মতামত

পরীমনি থেকে প্রান্তিক নারী: নিরাপদ কে?

ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে মামলা করেছেন দেশের অন্যতম শীর্ষ চলচ্চিত্রশিল্পী পরীমনি। মামলা করেছেন ব্যবসায়ী নাসিরউদ্দীন মাহমুদ এবং তার কয়েকজন সহযোগীর বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় নাসিরউদ্দীনসহ পাঁচজন গ্রেপ্তারও হয়েছে।

পরীমনি অভিযোগ করেছেন, ভিকটিম হওয়ার পর তিনি পুলিশের সাহায্য চেয়েছেন কিন্তু তার অভিযোগ আমলে নেওয়া হয়নি। আশঙ্কার কথাটি এখানেই। একজন মানুষ হয়রানি বা ছোট-বড় যে কোনো ক্রাইমের শিকার হলে পুলিশের কাছে যাবে সেটাই স্বাভাবিক। সেখানে গিয়ে সে কোনো সহযোগিতা পাবে না, তার অভিযোগ গ্রাহ্য করা হবে না এটা কেমন কথা?

একজন মানুষকে অভিযোগ দায়ের করতে হলেও সংবাদ সম্মেলন করতে হবে, প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন জানাতে হবে কেন? পরীমনি দেশের একজন প্রথিতযশা অভিনয়শিল্পী। তারই যদি সংবাদ সম্মেলন করে, প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন জানিয়ে তবে অভিযোগ দায়ের করার সুযোগ পেতে হয় তাহলে যারা সাধারণ নারী, যারা প্রান্তিক অবস্থানে আছেন তারা যখন কোনো প্রবল প্রভাবশালী বা ধনীর দ্বারা নির্যাতনের শিকার হবে তখন তারা কীভাবে বিচার পাওয়ার আশা করতে পারে? বিচার তো দূরের কথা, সে তো প্রবল প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ করারই সুযোগ পাবে না।

পরীমনির মতো আর্থিক ও সামাজিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত নারীকেই যদি এভাবে নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশবাসীর সামনে এসে কাঁদতে হয়, আর্তনাদ করতে হয় তাহলে প্রত্যন্ত গ্রামের যে হতদরিদ্র নারী রয়েছেন তার অবস্থা যে কোথায় সে কথা ভাবতেও আতঙ্ক লাগে। 

এ দেশের ধনী নারী থেকে শুরু করে দরিদ্র নারী- কে নিরাপদ এই প্রশ্নটি মনে জাগতে বাধ্য। নারী যে কি হারে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে সেটি যে কোনো একদিনের একটি দৈনিক পত্রিকার পাতা উল্টে দেখলেই বোধগম্য হয়। কোথায় নিরাপদ নারী? ঘর থেকে শুরু করে পথে, ঘাটে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, হাসপাতালে, গণপরিবহণে, কর্মক্ষেত্রে- সর্বত্র নারী হত্যা, ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। আট মাসের শিশু থেকে শুরু করে আশি বছরের বৃদ্ধা ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির ভিকটিম। একটি দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠিকে যদি সবসময় আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হয় তাহলে সেই দেশের উন্নয়ন যে কি অবস্থায় আছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কোনো অর্থনৈতিক উন্নয়নসূচক দিয়েই সে দেশের সমাজ জীবনের করুণ ও আতঙ্কজনক চিত্র ঢাকা যায় না। 

কিন্তু নারীর প্রতি সহিংসতার এমন ভয়াবহ চিত্র কেন দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের সমাজে? এর কারণ হলো নারীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গীর দৈন্য, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, ধর্ষণ ও যৌন হয়রানিকে সেকেন্ডারি অপরাধ বলে মনে করা এবং এ ধরনের অপরাধকে গুরুত্বের সঙ্গে না নিয়ে ভিকটিম ব্লেইমিং করা।  আমাদের সমাজে কোনো নারী ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির শিকার হলেই শুরু হয়ে যায় ভিকটিমের চরিত্র আলোচনা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাকে নিয়ে চলে ট্রল। ভিকটিমের চরিত্র আলোচনার মাধ্যমে অপরাধের গুরুত্ব হ্রাস করার একটা অপচেষ্টা চলে। 

কিছুদিন আগে মুনিয়া নামে এক তরুণীর মৃত্যর ঘটনা এবং তার কথিত প্রেমিক ধনকুবের আনভীরের সংশ্লিষ্টতার ঘটনায়ও একই প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। মৃত নারীকে ‘রক্ষিতা’ হিসেবে সম্বোধন অথচ তার কথিত প্রেমিকের পরিচয় আড়াল করার চেষ্টা, মৃত নারীর জীবনাচরণের বিস্তারিত আলোচনা এবং সংশ্লিষ্ট পুরুষের লাম্পট্য ও জীবনাচরণ বিষয়ে মৌনতা- পুরোটাই সমাজের একপেশে দৃষ্টিভঙ্গীর চরম উদাহরণ। 

পরীমনির ক্ষেত্রেও একই মানসিকতার পুনরাবৃত্তি চোখে পড়ছে। পরীমনিকে নিয়েও শুরু হয়েছে ট্রল। তিনি কেন বোট ক্লাবে গেলেন, তার জীবনাচরণ কেমন, তার চরিত্র কেমন এসব নিয়ে চলছে আলাপ আলোচনা। অথচ এর মাধ্যমে কিন্তু চাপা পড়ে যাচ্ছে তার অভিযোগের গুরুত্ব। 

এদেশের আইনে কোথাও লেখা নেই যে একজন নারী বোট ক্লাব বা কোনো জায়গায় যেতে পারবেন না। কোথাও আইনে উল্লেখ নেই যে একজন নারী কেমন জীবনাচরণ করবেন। কোনো আইনে নেই ভিকটিমের ‘চরিত্র’ ঠিক কেমন হলে তিনি বিচার দাবি করতে পারবেন। কিন্তু আইনগতভাবে অপরাধ হলো কাউকে হত্যা ও ধর্ষণের চেষ্টা করা, শারীরিকভাবে আঘাত করা, যৌন হয়রানি করা। পরীমনি বা যে ভিকটিমই হোন বা অভিযোগকারী হোন আর অভিযুক্ত বা নির্যাতনকারী যেই হোক, আইন ও পুলিশ প্রশাসনের কাছে সবার অবস্থানই সমান হওয়া উচিত। সবারই রয়েছে অভিযোগ দায়ের করা, বিচার চাওয়ার এবং পাওয়ার অধিকার। ভিকটিমের চরিত্র আলোচনা এখানে একেবারেই অবান্তর।

দরকার হলো অপরাধের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স, অভিযুক্তর সম্পর্কে সুষ্ঠু তদন্ত, ভিকটিমকে শেল্টার ও মানসিক সমর্থন দান। আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিকটিমকে নিয়ে ট্রল, তার চরিত্র নিয়ে রসালো আলাপ প্রমাণ করে একটি সমাজের মানসিক দৈন্য! যারা এগুলো করে সন্দেহ জাগে তারা আদৌও মানুষ কিনা? এই ধরনের ভিকটিম ব্লেইমিংয়ের কারণে চাপা পড়ে যায় অপরাধের ভয়াবহতা। 

যে সমাজে নারীর প্রতি সহিংসতা অহরহ ঘটতে থাকে, যে সমাজে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় না, যে সমাজে ক্ষমতা ও টাকার জোরে, প্রতিপত্তির জোরে অপরাধী বুক ফুলিয়ে বেড়ায় এবং ভিকটিমকে প্রাণ হারানোর ঝুঁকিতে থাকতে হয় বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রাণ হারাতে হয় সে সমাজ আর্থিকভাবে উন্নতি করলেও তাকে বর্বর সমাজ বলেই অভিহিত করতে হয়। 

এদেশে কয়টি নারী নির্যাতনের বিচার হয়েছে? কয়টিতে অপরাধী শাস্তি পেয়েছে? অসংখ্য নারী নির্যাতনের মামলার কয়টির সুরাহা হয়েছে? এককথায় নগণ্য। অসংখ্য ও ভয়াবহ পরিমাণের নারী নির্যাতনের মামলার তুলনায় অপরাধীর বিচার হয়েছে মুষ্টিমেয় কয়েকটি ক্ষেত্রে। মামলার দীর্ঘসূত্রিতা, অপরাধীর ক্ষমতা ও প্রভাব প্রতিপত্তি, মামলার সময় আসামী পক্ষের উকিলের অশোভন ও অবান্তর জেরা, নির্যাতনের ঘটনা বারবার ভিকটিমকে বলতে বাধ্য করে, তাকে মানসিক বিপর্যয়ের চূড়ান্ত সীমায় নিয়ে যাওয়ার কারণে অনেক ভিকটিম মামলা তুলে নিতে বাধ্য হয়। অনেকে হতাশ হয়ে চুপ করে যায়। আর সামাজিকভাবে তাকে হেয় করার প্রক্রিয়াটি তো চলতেই থাকে। এই দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন অবিলম্বে। 

পরীমনির অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত হোক, দোষীদের কঠোর শাস্তি হোক, চাওয়া শুধু এইটুকু নয়। বরং প্রতিটি নারী নির্যাতনের ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চাই। প্রতিটি হত্যা, ধর্ষণ, অপমৃত্যু ও হয়রানির বিচার চাই। মানসিক ট্রমা থেকে ভিকটিমকে বেরিয়ে আসার জন্য চাই কাউন্সিলিংয়ের সুযোগ, চাই মানসিক সমর্থন এবং অবশ্যই ভিকটিমের, সারভাইভারের জন্য আশ্রয় কেন্দ্র, আইনগত সহায়তা। চাই নারীবান্ধব পুলিশ স্টেশন। চাই নারীবান্ধব মানবিক সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা।