড়াতেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ‌্যালয়ের আন্তজার্তিক সম্পর্ক বিভাগে। একসময় ছিলেন বিভাগীয় প্রধান। একটা বিভাগকে তৈরি করেছেন পরম যত্ন কিংবা উৎসাহে। আবার বিভাগ বা বিশ্ববিদ‌্যালয়কে বিশ্বে পরিচিতি করতে যাঁদের ভূমিকা আছে অধ্যাপক তারেক তাঁদের একজন। তিনি তাঁর লেখালেখি দিয়ে এ কাজ সম্পাদন করেছেন। তাঁর বিশ্লেষণাত্মক লেখাগুলো আন্তজার্তিক সম্পর্ক, বিভিন্ন দেশের পররাষ্ট্রনীতি, বিশ্ব রাজনীতিতে পরাশক্তিগুলোর স্বার্থ এবং দ্বন্দ্ব কিংবা ভূ-রাজনীতির অতীত-বর্তমান প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গে। তিনি লিখেছেন বিশ্ব  রাজনীতি নিয়ে বেশ কিছু বই। বইগুলো পড়ে মনে হয়েছে তিনি কথা বলেছেন টু দ্যা পয়েন্টে। পড়তে গিয়ে বিষয় কিংবা তাৎপর্য স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। আমি যা চেয়েছিলাম তিনি সেসবই যেন বলে ফেলেছেন। অধিক কথা বলার থেকে গুরুত্বপূর্ণ কথাটি কম বাক্যব্যয়ে বলে পাঠকের ধৈর্য কিংবা বোধগম্যতায় পৌঁছানোটা লেখার বড় গুণ। অধ্যাপক তারেকের লেখায় এ গুণ উপস্থিত। এটা কেবল বই নয়, তাঁর প্রিয় ক্লাসরুম কিংবা ক্লাসরুমের বাইরে আলোচনা, টকশো কিংবা কলামগুলোতেও লক্ষণীয়।

তিনি গবেষণা করেছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, ভিন্ন ভিন্ন দেশের পররাষ্ট্রনীতি, কূটনীতি এবং বৈদেশিক সম্পর্কের বিভিন্ন দিক নিয়ে। তাঁর লেখা ‘বিশ্ব রাজনীতির ১০০ বছর’ গ্রন্থটি ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক, গবেষক, চাকরি প্রত্যাশীরা অবশ্য পাঠ্য মনে করে নিজের কাছে রাখেন এবং পড়েন। তাঁর অন্য বইগুলোর ভেতর উল্লেখযোগ্য হলো : আন্তর্জাতিক রাজনীতি কোষ, মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি, বাংলাদেশের নিরাপত্তা ভাবনা, নয়া বিশ্বব্যবস্থা ও সমকালীন আন্তর্জাতিক রাজনীতি, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার রাজনীতি, বাংলাদেশের পূর্বমুখী রাজনীতি, রাজনীতি ২০০৯, বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি, বাংলাদেশের রাজনীতির ৫০ বছর, চীন বিপ্লবের ৭০ বছর, ভারত মহাসাগর ভারত-চীন দ্বন্দ্ব, ইরাক যুদ্ধ পরবর্তী আন্তজার্তিক রাজনীতি, আরব বসন্ত, বিশ্ব রাজনীতির ১০০ বছর (দ্বিতীয় খণ্ড), গঙ্গার পানিচুক্তি: প্রেক্ষিত ও সম্ভাবনা (সম্পাদিত) ইত্যাদি।

তিনি সমসাময়িক নানা বিষয়ে কলাম লিখেছেন। যে কলামগুলোয় বাংলাদেশ ও বহির্বিশ্বের নানাবিধ সংকট-সমস্যা, দ্বন্দ্বসহ চলমান বিষয়গুলোর বিশ্লেষণ রয়েছে। আরো ভেঙে বললে তিস্তা চুক্তির ভবিষ্যৎ, পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন, নরেন্দ্র মোদীর সফর, মিয়ানমার পরিস্থিতি, করোনাকালে বাংলাদেশের করণীয়, আমেরিকা ও ট্রাম্প, শ্রীলংকার রাজনীতির হালচাল, চীন বিশ্বক্ষমতায় আসার পর বিশ্ব কতটুকু বদলাবে, ঘূর্ণিঝড়, সন্ত্রাসবাদ, দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি, আবরার হত্যাকাণ্ড, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির নানা কাণ্ড সহ সমসাময়িক অর্থনীতি, রাজনীতির নানাবিধ বিষয় হয়েছে তাঁর লেখা কলামের বিষয়বস্তু। দুর্বোধ্য বিষয়কে সহজ করে উপস্থাপনে তিনি ছিলেন অনন্য। অধ্যাপক যায়, অধ্যাপক আসে কিন্তু আমাদের অনেকেই নাড়া দিতে পারেন না। অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমান আমাদের বোধ-মনন নাড়িয়েছেন। আমরা পেয়েছি তাঁর অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখা। যা আমাদের নানাভাবে আলোড়িত করেছে, আলোর পথ দেখিয়েছে। যা আমাদের চিন্তাকে উজ্জীবিত করেছে। ফলে তাঁর নির্মাণ আলোকবর্তিকা হয়ে আমাদের পথ দেখাবে। অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের লেখা বেশ কিছু বই যেগুলো অবশ্য পাঠ্য হয়ে উঠেছে কিংবা ভবিষ্যতে অবশ্য পাঠ্যতে পরিণত হবে। এমন অসাধারণ ব্যক্তিত্বকে আমাদের প্রয়োজনেই স্মরণ করা অপরিহার্য হয়ে উঠবে।