মতামত

ট্রিলিয়ন ডলার খনিজ সম্পদের আফগানিস্তান ভূ-রাজনীতির শিকার 

সালেক সুফী। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গ্যাস ও জ্বালানি সেক্টরে কাজের বিপুল অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। আফগানিস্তানেও দীর্ঘ সময় জ্বালানি নিয়ে বিদেশী সংস্থার সঙ্গে কাজ করেছেন। খুব কাছ থেকে দেখেছেন আফগানিস্তান। দেশটির উন্নয়ন সম্ভাবনা এবং চ্যালেঞ্জ নিয়ে লেখা তার ধারাবাহিকের প্রথম পর্ব প্রকাশিত হলো আজ

চারদিকে পাহাড়বেষ্টিত আফগানিস্তানে USGS প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে অন্তত ৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যমানের খনিজ এবং পেট্রোলিয়াম সম্পদ উত্তোলনযোগ্য রয়েছে। আফগান সরকারের খনিজ এবং জ্বালানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসাবে ২০১২-২০১৪ পর্যন্ত কর্মরত ছিলাম। ২০১০-২০১২ পর্যন্ত USAID সেবারগান গ্যাস ক্ষেত্র উন্নয়ন প্রকল্পে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কাজ করেছি। কাবুল বিশ্ববিদ্যালয় এবং কাবুল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্রছাত্রীদের নিবিড় প্রশিক্ষণ দিয়েছি। নিশ্চিতভাবে জেনেছি আফগানিস্তানের পাঁচটি  জিওলজিক্যাল বেসিনে বিপুল খনিজ সম্পদ, গ্যাস এবং খনিজ তেল সম্পদ রয়েছে।

কিন্তু যুগ যুগ  ধরে যুদ্ধ এবং সংঘাত দেশটির উন্নয়ন সম্ভাবনা বাধাগ্রস্ত করেছে। এই অস্থিরতায় পড়ে ক্রমশ দেশটি ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। অথচ আমার অভিজ্ঞতা বলছে আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষ অত্যন্ত অতিথিপরায়ণ এবং বিশাল হৃদয়ের অধিকারী। তাদের দেশপ্রেম, আত্মসম্মান অসামান্য। সকলেই স্বভাব যোদ্ধা। দেশের জন্য জীবন বিসর্জন দিতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হয় না। আর তাই মহাবীর আলেক্সান্ডারসহ ইংরেজ, রাশিয়ান, ন্যাটো বাহিনীসহ যুগ যুগ ধরে আগ্রাসনের শত চেষ্টা করেও আফগানিস্তান থেকে শূন্য হাতেই বিদায় নিয়েছে। রাশিয়ার পর এবার আমেরিকাও সেই লজ্জাজনক কায়দায় আফগানিস্তান থেকে হাত গুটিয়ে নিতে বাধ্য হলে।

কিন্তু যুদ্ধ সংঘাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত অবকাঠামোর কারণে আফগানিস্তানের অর্থনীতি চিরকাল দুর্বল। বর্তমান তালেবান গোষ্ঠী দেশে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় কতুটুকু সফল হয় মূলত তার ওপরই নির্ভর করছে আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা। 

আফগানিস্তানের খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রশিক্ষনার্থীদের সঙ্গে লেখক

চারধারে পাহাড়বেষ্টিত আফগানিস্তান সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে অনেক উঁচুতে একটি রুক্ষ শুষ্ক ভূমি হলেও দেশটির উত্তরাঞ্চল সবুজ। সুউচ্চ পর্বতমালা, পাহাড়ি ঝরনাধারা আফগানিস্তান একসময় পর্যটনের জন্য স্বর্গভূমি ছিল। কাবুল শহরে বিদ্যুৎচালিত ট্রাম চলতো। ভারত পাকিস্তান থেকে অনেক নববিবাহিত দম্পতি হানিমুন করতে কাবুলে বেড়াতে আসতো। তারা এই শহরটিকে পছন্দের তালিকার শীর্ষে রাখতেন। ১০ বছর আগেও দেখেছি কাবুল শহরে অনেক অভিজাত রেস্টুরেন্ট আলো ছড়াচ্ছে। সন্ধ্যায় কাবুল শহরে বের হলে চারদিকে ঘেরা পাহাড়গুলো দেখে মনে হতো প্রাচীর তুলে যেন পুরো রাজধানীকে প্রহরী পাহারা দিচ্ছে!

দেশটির উত্তরে রয়েছে ইরান, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান। দূরে উত্তরপূর্বে চীন এবং সমগ্র দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্তজুড়ে পাকিস্তান। অবিভক্ত ভারত উপমহাদেশে ইসলাম এবং মোঘল বাদশারা এসেছিল উজবেকিস্তানের সমরখন্দ এবং বোখারা থেকে আফগানিস্তান পেরিয়ে। কাবুলে এখনো রয়েছে সম্রাট বাবরের মাজার, যার নাম বাবর গার্ডেন। দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ সংঘাতে দেশটির ফলের বাগান ধ্বংস হয়ে গেছে। বিস্তার নিয়েছে আফিম চাষ। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে অবিশ্বাস আর সংঘাত জন্ম নিয়েছে। কিছু সুবিধাবাদী গোষ্ঠী বিপুল সম্পদ অর্জন করে আরব আমিরাত এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। অথচ সাধারণ আফগানদের ভাগ্যের উন্নয়ন হয়নি।

দুঃখজনক বিষয় হলো প্রতিবেশী ইরান, পাকিস্তান এবং কিছু দূরে থাকা তুরস্ক খোলা মন নিয়ে কখনোই আফগানিস্তানের উন্নয়নে কার্যকরী ভূমিকা নেয়নি। রাজনীতির কুটকৌশলে আফগানিস্তানের যোদ্ধা গোষ্ঠীকে অস্ত্র এবং প্রশিক্ষণ দিয়ে  যুক্তরাষ্ট্র ইঁদুর বিড়াল খেলায় ভূমিকা রেখেছে। চীন নিজেদের স্বার্থে এগিয়ে এলেও খুব একটা সহায়তার হাত বাড়ায়নি। এক সময় আফগানিস্তানে উন্নয়নের বড় ভূমিকা রাখা রাশিয়া বরাবর চেষ্টা রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্র ৯/১১-এর পর এখানে ন্যাটো বাহিনীর সমন্বয়ে হামলা চালিয়ে চরমপন্থী তালেবান গোষ্ঠীকে এক সময় ক্ষমতাচ্যুত করলেও তারা কখনো আফগান জনগণের মন জয় করতে পারেনি। 

২০ বছরের যুদ্ধ শেষে আমেরিকা আফগানিস্তান থেকে প্রকৃত অর্থে কি পেল- সেই হিসেব মেলানো শুরু হয়েছে। ‘নতুন তালেবান’ সরকার এবার আফগানিস্তানকে সফল রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবে কিনা- তা নির্ভর করছে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক মহল কী ভূমিকা রাখে তার ওপর। 

লেখক: মেলবোর্ন প্রবাসী জ্বালানি বিশেষজ্ঞ