মতামত

ইসরায়েলি মিলিটারি যতই শক্তিশালী হোক জয়ী হবে না

গাজায় ইসরায়েলি হামলায় এ-পর্যন্ত মারা গেছে ২১৯ জন ফিলিস্তিনি। তাদের মধ্যে ৬৩ জনই শিশু। ৭২ হাজার ফিলিস্তিনি ঘরছাড়া। খাদ্য নেই, পানীয় নেই, চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। বিশ্বমোড়লদের ‘যুদ্ধ বন্ধের আবেদন/ অনুরোধ/ নির্দেশ’ ফাঁকা বুলিতে রূপ নিয়েছে। সহসা এ যুদ্ধ থামার সম্ভাবনা নেই। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, গাজাকে পুরোপুরি পিষে ফেলার আগ পর্যন্ত ইসরায়েলের শান্তি নেই। কারণ গাজা নিয়ন্ত্রণ করছে হামাস। কিন্তু সত্যিই কি গাজা দখল নেয়া সম্ভব? হামাস জানিয়েছে ইসরায়েলি মিলিটারি যতই শক্তিশালী হোক তারা কোনো দিনই জয়ী হবে না। তাহলে কি এই সংঘর্ষ ধারাবাহিকভাবে চলতেই থাকবে? সাম্প্রতিক এই হামলার কী কারণ? বিশ্বনেতারাই-বা কী বলছেন, কী করছেন? এ-নিয়ে ‘দ্যা কনভারসেশন’ পত্রিকায় চলমান পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করেছেন পত্রিকাটির সম্পাদক  মিশা কেচেল। রাইজিংবিডির পাঠকদের জন্য লেখাটি অনুবাদ করেছেন কামরুল আহসান।

মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র ইসরায়েল। দেশটির হয়তো মিশর বা তুরস্কের মতো বিশালসংখ্যক সৈন্যবাহিনী নেই, কিন্তু তাদের প্রশিক্ষণ, অস্ত্রসম্ভার, প্রযুক্তি আর পারমাণবিক শক্তি দুর্ধর্ষ। নিজেদের এলাকা নিয়ন্ত্রণসহ খোদ ফিলিস্তিনভূমিতে সবরকম নিয়ন্ত্রণ নেয়ার দীর্ঘমেয়াদী কৌশল তাদের জানা। সামরিক শক্তি বাড়ানোর পাশাপাশি এ জন্য যত রকম উগ্র মতবাদ ছড়ানো যায় তাও তারা ছড়িয়েছে।

গাজা হয়তো কোনোদিনই পুরোপুরি দখল করতে পারবে না ইসরায়েল বাহিনী। কিন্তু এই ছোট অঞ্চলটির ২০ লাখ মানুষ কার্যত ইসরায়েলি সৈন্যদের হাতেই বন্দী। কারণ এর সীমান্ত পাহারায় ইসরায়েলি বাহিনী। গাজায় কোনো সমুদ্রবন্দর নেই। একটি বিমানবন্দর ছিল, তাও বহু বছর আগে ধ্বংস করা হয়েছে। ভূমধ্যসাগরের উপকূলরেখা সর্বদাই টহল দিচ্ছে ইসরায়েলিরা। বস্তুত গাজা এক উন্মুক্ত জেলখানা।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু অবিরাম বলে যাচ্ছেন তার দেশ সম্পূর্ণ সুরক্ষায় আছে। ফিলিস্তিনিদের ভয় পাবার কিছু নেই। উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠার আগ পর্যন্ত ইসরায়েলের পশ্চিম তীর, বিশেষ করে জেরুজালেমে বসতি স্থাপন বাড়াতেই হবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও বলেছেন, ‘নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভাবার অধিকার ইসরায়েলের আছে,’ তাদের জানা উচিত তারা  নিরাপদ ও সুরক্ষিত।  কিন্তু তারা আসলে তা বোধ করছে না। বরং বারবার উঁকি দিচ্ছে অনিরাপত্তার হাতছানি। একদিকে মনে হতে পারে তাদের কখনো পরাজিত করা সম্ভব না। আরেক দিকে হুমকি তো রয়েই যাচ্ছে সব সময়। বর্তমান এ সহিংস লড়াই তো এটাই প্রমাণ করে।

বর্তমান সহিংসতার কারণ

সাম্প্রতিক এ-সংর্ঘষের মূল কারণ আল-আকসা মসজিদে ইসরায়েলি পুলিশের বারবার হামলা। এটি এমন দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলবে যা পশ্চিমাদের চিন্তারও বাইরে। আল-আকসা মসজিদে ইসরায়েলি হামলা শুরু হয়েছে এপ্রিলের ১৩ তারিখ থেকে। সেদিন ছিল প্রথম রোজা। মসজিদ চত্বরে ইসরায়েলি পুলিশ ঢুকে চারটি মিনারের লাউড স্পিকারের তার কেটে দেয়। ইসরায়েলের রাষ্ট্রপতির কাছেই কোথাও ভাষণ দেয়ার কথা ছিল। আজানের শব্দ যেন বিরক্ত না করে তাই এই ব্যবস্থা। 

স্বাভাবিকভাবেই এটা ফিলিস্তিনিদের ক্ষুব্ধ করে। তারা মসজিদেই স্লোগান দিতে শুরু করে। পরে দামেস্ক গেটে গিয়ে জড়ো হয়। উত্তেজনা বাড়ার সাথে সাথে হামাস রকেট ছুড়ে প্রতিবাদ জানায়। ৭ মে শুক্রবার বিকেল নাগাদ সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে।

সহিংসতা বৃদ্ধি পাওয়ায় তিনদিন পর পুলিশ আবার মাঠে নামে। সেদিন প্রথম গাজা থেকে হামাসের রকেট নিক্ষেপ করা হয়। গাজায় সামরিক স্থলবাহিনীর আক্রমণ ছাড়া ইসরায়েল গাজার রকেট ছোড়া বন্ধ করতে পারবে না এটা ইসরায়েলি বাহিনীর একটা বড় সমস্যা। ইসরায়েল শেষবার গাজায় সৈন্যবাহিনী পাঠিয়েছিল ২০১৪ সালের জুলাই মাসে। শহুরে গেরিলাযুদ্ধ সম্পর্কে তখন তাদের একটা ভালো শিক্ষা হয়েছে। সেই যুদ্ধে ইসরায়েলি বাহিনী ৬৮জন সৈন্য হারিয়েছিল। আহত হয়েছিল শতাধিক। কেউ কেউ সারাজীবনের জন্য বিকলাঙ্গ হয়ে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত যখন যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছিল, ইসরায়েলি বাহিনী জানতে পেরেছিল হামাসের কাছে এখনো তিন হাজার রকেট রয়ে গেছে। গত সাত বছরে তাদের অস্ত্রাগার আরো সমৃদ্ধ হয়েছে। ইসরায়েল বাহিনী জানে হামাসের প্রস্তুতি এখন আরো ব্যাপক। মাটিতে তারা আরো ভয়ানক হামলা চালাতে সক্ষম। ২০০৮ সালেও তাদের সেরকমই ধারণা ছিল। তারপরও ২০১৪ সালের হামলা থেকে তারা পিছপা হয়নি।

দুর্ভেদ্য কিন্তু অনিরাপদ

গত মাসের ঘটনাবলীর আগে নেতানিয়াহু ইসরায়েলিদের অবিশ্রামভাবে বুঝিয়ে গেছেন ফিলিস্তিনিদের দমিয়ে রাখা গেছে এবং ইসরায়েলের ইহুদিরা এখন নিরাপদ। এই বয়ান রাশিয়া, ইউক্রেন থেকে ৪০ বছর ধরে আগত দশ লক্ষ ইহুদিকে প্রশান্তি দিয়ে গেছে যে ইসরায়েলে নিজেদের বসতি স্থাপনে তাদের অধিকার আছে এবং এখানে তারা নিরাপদ।

এই ধারণা আরো পাকাপোক্ত করেছে ইসরায়েলের একনিষ্ঠ বন্ধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ইসরায়েলের পক্ষে তাদের ব্যাপক প্রচারণায়, বিশেষ করে ‘মিডল ইস্ট ফোরাম’-এর কারণে সব সময়ই তারা আস্থা পেয়েছে। আর যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে, সে ডেমোক্রেট হোক আর রিপাবলিকানই হোক সব সময়ই তাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে রেখেছে খ্রিস্টান জায়োনিস্টরা।

এখন যাই ঘটুক, তিনটি বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে। প্রথম বিষয় হচ্ছে নেতানিয়াহু নিজের রাজনৈতিক জীবন বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। নিজেকে তিনি ইসরায়েলের একমাত্র রক্ষাকর্তা হিসেবে প্রকাশ করছেন। যাই ঘটুক, সবই তার জন্য দরকারি। যদিও তার জোটের শরিকেরা অনেকে তার ওপর ক্ষুব্ধ। এমন কি বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে অনেকে ভীত। শুধু ইসরায়েলের নাগরিকদের জীবন হুমকির সম্মুখে পড়ার জন্য না, আরব ইসরায়েলি রাজনীতির ক্রমবর্ধমান শক্তি বৃদ্ধির কারণেও।  দ্বিতীয়ত, মসজিদে হামলা ইসলামি বিশ্বে ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। ইন্দোনেশিয়া থেকে মরক্কো, এর বাইরের মুসলমান দেশগুলোতেও এর বিরুদ্ধে আন্দোলনে সোচ্চার হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের স্বৈরশাসকেরা যদিও প্যালেস্টাইনকে পাত্তা না দিয়ে ইসরায়েলের সঙ্গেই লেনদেন করতে রাজি, তবুও তাদের জনগণের মধ্যে এক ধরণের বিক্ষোভ জেগে উঠছে, তাদের সমর্থন স্পষ্টতই ফিলিস্তিনির পক্ষে।

তৃতীয় বিষয়টি হয়তো এখনো আলোচনার মধ্যে আসেনি। পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমি বুঝতে পারছি ইসরায়েল যতই হম্বিতম্বি করুক সরাসরি গাজা দখল নেয়ার ব্যাপারে তারা অনিচ্ছুক। এমন কি সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্যও না। এর বিনিময়ে তারা বরং এখন বিমান থেকে কীভাবে আরো সুচারুভাবে হামলা করা যায়, ড্রোন দিয়ে কীভাবে হামলা করা যায়, আর্টিলারি কীভাবে আরে নিখুঁতভাবে ব্যবহার করা যায় এসব শিখবে। ভুলেও তারা এবার স্থলবাহিনী পাঠাবে না। ২০১৪ সালের ভুল শোধরানোর এ তাদের সুবর্ণ সুযোগ। 

নগ্ন সত্য হচ্ছে, অস্ত্র কারবারিরা, সমরবিদরা, বিশ্বের নিয়ন্ত্রকরা চুপচাপ বসে সব দেখবেন আর শিখবেন। সামনের পৃথিবীকে দূরবর্তী যুদ্ধ (রিমোট ওয়ারফেয়ার) মোকাবিলা করতে হবে। এ-হচ্ছে তার মহড়া। গাজায় যারা মরছে, সারাজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে তারা গিনিপিগের চেয়ে একটু মূল্যবান কেবল।