মতামত

অর্থনীতিবিদগণের সাত-পাঁচ-সতেরো

পরিবর্তনই একমাত্র চলক। ইংরেজিতে বলা হয়ে থাকে, Change is the only constant. কালের পরিক্রিমায় এ সব পরিবর্তন আমাদের ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রভাব বিস্তার করে। এবং এই পরিবর্তন অনেক ক্ষেত্রেই দৃশ্যমান।

একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। আজ থেকে এক যুগ পূর্বে আমাদের দেশে মোবাইল ফোনের প্রচলন খুবই সীমিত ছিল। ফলে গল্প, উপন্যাস কিংবা কবিতায়ও এর ব্যবহার সীমিত ছিল। কিন্তু আজকের দিনে এর ব্যবহার জরুরি দ্রব্যের (necessary goods) মতোই। সমাজ ও রাষ্ট্রে এ ধরনের যত পরিবর্তন ঘটে তার প্রতিফলন পাওয়া যায় অর্থনীতির আলোচনায়। ফলে অর্থনীতি হয়ে ওঠে একটি পরিবর্তনশীল ও গতিশীল বিজ্ঞান। যদিও বিষয় হিসেবে এটি বিজ্ঞান কিনা এ দ্বন্দ্বের অবসান হয়নি। যেহেতু মানুষের আচার-আচরণ, রীতি-নীতি নিয়ে আলোচনা হয় তাই একে বিজ্ঞান বলার অবকাশ রয়েছে। আবার যেহেতু সুনির্দিষ্ট মডেল দ্বারা কোনো কিছু ব্যাখ্যা করা যায় না তাই এটি পরিপূর্ণ বিজ্ঞান নয়।

একটি পরিবর্তনশীল ও গতিশীল বিষয় হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠার বিষয়টি বাস্তব জীবনের রসিকতায় ফুটে উঠেছে। ১৯৫০-এর দশকে অর্থনীতিতে এম. এ পাস করা এক ভদ্রলোক বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরতে গিয়ে দেখেন তার আমলে দেওয়া একই প্রশ্নে পরীক্ষা হচ্ছে। তিনি কক্ষ পরিদর্শককে একই প্রশ্নে পরীক্ষা হবার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। কক্ষ পরিদর্শক জবাব দিলেন, ‘প্রশ্ন এক ঠিক আছে, কিন্তু আজকের উত্তর ভিন্ন।’ 

সে প্রেক্ষাপটে আমাদের এগিয়ে চলা জীবনের সব পরিবর্তনের সঙ্গে অর্থনীতির দারুণ সংযোগ রয়েছে। প্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান উন্নয়ন; প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়ার এগিয়ে যাওয়া; জলবায়ু পরিবর্তনসহ অন্যান্য বিষয়ে বিশ্বজুড়ে রাষ্ট্রগুলোর অনিবার্য সমন্বয় এবং সর্বোপরী মানুষের চাহিদার প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনেক। তাই বলা হয়ে থাকে, যদি আপনি অর্থনীতি জানেন তবে কার্যত আপনি সামাজিক বিজ্ঞানের সবই জানেন।

অর্থনীতি পাঠের মূল উপজীব্য হলো মানুষ। মানুষের আচার-ব্যবহার, চাল-চলন বিশ্লেষণের যে আলোচনা হয় এটি ব্যষ্টিক অর্থনীতি (microeconomics)। আর সরকার বা দেশের সার্বিক বিষয়ে যখন আলোচনা হয় সেটি সমষ্টিক অর্থনীতি (macroeconomics)। তবে আলোচনায় যা-ই থাকুক, স্কটিশ ইতিহাসবিদ ও প্রাবন্ধিকের মতে এটি একটি নিরস বা বিষণ্ণ বিজ্ঞান (dismal science)। ব্যষ্টিক ও সমষ্টিক অর্থনীতির শ্রেণিবিন্যাসের বাইরে এর প্রায়োগিক ধারা মূলত তিনটি। এক. মাইক্রো, দুই. ম্যাক্রো বা উন্নয়ন, এবং তিন. ফাইনান্সিয়াল অর্থনীতি। এর মাঝে ফাইনান্সিয়াল অর্থনীতির ধারণা বেশ জটিল। ফাইনান্স ও ইকনমিক্সের পার্থক্যগুলো আলোকপাত করা যাক।

উন্নত দেশের মোট দেশজ সম্পদের চেয়ে তার আর্থিক সম্পদের পরিমাণ অনেক অনেক বেশি। তাই সে-সব দেশে ফাইনান্সিয়াল ম্যানেজারের গুরুত্ব অধিক। ঠিক সে বাস্তবতায় আমাদের দেশের কর্মক্ষেত্রে ফাইনান্স-এ পিএইচডি করা গুণীদের চেয়ে অর্থনীতিতে পিএইচডি করা গুণীদের সংখ্যা অনেক বেশি হবে। কারণ, উন্নত দেশে ফাইনান্স-এ পিএইচডিধারীদের অতি উচ্চ বেতনে কাজের সুযোগ অনেক বেশি, তাই অন্য কারণ না থাকলে কেউ দেশে ফিরে আসেননি! দুঃখজনক হলেও সত্যি, ২০০৮ সালের মন্দার পর বড় বড় প্রতিষ্ঠান তাদের অর্থনীতিবিদদের ছাটাই করে ফাইনান্সিয়াল বিশেষজ্ঞদের নিয়োগ দিয়েছে। তবে কি অর্থনীতি না পড়ে ফাইনান্স পড়াটাই যুক্তিযুক্ত? অর্থনীতি ও ফাইনান্স-এর মূল পার্থক্যের জায়গা অন্য জায়গায়। অর্থনীতি একটি State-level যেখানে ফাইনান্স অনেকটাই firm-level এর।

এর মাঝে দুর্বোধ্য হচ্ছে ম্যাক্রো ও উন্নয়ন অর্থনীতির জন্য একটি generalized ধারণা প্রতিষ্ঠা করা। সম্পদের ভিন্নতা থাকায় প্রত্যেক দেশের আলাদা ভিশন থাকা স্বাভাবিক এবং সে বাস্তবতায় প্রত্যেক দেশের জন্য আলাদা কৌশল থাকাই যুক্তিযুক্ত। একেক দেশের উন্নয়নের জন্য একেক মডেল যা অর্থনীতিবিদদের অনন্য উচ্চতায় আসীন করেছে। মজার বিষয় হচ্ছে, অর্থনীতি এমন এক বিষয় যেখানে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়েও নোবেল পুরস্কার পাওয়া যায়! উদাহরণস্বরূপ, ইউগুন ফামা ও রবার্ট শিলার দুরকম বক্তব্য দিয়ে একই বছর অর্থাৎ ২০১৩ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। ফামা যেখানে বলেছিলেন বাজার সবসময় দক্ষ (মূলত পুঁজিবাজার) সেখানে শিলার বলেছেন বাজার দক্ষ নয়। এছাড়া, দীর্ঘমেয়াদে প্রবৃদ্ধি কীভাবে অর্জিত হবে রবার্ট সলো বহির্জনিষ্ণু তত্ত্বের (exogenous theory) মাধ্যমে সে ব্যাখ্যা দিয়ে ১৯৮৭ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। আর একই বিষয় অন্তর্জনিষ্ণু তত্ত্বের (Endogenous theory) ব্যাখ্যা দিয়ে ২০১৮ সালে পল রোমার নোবেল বাগিয়ে নিয়েছেন। ২০১৭ সালে রিচার্ড থ্যালার ভোক্তার মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে নোবেল পেয়েছিলেন যা প্রকারান্তরে অর্থনীতির যৌক্তিক আচরণ ‘নিয়ম’কে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। জর্জ বক্সের মতে, অর্থনীতির সূত্রগুলো ভুল, যদিও এর মাঝে কিছু কিছু উপকারী। ডেভিড উইলডাসিন এর মতে অর্থনীতির সূত্র মূলত দুটি। অর্থনীতির প্রথম সূত্র: প্রত্যেক অর্থনীতিবিদগণের জন্য একজন সমান ও বিপরীতধর্মী অর্থনীতিবিদ রয়েছেন। অর্থনীতির দ্বিতীয় সূত্র: তারা সবাই ভুল।

এ সব বৈপরীত্য এড়ানোর জন্য প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান একজন এক-হাতওয়ালা অর্থনীতিবিদ পছন্দ করেছেন। যদিও তা প্রায় অসম্ভব! এডগার ফিডলার বলেছেন, যদি পাঁচজন অর্থনীতিবিদকে প্রশ্ন করেন তবে আপনি পাঁচটি ভিন্ন উত্তর পাবেন। আর যদি সেটি হার্ভার্ড হয় তবে নিশ্চিতভাবে ছয়টি! জর্জ বার্নার্ড শ-এর মতে অর্থনীতিবিদগণকে একসঙ্গে নিয়ে কোনো উপসংহারে পৌঁছানো সম্ভব নয়। তাই ম্যাক্রো ও উন্নয়ন অর্থনীতির আলোচনায় উপসংহার আশা না করাই বুদ্ধিমানের কাজ।

তবে আলোচ্যসূচি যা-ই হোক, অর্থনীতির শিক্ষার্থীদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো অর্থনীতিবিদ হতে না পারা! মেডিক্যাল বা ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পাস করা শিক্ষার্থী স্নাতক শেষ করার পরেই নামের পূর্বে ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার লিখতে পারেন। কিন্তু একজন অর্থনীতির শিক্ষার্থীর পক্ষে তা অসম্ভব! কিন্তু কেন? অর্থনীতির চলকগুলোর সঙ্গে ব্যক্তি, সমাজ, সরকার, রাষ্ট্র প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এতটাই সম্পৃক্ত যে খুব সহজেই এর পরিবর্তন হিসাব করা সহজ নয়। যিনি এ পরিবর্তনকে ব্যাখ্যা ও উপস্থাপনা করতে পারবেন তিনিই নিজেকে অর্থনীতিবিদ হিসেবে দাবি করতে পারবেন। ঢাকার রাস্তায় রিকশা চলাচল বন্ধ করে দিলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যয় বেড়ে যেতে পারে! এছাড়া, টাকার পরিমাণ বেড়ে মুদ্রাস্ফীতি হলে আপনার বাড়ির পুকুরের পানিও কমে যেতে পারে! যিনি পরিবর্তনগুলো যত সতর্কতার সঙ্গে পরিমাপ করতে পারবেন তিনিই তত বড় অর্থনীতিবিদ। তবে নিঃসন্দেহে অনেক কঠিন কাজ। থমাস কার্লাইলের মতে, অর্থনীতি তোতা পাখিকে শুধু ‘demand-supply’ শিখানোর মতো কোনো বিষয় নয়। এর ব্যাপ্তি ও বিশালতা অনেক। মানুষের জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত চলকগুলোর গভীর সংযোগ এবং মানুষের চাহিদার ক্রমবর্ধমান পরিবর্তন অর্থনীতির বিষয়বস্তুতে অনুপম মাত্রা যোগ করেছে ও করছে।

বিষয়ের ক্রমবর্ধমান এগিয়ে চলায় অর্থনীতিবিদগণ অনেক ক্ষেত্রে ছলনার আশ্রয় নিয়ে থাকেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গাণিতিক মডেলের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাওয়ায় এ ধরনের বিকৃতির প্রমাণ রয়েছে। তারা কাউকে convince করতে ব্যর্থ হলে confuse করে রাখছেন। বলতে দ্বিধা নেই, অর্থনীতিবিদগণ অনেক কারণেই ব্যর্থ। তাঁরা মানুষের চাহিদা মেটানো বা আয় ও আয়-বহির্ভূত বৈষম্য কমাতে ব্যর্থ হয়েছেন। সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হলো মন্দা কিংবা মহামন্দা সম্পর্কে ভবিষ্যৎ বাণী করতে না পারা। পিটার জে লরেন্স বলেছেন, অর্থনীতিবিদ হলেন সে ব্যক্তি যিনি গতকাল যা ভবিষ্যৎ বাণী করেছিলেন তা কেন হয়নি সেটি নিয়ে আজ ব্যস্ত সময় পার করছেন। মারটি এলেন বলেছেন, অর্থনীতিবিদের মতে কোনো কিছু কেনার জন্য সবচেয়ে ভালো হলো গত বছর। 

অর্থনীতিবিদগণ সবাইকে গিনিপিগ মনে করেন যদিও বাস্তব জীবনের সঙ্গে এর বিষয়বস্তুর কোনো হিসাব মিলাতে চান না। কেউ যদি বৃষ্টিতে ভিজে তবে একজন অর্থনীতিবিদ দেখতে চাইবেন তার জ্বর এসেছে কিনা, এসে থাকলে হাসপাতালের খরচ হবে কিনা, কত টাকার ওষুধ লাগবে, ইত্যাদি, ইত্যাদি। তাই মার্কিন গায়ক ও অভিনেতা বলেছেন, “Some people feel the rain – others just get wet”। একজন অর্থনীতিবিদ হয়তো বৃষ্টিতে শুধু ভিজেই শেষ, অনুভব করতে ব্যর্থ! সে জন্যই নিউক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ও একজন স্বনামধন্য মিউজিসিয়ান বলেছেন, ‘Think my economics profession is very dangerous; my music gives people great pleasure’.  

লেখক: উন্নয়ন অর্থনীতি গবেষক