মতামত

হেফাজতের মৌলবাদ বনাম আমাদের বাঙালিত্ব

‘একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত, তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তন সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্ব অর্থবহ করে তোলে।’ কথাগুলো আছে বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র একদম প্রারম্ভে। বঙ্গবন্ধু বলছেন, আমাদের বাঙালির মধ্যে দুটা দিক আছে। একটা হলো আমরা মুসলমান, আর একটা হলো, আমরা বাঙালি।

কিন্তু স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে উগ্রবাদী সংগঠন হেফাজতে ইসলামের আস্ফালন ও তাণ্ডব দেখে মনে হলো আমরা বোধহয় নতুন করে পাকিস্তানিদের সেই মুসলমানিত্বের সঙ্গে বাঙালিত্বের লড়াইয়ের ময়দানে উপস্থিত। যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামসহ যারা মৌলবাদী রাজনীতি করে তারা বেশি করে দেশের সার্বভৌমত্বের কথা বলে, দেশপ্রেম শুধু তাদেরই আছে- এমন একটা প্রচারণা চালায়। কিন্তু যদি ১৯৭১-এ ফিরে যাই তাহলে দেখি, ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠ’র মধ্যে একজনও ইসলামী নেতা নেই, ৬৮ জন বীরউত্তমের মধ্যে একজনও মাওলানা নেই, ১৭৫ জন বীরবিক্রমের মধ্যে একজন মুফতি নেই, ৪২৬ জন বীরপ্রতীকের মধ্যে একজনও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মুফাচ্ছের নেই। বরং দুজন নারী আছেন, যাদের বিরুদ্ধে বলা তাদের অন্যতম কাজ। দেশ স্বাধীন করতে কত ধরনের মুক্তিবাহিনী গঠিত হয়েছে কিন্তু একজন ইসলামি নেতার নেতৃত্বে মাদ্রাসার ছাত্র নিয়ে কোনো প্রতিরোধ যুদ্ধের নজির পাওয়া যায়নি। নজির পাওয়া গেছে পাকিস্তানি কর্তৃক বাংলার মা-বোনদের ধর্ষণের সহযোগিতার।

হেফাজতের এবারের তাণ্ডব, তার প্রতি বিএনপি-জামায়াতের অকুণ্ঠ সমর্থন, কোনো কোনো এলাকার সহিংসতায় জাতীয় পার্টির অংশগ্রহণ এবং এমনকি খোদ সরকারি দল আওয়ামী লীগের কিছু অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীর প্রতিক্রিয়াশীল আচরণ নতুন বাস্তবতা আমাদের সামনে উপস্থিত করেছে। আমরা ভাবতে বাধ্য হচ্ছি- নির্বাচনী যুদ্ধেই কেবল জিতব নাকি বাঙালির নিজস্ব মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা করব; যা এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সেই মতাদর্শ হলো উদারতা ও অসাম্প্রদায়িকতা।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই মৌলবাদী শক্তির সঙ্গে সংঘাত হয়ে উঠেছে যতটা রাজনৈতিক, ততটাই সাংস্কৃতিক। একদিকে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমদানিকৃত মোল্লাতন্ত্র, অন্যদিকে আমাদের ‘চিরায়ত বাঙালি দর্শন’। একদিকে সর্বগ্রাসী উদ্রবাদ, ধর্মীয় সম্প্রদায়গত ঘৃণার সংস্কৃতি, অন্যদিকে জারি, সারি, বাউল, ভাটিয়ালি, রবীন্দ্র, নজরুলের বাঙালিত্ব। তারা বাংলা বছরের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ উদযাপন বন্ধ করতে চায়; বাঙালি সেদিন মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করে। তারা শহিদ দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস মানে না; বাঙালি বেশি করে সেগুলো পালন করতে চায়। তারা সব ধর্মের, সব সম্প্রদায়ের সহাবস্থান চায় না, যেমন চায়নি তাদের আদর্শের পাকিস্তানি শাসকরা। উদারতা, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বৈচিত্র, নারীর উত্তারাধিকার বিসর্জন দিয়ে গোটা দেশে জঙ্গি মতবাদ প্রতিষ্ঠায় হেফাজতের যে যে তাগিদ তার বিরুদ্ধে লড়াইটা এখন শেখ হাসিনার। এবং জাতির পিতার কন্যাকে এই লড়াই একাই করতে হবে যেমন তিনি করেছেন যুদ্ধাপরাধের বিচার।

মতাদর্শগত জায়গা থেকে যদি প্রশ্ন করা হয়- মোল্লা দর্শন কি চায় বাংলাদেশে? তারা কি চায় এই দেশ আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইরাক অথবা পাকিস্তানের হোক? পরিষ্কার করে তারা এর উত্তর দেবে না। কিন্তু তাদেন কার্যক্রম সেরকমই। তারা খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে চায় যেখানে মুসলমান ছাড়া আর কোনো ধর্মীয় গোষ্ঠী থাকবে না। অন্য ধর্মের লোকদের তারা ‘বিধর্মী’ বলে এবং তারা মুসলিম জাতির দেশে থাকবে সম্পূর্ণভাবে মুসলিমদের অধীনস্থ হয়ে, জিজিয়া কর দিয়ে। এ দেশে জন্ম নেওয়া মানুষের নাগরিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার এমন ভয়ঙ্কর দর্শন নিয়ে তারা আজ রাজনীতির মাঠে শক্তি আর সহিংসতা নিয়ে উপস্থিত। এই উগ্র দর্শনের বিশ্বাসীরা বলে, এদেশে অমুসলিমদের থাকতে হবে মুসলিমদের পদানত হয়েই।

বাঙালিকে আজ ভালো করে জানতে হবে। হেফাজত বা জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে বাঙালির দর্শনের বিরাট ফারাক। গবেষক গোলাম মুরশিদ লিখেছেন: ‘পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তানে যে রাজনৈতিক আন্দোলন দানা বেঁধেছিল, সেই আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্রে ছিল তাদের এই ‘বাঙালি’ পরিচয়। এই ‘বাঙালি’ পরিচয় যেমন তখনকার রাজনৈতিক আন্দোলনকে শক্তি ও উৎসাহ জুগিয়েছিল, তেমনি সেই রাজনৈতিক আন্দোলনও ‘বাঙালি’ পরিচয়কে মুসলমানদের কাছে আন্তরিক করে তুলেছিল। পরিণতিতে ‘আমরা সবাই বাঙালি’—এই দৃঢ় বিশ্বাস নিয়েই হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান— সবাই মিলে একাত্তরের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এর ফলে বারো-তেরো’শ বছর ধরে যে বঙ্গভূমি ছিল পরাধীন, একাত্তরের সংগ্রামের মাধ্যমে, সেই পরাধীন ভূখণ্ড একটি স্বতন্ত্র ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ করল। আমরা প্রথমবারের মতো একটা স্বাধীন দেশের পতাকা ওড়ালাম।’

ধার্মিক হয়েও উদার হওয়া যায় যেমন ছিলেন বঙ্গবন্ধু। যেমন ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। তিনি লিখেছেন: ‘প্রত্যেক সম্প্রদায় যেভাবে ঈশ্বরের আরাধনা করে, আমি তাহাদের প্রত্যেকের সহিত ঠিক সেইভাবে তাঁহার আরাধনা করি। আমি মুসলমানদিগের মসজিদে যাইব, খ্রিস্টানদিগের গির্জায় প্রবেশ করিয়া ক্রুশবিদ্ধ ঈশার সম্মুখে নতজানু হইব, বৌদ্ধদিগের বিহারে প্রবেশ করিয়া বুদ্ধের ও তাঁহার ধর্মের শরণ লইব, এবং অরণ্যে গমন করিয়া সেইসব হিন্দুর পার্শ্বে ধ্যানে মগ্ন হইব, যাঁহারা সকলের হৃদয়–কন্দর–উদ্ভাষণকারী জ্যোতির দর্শনে সচেষ্ট।’

উগ্রবাদী এসব হেফাজতী চিন্তার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু, রবীন্দ্র, নজরুল বা জসীমউদ্দীনের ভাবনার মিল নেই। বরং এই হেফাজতী ও জামায়াতি ভাবনা এবং বিএনপির বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী ভাবনা বাংলাদেশের জাগরণের চিন্তার ঠিক বিপরীত। তাই বলতে হচ্ছে হেফাজতী দর্শন আর সহিংস মতবাদের আগ্রাসনে এত কালের চেনা বাঙালিত্ব যেন ভেসে না যায়। বাঙালি আবার একাত্তরের মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে, নাকি উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর কাছে মাথা নোয়াবে- সময় এসেছে সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার। 

লেখক: প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা