মতামত

আফগানিস্তানে বদলে যাওয়া তালেবান এবং বাস্তবতা

১৯২৭ সালে শান্তিনিকেতন থেকে পড়াশোনা শেষ করে মাত্র ২৩ বছর বয়সে ‘কাবুল কৃষি কলেজে’ শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন সৈয়দ মুজতবা আলী। সেখানে ছিলেন দুই বছর। সে অভিজ্ঞতার আলোকে লিখেছেন ‘দেশে বিদেশে’ নামে বাংলা ভ্রমণসাহিত্যের এক কালজয়ী সৃষ্টি। সেখানে আফগানদের জীবনযাত্রা ও মনোজগৎ নিয়ে রম্যরসের আড়ালে সূক্ষ্ম সমাজবীক্ষণ তুলে ধরেছেন।

মুজতবা আলী লিখেছেন, ‘উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত ভারতবর্ষের গ্রামে গ্রামে কর্ণধার ছিলেন মৌলবী-মোল্লা, শাস্ত্রী-ভট্টাচার্য। কিন্তু এঁরা দেশের লোককে উত্তেজিত করে ইংরেজের উচ্ছেদ সাধন করতে পারেননি, অথচ আফগান মোল্লার কট্টর দুশমনও স্বীকার করতে বাধ্য হবে যে, ইংরেজকে তিন-তিনবার আফগানিস্তান থেকে কান ধরে বের করবার জন্য প্রধানত দায়ী আফগান মোল্লা’।

আজ সৈয়দ মুজতবা আলী বেঁচে থাকলে মোল্লাদের কাবুল জয় দেখে হয়ত লিখতেন আরো অনেক কথা। কান ধরে বহিষ্কারের তালিকায় যুক্ত হতো সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র। দুই বিশ্বমোড়ল। কিন্তু এ নিয়ে ৯৪ বছর আগে খুব একটা স্বস্তিতে ছিলেন না মুজতবা আলী। তিনি লিখেছেন, ‘ইংরেজ রুশকে ঠেকিয়ে রাখাই কি আফগানিস্তানের চরম মোক্ষ?’

সেই সময় উপলব্ধি করেছিলেন তৎকালীন সম্রাট আমানউল্লাহ। বিশেষ করে তার শ্বশুর মাহমুদ বেগ তর্জি ও সম্রাজ্ঞী সুরাইয়া। তাদের চাপে সম্রাট ব্যাপক সংস্কারমূলক কার্যক্রম হাতে নিয়েছিলেন। নারী-পুরুষ সবার শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেছিলেন। মেয়েদের জোর করে বিয়ে দেওয়া, এক পুরুষের একাধিক বিয়ে, ১৬ বছরের আগে মেয়েদের বিয়ে নিষিদ্ধ করা, মেয়েদের শিক্ষা এবং ভোটদানের অধিকারও দেন আমানউল্লাহ খান। সব শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিশুদের জন্য জেলায় জেলায় আবাসিক স্কুল খোলা হয়। তাঁর সেসব সংস্কারমূলক কাজের বিস্তারিত বর্ণনা মেলে সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখায়। 

১৯২১ সালে কাবুলে প্রথম মেয়েদের জন্য মাসতুরত প্রাথমিক স্কুলের প্রতিষ্ঠা করেন সম্রাজ্ঞী সুরাইয়া। পরবর্তী কালে মেয়েদের জন্য একাধিক স্কুল খোলেন তিনি। ১৯২৮ সালে ওই সমস্ত স্কুল থেকে বাছাই করা ১৫ জন পড়ুয়াকে উচ্চশিক্ষার জন্য তুরস্ক পাঠায় আমানউল্লাহ সরকার। কিন্তু সুরাইয়ার এসব বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত প্রাচীনপন্থীদের জন্য শিরোপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সুরাইয়ার নকল কিছু নগ্ন ছবি পুস্তক আকারে প্রকাশ করে আফগানিস্তানের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দেয় তারা। তাতেই দেখা দেয় গণ-বিক্ষোভ।

১৯২৮ সালে আমানউল্লা-সুরাইয়া ইউরোপ সফরে গেলে বিক্ষোভ চূড়ান্ত রূপ নেয়। কমিউনিস্ট ও মোল্লা সবাই একাত্ম হয় রাজশাসনের অবসান ঘটাতে। সোভিয়েত ইউনিয়নও সরকার বিরোধীদের ভেতরে ভেতরে সহযোগিতা করতে থাকে। জালালাবাদ থেকে একদল বিদ্রোহী রাজধানীর দিকে অগ্রসর হলে সেনাবাহিনী প্রতিরোধের বদলে তাদের সঙ্গে একাত্ম হয়। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জানুয়ারি আমানউল্লাহ খান তার ভাই এনায়েতউল্লাহ খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে ব্রিটিশ ভারতে পালিয়ে যান। এর তিনদিন পর বিদ্রোহীরা এনায়েতউল্লাহ’র কাছ থেকেও ক্ষমতা কেড়ে নেয়।

এই বিদ্রোহী দলের নেতা ছিলেন সেনাবাহিনীর সাবেক এক পানিবাহক। নাম হাবিবউল্লাহ কালাকানি। কাবুলের আর্গ প্রাসাদ দখল করার পর কালাকানি ৭,৫০,০০০ ব্রিটিশ পাউন্ডের সন্ধান পান। এ থেকে সৈনিকদের বেতন দেয়া হয়। তিনি প্রাসাদ থেকে ফুলের গাছ তুলে সেখানে সবজি রোপণের নির্দেশ দেন। তিনি নারীদের বিদ্যালয় ও পশ্চিমা শিক্ষকেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দেন। কিন্তু কালাকানিও বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে পারেননি। নাদির খান ১৯২৯-এর ৩১ অক্টোবর কাবুল দখল করেন। পরের দিন কালাকানিকে আরো দশ অনুসারীসহ ফাঁসি দেন।

এরপর ঘন ঘন ক্ষমতার রদবদল হতে থাকে। রুশ আগ্রাসন, তালেবানদের প্রথম দফার ক্ষমতা আরোহণ, আমেরিকার কাবুল দখল- সবই এর পরের ধারাবাহিকতা। ১৯২৯-এর পর, অর্থাৎ ৯২ বছর ধরে আফগানিস্তানের কোনো সরকার স্থৈর্য পায়নি। এর মধ্যে অন্তত ৪১ বছর যারা কাবুলের মসনদে ছিল, তারা সবাই বিতর্কিত ছিল। পৃথিবীর সকল দেশে তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন দেয়নি। আরো ট্র্যাজিক বিষয়, এতো বছরের পুরনো একটা দেশে এখনো পর্যন্ত একটা সর্বজনমান্য সাধারণ নির্বাচন হয়নি। কেউ সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পথে ক্ষমতায় আসেনি। 

এর কারণ কী? এর কারণ এই দেশটির জাতিগত বিন্যাসে নিহিত আছে। এখানে ১০টি বড়ো জাতিগোষ্ঠী আছে। এরও অধিকসংখ্যক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী আছে। আফগান সম্রাটরা এই নৃগোষ্ঠীগুলোর দলপতিদের নিয়ে একটা ফেডারেল গভর্নমেন্ট ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। একেকটি নৃগোষ্ঠী একেকটি অঞ্চলে নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা ভোগ করত। তাই মাত্র তিন কোটি জনসংখ্যার দেশে ৩৪টি প্রদেশ ও চারশ’র অধিক জেলা। কিন্তু সোভিয়েত আগ্রাসনের পর এই ব্যবস্থা ভেঙে দেয়ার জোর চেষ্টা চালানো হয়। তারা চেয়েছিল পুরো জাতিকে একীভূত করতে। সেটাই রুশদের বড়ো ভুল ছিল।

এখানে আরো একটা প্রসঙ্গ আছে। যেটা বর্তমানে কারো বিশ্লেষণে পাওয়া যায় না। সৈয়দ মুজতবা আলী দেখিয়েছেন, কাবুলের জনগণের সঙ্গে বাকি আফগানিস্তানের মানুষের ফারাক বিস্তর। কাবুলের অধিবাসীরা বাকি আফগানদের মাথামোটা পাঠান হিসেবে দেখে। তাজিকসহ অপরাপর নৃগোষ্ঠীকে গ্রাহ্যে আনে না। এর কারণ কাবুলে প্রতিষ্ঠিতদের বড়ো অংশই ইরানী বংশোদ্ভূত। এরা শিক্ষা ও অর্থনীতিতে অনেক অগ্রসর। শাসনব্যবস্থা মূলত এদের হাতেই। কিন্তু এদের দুর্বলতার জায়গাও আছে। মুজতবা আলী লিখেছেন, ‘পাশ্চাত্য শিক্ষা পেয়েছেন এমন লোক আফগানিস্তানে দুডজন হবেন কিনা সন্দেহ। দেশে যখন শান্তি থাকে তখন এঁদের দেখে মনে হয় এঁরাই বুঝি দেশটা চালাচ্ছেন, অশান্তি দেখা গেলেই এঁদের খুঁজে পাওয়া যায় না’। ৯৪ বছর পর আশরাফ ঘানি আর হামিদ কারজাইদের অবস্থা দেখে মনে হয় পরিস্থিতি একই আছে।

গত বিশ বছরে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে ২.৬ ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। বাংলাদেশের ২০১৯ সালের জিডিপি ছিল ৩০২ মিলিয়ন ডলার। মানে এই টাকা দিয়ে বাংলাদেশের মতো ১৬ কোটি জনসংখ্যার দেশের মানুষ ৯ বছর বসে বসে খেতে পারত। আর সেখানে আফগানিস্তানের জনসংখ্যা মাত্র তিন কোটি। তাতে অন্তত আফগানিস্তানের জনগণ ৪৫ বছর পায়ে পা তুলে খাবার কথা। এই টাকার সব নিশ্চয়ই যুদ্ধে ব্যয় হয়নি। একটা অংশ আফগানিস্তানকে গড়ে তোলার কাজে ব্যয় করেছে পশ্চিমারা। না, এটা দাতব্য চিন্তা থেকে করা হয়নি। নিজেদের জন্য একটা সুন্দর কর্মস্থল তৈরি করতে পশ্চিমারা রাস্তাঘাট, অফিস আদালত বানিয়েছে। দেখবেন বিভিন্ন ভিডিওতে কী চমৎকার কাবুল-কান্দাহারের রাস্তাঘাট! কী দারুণ বিমানবন্দর! অথচ বিশ বছর আগে ছিল চারদিকে ধ্বংসস্তূপ। 

এ বিপুল অর্থ প্রবাহ আফগানদের আয়েশী জীবনে অভ্যস্ত করে তুলেছে। ক্ষমতাবানরা দুর্নীতি করে বিপুল অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছে। যে ওয়ারলর্ডরা যুগের পর যুগ যুদ্ধের ময়দানে থেকেছেন, তারাও এই অর্থের ভাগ পেয়েছেন। তারা তাদের সন্তানদের বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন উচ্চ শিক্ষার জন্য। বিপুল অর্থ ব্যয় করে নিজস্ব সৈন্যবাহিনী রাখার আর প্রয়োজন বোধ করেননি। সরকারি বাহিনীকে নিজেদের পেটুয়া বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এদিকে সরকারি বাহিনীর লোকজন মাদক ব্যবসা থেকে শুরু করে এমন কোনো অপরাধ নেই যাতে জড়ায়নি। দুহাতে পয়সা লুটেছে। এমন ভোগবাদী সৈন্যদল নিয়ে যে প্রতিরোধ গড়া সম্ভব নয় সেটা আশরাফ ঘানির মতো নৃতত্ত্বের অধ্যাপক ভালোই জানতেন। তিনি জোর দিতেন ওয়ারলর্ডদের উপর। তিনি ভেবেছিলেন এরাই প্রদেশে প্রদেশে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। 

তালেবানরা বুঝে গিয়েছিল, বিশ বছরের আরামের জীবন থেকে আর যুদ্ধে নামবে না ওয়ারলর্ডরা। শুধু এদের জান আর মালের নিরাপত্তা দিলেই এরা সুরসুর করে তাদের দলে ভিড়বে। তাই যুদ্ধের চেয়ে কূটনীতিতেই অধিক মনোযোগ দেয়া তালেবানরা। ফল মিলেছে চমৎকার! একমাত্র হেরাতের ইসমাইল খান ছাড়া কেউ তেমন কোনো প্রতিরোধ গড়েনি। ৭৪ বছরের বৃদ্ধ ইসমাইল খান একসময় নিজেই আত্মসমর্পণ করেন। 

১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত তালেবানরা যখন কাবুলের মসনদে ছিল, তখন কিন্তু উত্তরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা আহমদ শাহ মাসউদের নেতৃত্বে নর্দান এলায়েন্সের নিয়ন্ত্রণে ছিল। যা আফগানিস্তানের মোট আয়তনের ৩০ শতাংশ। কিন্তু মজার ব্যাপার উত্তরে কোনো প্রতিরোধ দেখা যায়নি। পাশতুন নেতৃত্বাধীন তালেবানদের উত্তরের তাজিক ও হাজরারা ভয় পেত। নব্বই দশকে সেসব এলাকায় তালেবানরা নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালায়। কিন্তু এবার তারা তেমন প্রতিরোধ গড়ে না তোলার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো সমঝোতা কাজ করেছে। এখানে রাশিয়ার বিশাল ভূমিকা আছে।

মাত্র ১০ দিনের মাথায় যেভাবে তালেবানরা ক্ষমতা দখলে নিলো তা বিস্ময়কর। সবচেয়ে আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ৩ লক্ষ সরকারি বাহিনী নিয়ে আশরাফ ঘানি ৬০-৬৫ হাজার তালেবান মুজাহিদিনকে মোকাবিলা করতে পারেনি। পশ্চিমা বিশ্বের কাছে এখনও বিষয়টি বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না। যেখানে তালেবানদের কোনো বিমান-শক্তি ছিল না। ছিল না ভারি আর্টিলারি সাপোর্ট। এর পেছনে যতটা না তালেবানদের সমর-শক্তি কাজ করেছে, তার চেয়ে বেশি কূটনৈতিক শক্তি কাজ করেছে। তারা বিশ্ব নেত্রীবৃন্দকে এটা বোঝাতে সক্ষম হয়েছে, আফগানিস্তানে তাদের কোনো বিকল্প নেই। কারণ পুরো আফগানিস্তানে একক কোনো শক্তি নেই। তারা ক্ষমতায় গেলে পুরো আফগানিস্তানকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। পাশাপাশি এটাও আশ্বস্ত করেছে, তাদের আচরণে অতীতের পুনরাবৃত্তি ঘটবে না। ফলে চীন রাশিয়ার মতো দেশ আফগানিস্তানে বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ পাবে।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রও বুঝে গেছে যুদ্ধ অসীম কালের জন্য হতে পারে না। হামিদ কারজাই বা আশরাফ ঘানিরা কাবুলের বাইরে অচল। তাই তারা বাধ্য হয়েছে আপোসের পথে যেতে। মার্কিনিদের প্রস্থানের ধারা দেখেই বোঝা গিয়েছিল, তালবানদের সঙ্গে একটা সমঝোতা হয়ে গেছে তাদের। ঘানিও বুঝে গিয়েছিলেন সবকিছু। মাত্র ৪৫ মিনিটের আলোচনায় কাবুল ছেড়ে পালিয়েছেন। ঘানির এই পলায়ন খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। টবে বড়ো গাছ হয় না। টবের গাছ টেকেও না বেশিদিন। কোনো দেশের সংস্কৃতি ও সমাজের সঙ্গে সরকার মিশে যেতে না পারলে, বা কোনো সংস্কৃতি ও সমাজ যদি বদলে যায়, তাহলে সরকার টিকে থাকতে পারে না। পরের কথাটা আশির দশকের ইরানের জন্য প্রযোজ্য। 

তালেবানদের প্রথম শাসন আমলে নাকি তাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোল্লা বালুচ জাতিসংঘের কাছে কিছু শল্যচিকিৎসক চেয়েছিলেন শরিয়া আইনে শাস্তিপ্রাপ্তদের হাত-পা কাটার জন্য। এ রকম অসংখ্য হটকারিতা সেসময় তালেবানরা করেছে। অপ্রয়োজনে বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি ধ্বংস করেছে। ওসামা বিন লাদেনের জন্য প্রতি জুম্মাবারে বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন হতো। গত বিশ বছরে সেসব নিশ্চয়ই তারা উপলব্ধি করতে পেরেছে। অপ্রয়োজনে বিশ্ব জনমতকে নিজেদের বিপক্ষে নিয়ে যাওয়া অর্থহীন।  একসময় যে তালেবানরা কথায় কথায় মুসলিম উম্মাহ’র কথা বলত, এখন তারা আফগান জনগোষ্ঠীর কথা বলে। তারা স্পষ্ট বলে দিয়েছে, আফগানিস্তানের বাইরে তাদের কোনো এজেন্ডা নেই। এর মানে বিশ বছর আগের তালেবান সম্ভবত এখন নেই। বিদেশী টাকায় গত বিশ বছরে আফগানিস্তানে যে উন্নয়ন হয়েছে তার সুফল তারাও পেয়েছে। সেই সুন্দর অবকাঠামো ধ্বংস করে নিজের দেশের ক্ষতির কোনো মানে হয় না, তা তারা বুঝতে পেরেছে। তাই দেখা গেছে কাবুলের নগরদুয়ারে তাদের অপেক্ষা করতে। কোনো প্রকারে ধ্বংসযজ্ঞ না চালিয়েই শহরে প্রবেশ করেছে। 

গত শাসন আমলে তাদের প্রধান নেতা ছিলেন মোল্লা ওমর। তার কোনো ভিডিও তো দূর, একটা স্পষ্ট ছবি পর্যন্ত মিলে না। কিন্তু এখন তালেবানদের নেতারা অহরহ টিভিতে কথা বলছেন। তালেবান সৈনিকরা মোবাইলে ভিডিও করে পোস্ট দিচ্ছে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে। কাবুলের প্রেসিডেন্ট ভবন ভর্তি পেইন্টিং আছে। সেসব বিনষ্ট করার কোনো সংবাদ পাওয়া যায়নি। তারা নারীদের শিক্ষা ও চাকরির নিশ্চয়তা দিয়েছে। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর তালেবানরা কমিউনিস্ট প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাজিবুল্লাহ ও তার ভাইকে প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে। কিন্তু এবার তারা সাধারণ ক্ষমা শুধু ঘোষণা করেনি, যারা পালিয়ে যেতে চায় তাদের পথও উন্মুক্ত করে দিয়েছে। কোনো প্রতিহিংসামূলক হত্যাকাণ্ডের খবর পাওয়া যায়নি।

এর পেছনে গত বিশ বছরের অভিজ্ঞতা ও পরিণমন কাজ করেছে। ১৯৯৬ সালে যখন তালেবানরা ক্ষমতায় যায় মোল্লা ওমর বা তার প্রধান সহযোদ্ধাদের বয়স ছিল ত্রিশের ঘরে। শরীরে যৌবনের উত্তাপ। তারা চেয়েছিল পুরো পৃথিবীকে পাল্টে দিতে। পৃথিবী সম্পর্কে তাদের সম্যক ধারণা ছিল না। তারা লেখাপড়া করেছে মক্তব মাদ্রাসায়। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে অজ্ঞ ছিল। কিন্তু আমেরিকার আগ্রাসনের পরই তারা দেখতে পেল পৃথিবীটা তাদের কল্পনার চেয়ে কঠিন। সেখানে অনেক চমকপ্রদ আবিষ্কার হয়ে গেছে। শুধু হাতে বহনযোগ্য অস্ত্র দিয়ে বেশি কিছু করা যাবে না। পৃথিবীকে পাল্টানোর চেয়ে নিজেদের পাল্টানো অনেক সহজ। এর মধ্যে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে তাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক পাকিস্তানও অনেক নির্জীব। পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে ধর্মীয় উগ্রবাদের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি হয়েছে। তাই পাকিস্তানও চায় শান্ত সুবোধ তালেবান। তালেবানদের মুখপাত্র সোহেল হুসাইন বারবার বলছেন তারা একটি ‘ইনক্লুইসিভ গর্ভনমেন্ট’ চায়। এসবই ইতিবাচক দিক।

কিন্তু তালেবান তথা আফগানরা খুবই আনপ্রেডিকটেবল। গত জুলাই মাসে তালেবানদের কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক কমিশন থেকে ১৫ বছরের বেশি বয়সী মেয়েদের তালিকা চেয়ে দখলে থাকা শহরগুলোর ধর্মীয় নেতাদের উদ্দেশে একটি নির্দেশনা জারি করেছে। তালেবান যোদ্ধাদের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার জন্য পাত্রী চেয়ে দেওয়া ওই নির্দেশনায় বলা হয়েছে, পাত্রীদের বয়স ১৫ বছরের বেশি হতে হবে। বিধবা নারী হলে বয়স ৪৫ বছরের নিচে হতে হবে। বোরকা না পরার কারণে এক নারীকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যারও অভিযোগ এসেছে। বিভিন্ন স্থানে নারীর ছবি মুছে ফেলার কাজ শুরু হয়েছে। এসব আবার ভিন্ন বার্তা দিচ্ছে।

সবচেয়ে ইতিবাচক দিক প্রায় অর্ধ শতাব্দী পর পুরো আফগানিস্তান একটি কেন্দ্রীয় শাসনের মধ্যে এসেছে। এখন এটাকে যত ভালোভাবে চালানো যাবে তত দ্রুত আফগানিস্তানের উন্নতি হবে। তবে এই উন্নতি নির্ভর করছে তালেবান নেতৃত্বের ছাড় দেয়ার মানসিকতা ও বাস্তবমুখী সিদ্ধান্তের উপর।

লেখক: কথাসাহিত্যিক