মতামত

এভারেস্টের চূড়ায় হিলারি না তেনজিং কে প্রথম উঠেছিলেন? 

‘নয় নম্বর ক্যাম্পের সেই সকালের কথা আমার খুব মনে পড়ে। ২৮ হাজার ফুট উচ্চতায় ছোট্ট একটি তাবুতে আমি এবং হিলারি সেই রাত কাটিয়েছিলাম। আর এই রাতটিই ছিল আমাদের সর্বোচ্চ উচ্চতার ঘুম। রাতে প্রচণ্ড ঠান্ডা পড়েছিল। হিলারির বুট জোড়া তাবুর বাইরে থাকায় ঠান্ডায় জমে গিয়েছিল। আমরাও প্রায় ঠান্ডায় জমে গিয়েছিলাম। যখন আমরা হামাগুঁড়ি দিয়ে তাবুর বাইরে তাকালাম তখন দেখতে পেলাম চারদিকে ধূসর আলো। বাতাসও তেমন ছিল না। আকাশ ছিল পরিষ্কার ও শান্ত। আমরা দেখছি সপ্তাহ মাস ধরে। এভারেস্টের চূড়া আমাদের নিকটেই। আমাদের আকাশসম স্বপ্নটা এখন আর দূরের স্বপ্ন নয়। কিন্তু এটাও সত্য যে, শক্ত পাথর ও তুষার আরোহণ কঠিন হবে। তবু আমরা প্রস্তুত এবং এটি আমরা আরোহণ করবো।’ এভাবেই অনুভূতি প্রকাশ করেছেন তেনজিং নোরগে তার এভারেস্ট আরোহণ প্রসঙ্গে। 

সাউথ কলে তুষার ঝড়ে আটকে পড়ে দুটো দিন নষ্ট করে ২৮ মে ৮ হাজার ৫০০ মিটার উচ্চতায় বহু কষ্টে তাঁবু ফেলেন। ভয়ঙ্কর সেই অনিশ্চয়তার রাতটি কোনোভাবে কাটল। ঈশ্বর তাদের সহায় হয়েছিলেন। তাই পরিষ্কার ও শান্ত আকাশ পেয়েছিলেন। কিন্তু সামনে অপেক্ষা করছে চল্লিশ ফুট উচ্চতার পাথরের খাড়া দেয়াল। একবার পা ফসকালেই জীবন শেষ, তারা দুজনেই ভালো করে জানতেন এটি। তাই বলে কি তারা এখানেই থেমে যাবেন? না। পায়ের নিচে সব মৃত্যুফাঁদ উপেক্ষা করে এগিয়ে গেছেন তারা। ১৯৫৩ সালের ২৯ মে সকাল ১১:৩০ মিনিটের সেই ঐতিহাসিক মাহেন্দ্রক্ষণে অজয় অক্ষয় পৃথিবীর সর্বোচ্চ উচ্চতার পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্টের (৮,৮৪৮ মিটার) শিখরে পা রাখলেন এডমন্ড হিলারি ও তেনজিং নোরগে।

সব প্রতিবন্ধকতা বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মানুষের জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে বীরের বেশে তারা নেমে এলেন এভারেস্ট আরোহণের বিস্ময়কর গল্প নিয়ে। শিখর আরোহণ করে নেমে আসার পর যে মানুষটির সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল তিনি ছিলেন এই ঐতিহাসিক অভিযানের আরেকজন সদস্য জর্জ লোয়ে। জর্জ লোয়ে ছিলেন হিলারির ঘনিষ্ঠ বন্ধু। জর্জ লোয়ে হিলারি ও তেনজিং-এর জন্য গরম স্যুপ হাতে নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। বন্ধুকে দেখে হিলারি কাছে এসে বললেন, ‘Well, George, we knocked the bastard off.’ তার এই কথাটি এখন ঐতিহাসিক অনুভূতি প্রকাশ হিসেবে অমর হয়ে আছে।

এডমন্ড হিলারি এবং তেনজিং নোরগে

এভারেস্টে প্রথম অভিযান হয় ১৯২১ সালে। তারপর ১৯২২ ও ১৯২৪ সালে আরো দুটি অভিযান হয়। আর এই তিনটি অভিযানেই অংশ নেন বিখ্যাত পর্বতারোহী জর্জ ম্যালোরি। তিনি ছিলেন পাইওনিয়ার ব্রিটিশ পর্বতারোহী। তিনি পৃথিবীর সব পর্বতারোহীর পথিকৃৎ এবং একজন অনুপ্রেরণাদানকারী পর্বতারোহী। এভারেস্টে তাঁর তৃতীয় অভিযানের সময় ১৯২৪ সালের ৮ জুন বেলা ১২:৫০টায় তাঁকে ও সঙ্গী এ্যান্ড্রু আরভিনকে শেষবারের মতো দেখা যায় শিখর থেকে ৮০০ ফুট নিচে। মাত্র ৩৮ বছর বয়সে এভারেস্টের চিরশ্রেষ্ঠ প্রতিদ্বন্দ্বী চিরতরে হারিয়ে যান সেই এভারেস্টেই।

হিলারি ও তেনজিং-এর এভারেস্ট আরোহণের ঠিক আগের বছর ১৯৫২ সালের শুরুতে এক সুইস অভিযাত্রী দল এভারেস্ট অভিযান করে। প্রচণ্ড খারাপ আবহাওয়ার কারণে তারা চূড়া থেকে মাত্র ৮০০ ফুট নিচ থেকে ফিরে এসেছিলেন। ১৯৫৩ সালে শুরু হলো ব্রিটিশ অভিযান। জন হান্টের নেতৃত্বে এই অভিযাত্রী দলের সদস্য হিসেবে ছিলেন টম বুর্দিল, চার্লস ইভান্স, আলফ্রেড গ্রেগরি, জর্জ লোয়ে এবং এডমন্ড হিলারিসহ আরো অনেক বিখ্যাত পর্বতারোহী। এই অভিযান ছিল সব দিক থেকেই ঐতিহাসিক। ২০ জন শেরপা, ৩৬২ জন কুলি, চারশতাধিক অভিযাত্রী এবং তাদের জন্য দশ হাজার পাউন্ড মালপত্র নিয়ে ছিল এই বৃহৎ অভিযান।  ২৬ মে প্রথম শৃঙ্গজয়ের চেষ্টা করেন টম বুর্দিল ও চার্লস ইভান্স। কিন্তু ইভান্সের অক্সিজেন সিলিন্ডারে সমস্যা দেখা দিলে চূড়ার ৩০০ ফুট নিচ থেকে ফিরে আসেন। এরপর চূড়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ান হিলারি এবং তেনজিং। আর তারাই ইতিহাস রচনা করেন।

এভারেস্ট জয়ের খবর পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে গেল। হিলারি ও তেনজিং হয়ে উঠলেন জাতীয় বীর। অভিযানের দলনেতা জন হান্ট ও হিলারিকে ইংল্যান্ডের রানী এলিজাবেথ ‘নাইটহুড’ উপাধিতে ভূষিত করলেন। কিন্তু তেনজিং নোরগে ব্রিটিশ উপনিবেশের নাগরিক না হওয়ার কারণে উপাধিটি পেলেন না। তবে বিদেশিদের জন্য সর্বোচ্চ সম্মান ব্রিটিশ এম্পায়ার মেডেল বা জর্জ মেডেল পেলেন তিনি। এরপর শুরু হলো নতুন প্রশ্ন- হিলারি না তেনজিং এভারেস্টে কে প্রথমে আরোহণ করেছেন? এটা শুধু একটা প্রশ্নের মধ্যেই আটকে রইলো না- জন্ম দিলো নতুন এক বিতর্কের।

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে এই বিষয় নিয়ে এডমন্ড হিলারি বলেন, ‘১৯৫৩ সালের ২৯ মে’র সেই সকাল থেকেই, যখন তেনজিং এবং আমি প্রথমবারের মতো পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ আরোহণ করতে সক্ষম হলাম, আমাকে এক মহান অভিযাত্রী হিসেবে বর্ণনা করা হতে থাকে। কিন্তু আমি আসলে স্রেফ এক পোড় খাওয়া কিউয়ি, যে জীবনের বহু প্রতিকূলতা উপভোগ করেছে মনে-প্রাণে।’ হিলারি তার নিজের আত্মজীবনী ‘High Adventure’ এবং তার আরেকটি বই ‘View from the Summit’-এ লিখেছেন: ‘আমরা একসঙ্গে শীর্ষে পৌঁছালাম।’

এভারেস্টের চূড়ায় হিলারির তোলা ছবি। আইস-এক্স হাতে তেনজিং নোরগে দাঁড়িয়ে আছেন

এই প্রশ্নের উত্তর যে শুধু হিলারিকেই দিতে হয়েছে তা নয়। এক হিলারির উত্তরে এই বিতর্কের অবসান ঘটলো না। তেনজিংকেও এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে অসংখ্যবার। তারা এক পর্যায়ে এই প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। তেনজিং একটা সময় বিরক্ত হয়ে জবাব দেন, ‘যদি এভারেস্টে হিলারির এক কদম পিছনে থেকে দ্বিতীয় মানুষ হিসেবে আরোহণ কোন লজ্জাজনক বিষয় হয়ে থাকে, তাহলে এই লজ্জা নিয়েই আমাকে বাকি জীবন অতিবাহিত করতে হবে।’ তিনি তার আত্মজীবনী ‘Man of Everest’ বইতেও এই বিষয়ে স্পষ্ট করে বলেছেন: ‘হিলারিই প্রথম শিখর জয় করেছিলেন এবং সেই চল্লিশ ফুট উঁচু আপাত-অসম্ভব পাথুরে দেয়ালটি, যার নামকরণ পরবর্তীতে করা হয় ‘হিলারি স্টেপ’, অতিক্রমের উপায় হিলারিই খুঁজে বের করেছিলেন এবং আমি তাকে কেবল অনুসরণ করে শিখরে পৌঁছেছিলাম।’ 

প্রথম এভারেস্ট আরোহণের সময় চূড়ায় দাঁড়ানো শুধু একটি ছবিই সারা পৃথিবী দেখেছে। আর সেই ছবিতে আইস-এক্স হাতে তেনজিং নোরগে দাঁড়িয়ে আছেন। এভারেস্টের চূড়ায় হিলারির কোনো ছবি নেই। এই ছবি নিয়েও অনেক প্রশ্ন ওঠে। তার জবাবে তেনজিং বলেন, ‘আমি হিলারির ছবি তুলে দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু অজ্ঞাত কোনো কারণে হিলারি নিষেধ করেন এবং বলেন- শিখরে কে আগে উঠেছে সেটা কাউকে না বলতে।’ হিলারি যে শুধু একজন এভারেস্ট আরোহণকারী বিখ্যাত পর্বতারোহীই ছিলেন না, তিনি এভারেস্টের মতো বড় মনের মানুষও ছিলেন। 

প্রচারবিমুখ মানুষ এই হিলারিই প্রথম ব্যক্তি যিনি ‘তিন মেরু’ অর্থাৎ পৃথিবীর তিন মেরু- উত্তর দক্ষিণ এবং এভারেস্ট জয় করেন। ভাবতে অবাক লাগছে? তাহলে আসুন আরো একটু অবাক করা তথ্য দেই। উত্তর মেরু জয়ের সময় তার সঙ্গী হিসেবে ছিলেন চাঁদে পা দেওয়া প্রথম মানুষ নীল আর্মস্ট্রং।

জর্জ ম্যালোরি ও এ্যান্ড্রু আরভিন      

এভারেস্ট অভিযানে বাংলাদেশের পর্বতারোহীরাও পিছিয়ে নেই। পর্বতারোহী এম এ মুহিত ২০১১ ও ২০১২ সালে এভারেস্ট আরোহণ করেন। দেশের প্রথম নারী হিসেবে ২০১২ সালে এভারেস্ট আরোহণ করেন নিশাত মজুমদার এবং দ্বিতীয় নারী হিসেবে একই বছর এভারেস্ট আরোহণ করেন ওয়াসফিয়া নাজরীন। ২০১৩ সালে পর্বতারোহী সজল খালেদ এভারেস্ট আরোহণ করে নেমে আসার পথে মৃত্যুবরণ করেন। 

এভারেস্ট অভিযান শুরু হয়েছিল সেই ১৯২১ সালে যা এখনো থামেনি। যদিও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারণে অভিযান সাময়িক বন্ধ থেকেছে। প্রতি বছরই অজয়কে জয় করার রোমাঞ্চ প্রিয় দুঃসাহসীক মানুষগুলো অজানা আকর্ষণে সম্মোহিত হয়ে ছুটে আসেন এই মহাধিরাজ শ্বেতশুভ্র পুতপবিত্র এভারেস্টের কাছে। কেউ কেউ তার লক্ষ্যে পৌঁছান, কেউ হরিয়ে যান বরফ শীতলতায়।