মতামত

রাসেলকে ভালোবাসার ব্যাকরণ

রাসেল বেঁচে থাকলে ৫৭ পেরিয়ে ৫৮ বছরে পদার্পণ করতো। প্রতি বছর এই দিনে জন্মদিন উপলক্ষে তাঁকে স্মরণ করা হয় বিশেষভাবে। এ বছর থেকে দিনটি ‘শহীদ শেখ রাসেল দিবস’ হিসেবে জাতীয়ভাবে স্মরণ করা হবে।

রাসেল বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ সন্তান। মাত্র ১১ বছর বয়সে তাঁকে হত্যা করা হয় নির্মমভাবে। ঘাতকেরা ১৫ আগস্টের রাতে কতোটা ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ডে মেতে উঠেছিল তার প্রমাণ নিষ্পাপ এক শিশুকেও বাঁচতে না দেওয়া। ওরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, বঙ্গমাতাসহ পরিবারের সবাইকে হত্যা করেছে। ওদের লক্ষ্যই ছিল বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কেউ যেন বেঁচে না থাকে। ওরা চেয়েছিল এই লক্ষ্য পূরণের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর চেতনা-মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাংলাদেশ থেকে মুছে দিতে। কিন্তু তাদের সেই লক্ষ্য পূরণ হয়নি। কেননা, বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা তখন দেশের বাইরে ছিলেন। ইতিহাসের কি দারুণ প্রতিশোধ! শুধু কি প্রতিশোধ, নাকি একে ইতিহাসের সৌন্দর্য্য ও অমোঘ নিয়তি বলাই যুক্তিযুক্ত ও শ্রেয়। যারা বঙ্গবন্ধুর চেতনা মুছে দিতে চেয়েছিল নির্মম হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে, তাদের বিচার হয়েছে দেশের প্রচলিত আইনে; বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকার সময়ে।

১৫ আগস্টের মধ্যরাতের খুনিরা ও তাদের সহযোগীরা বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার যেন বাংলাদেশের মাটিতে না হয় তার জন্য ‘ইনডেমনিটি অ্যাক্ট নামে’ জঘন্য এক আইন করেছিল। খুনিরা একসময় প্রকাশ্যে রাষ্ট্র পরিচালনাকারীদের পৃষ্ঠপোষকতায় নিজেদের দম্ভভরে পরিচয় দিতো ‘বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী’ হিসেবে। ওরা জানতো না ইতিহাস বড়োই নির্মম, নিষ্ঠুর। সে কখনো আপস করে না। ইতিহাস নিজের শক্তিতেই ফিরে আসে, বাঁক হয়তো বদলায়, কিন্তু ভুলে যায় না কিছুই। ইতিহাসের সত্য একসময় প্রকাশিত হয়-হবেই, হয়তো সময় লাগে, কিন্তু ঐতিহাসিক সত্য, শক্তি কখনো বিনাশ করা যায় না। জাতির জনককে হত্যা করে, পরিবারের সদস্যদের হত্যা করে, শিশু রাসেলকে হত্যা করে তারা ভেবেছিল মিথ্যা গল্প ফেঁদে ইতিহাসের চাকা উল্টো পথে ঘুরিয়ে দেবে। কিন্তু না, খুনিদের সেই সুদূরপ্রসারী ইচ্ছা পূরণ হয়নি। সেটা যে পূরণ হওয়ার নয় ইতিহাস সেটা প্রমাণ করেছে, এই বাংলায়। বাংলার মাটিতেই খুনিদের হয়েছে বিচার, বেশিরভাগ খুনির দণ্ড হয়েছে কার্যকর। বাকীদের দেশের মাটিতে ফিরিয়ে এনে বিচার কার্যকর করার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।

শোকাহত আগস্টের খুনিদের বিচার সম্পন্ন হলেও তাদের সহযোগী ও উত্তরসূরিদের ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত এখনও শেষ হয়নি, হওয়ার নয়। এ কারণে শুভবোধসম্পন্ন মানুষকে সর্বদা সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে। তারা যেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন নিয়ে নতুন করে ষড়যন্ত্রের জাল বিছাতে না পারে, ভয়ঙ্কর কোনো খেলায় মেতে উঠতে না পরে। মনে রাখতে হবে ওরা ভালো কোনো বার্তা বুঝতে অপারগ। ইতিবাচক কোনো কিছুতেই ওদের হিংসা ও হিংস্রতা স্বভাবগত। ওদের হৃদয় যে পিশাচের, শিশুর কান্নার আকুতিও যে তাদের ব্যথিত করে না, তার প্রমাণ ওরা দিয়েছে ১৫ আগস্টের কালোরাতে শিশু রাসেলকে হত্যার মধ্য দিয়ে। রাসেল সেদিন যা বলেছিল এম. এ.  ওয়াজেদ মিয়া ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ বইয়ে লিখেছেন সেই মুহূর্তের মর্মন্তুদ বিবরণ:

‘‘বঙ্গবন্ধু যখন সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে উদ্যত হয়েছিলেন ঠিক ঐ মুহূর্তে হাবিলদার মুসলেহউদ্দিন তাঁকে তাক করে ব্রাশ ফায়ার করে। বুলেটে ক্ষতবিক্ষত বঙ্গবন্ধুর দেহ তক্ষুণি সিঁড়ির ওপর লুটিয়ে পড়ে। অতঃপর দু’জন মেজর ও হাবিলদার মোসলেহউদ্দিন আমার শাশুড়িসহ বঙ্গবন্ধুর পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের এক এক করে ঠান্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করে। এরই এক ফাঁকে রাসেল দৌড়ে নিচে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানো বাড়ির কাজের লোকজনদের নিকট আশ্রয় নেয়। তাকে দীর্ঘকাল যাবত দেখাশুনার ছেলে আব্দুর রহমান রমা তখন রাসেলের হাত ধরে রেখেছিল। একটু পরেই একজন সৈন্য রাসেলকে বাড়ির বাইরে পাঠানোর জন্য রমার কাছ থেকে তাঁকে নিয়ে নেয়। রাসেল তখন ডুকরে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, ‘আল্লাহর দোহাই, আমাকে জানে মেরে ফেলবেন না। বড় হয়ে আমি আপনাদের বাসায় কাজের ছেলে হিসেবে থাকবো। আমার হাসু আপা দুলাভাইয়ের সঙ্গে জার্মানিতে আছেন। আমি আপনাদের পায়ে পড়ি, দয়া করে আপনারা আমাকে জার্মানিতে হাসু আপা ও দুলাভাই-এর কাছে পাঠিয়ে দিন।’ তখন উক্ত সৈন্যটি রাসেলকে বাড়ির গেটস্থ সেন্ট্রিবক্সে লুকিয়ে রাখে। এর প্রায় আধঘণ্টা পর একজন মেজর সেখানে রাসেলকে দেখতে পেয়ে তাঁকে দোতলায় নিয়ে গিয়ে অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় হত্যা করে তার (রাসেলের) মাথায় রিভলবারের গুলীতে।’’

রাসেলকে হত্যা করলেও নিশ্চিহ্ন করতে পারিনি খুনীচক্র। যেমনভাবে পারিনি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেও বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন-মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ম্লান করতে, উল্টো সেসব হয়েছে আরও বেশি গতিশীল। বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখা হাসিনার প্রযত্ন ও অভিভাবকত্বে বাঙালি ও বাংলাদেশের সাধন সম্পদ হিসেবে চর্চিত। দৈহিকভাবে হয়তো রাসেল আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তাঁর স্মৃতি, তাঁর অবয়ব, তাঁর নাম, তাঁর সম্ভাবনা অমর অক্ষয় হয়ে রয়েছে-বাংলার ছাপান্নো হাজার বর্গমাইলে। রাসেল পরিগণিত হয়েছে সম্ভাবনাময় শিশুর প্রতীকে। রাসেল এখন খুনিদের বিরুদ্ধে ঘৃণার সর্বনাম, শুদ্ধ এক মন্ত্রোচ্চারণ বিশেষ। আনা ফ্রাংকের কথা মনে হলে, আনা ফ্রাংকের ডায়েরি পড়লে আমাদের কাছে যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ-বিভৎসতা হাজির হয়। তেমনি শিশু রাসেলের কথা মনে হলে পনেরো আগস্টের খুনিদের বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের সাক্ষ্য-প্রমাণ উন্মোচিত হয়।

আনা ফ্রাংকের ডায়েরি কিংবা রোজনামচা পড়ার সুযোগ হয়েছে আমাদের। রাসেলের নিজের লেখা ডায়েরি বা রোজনামচা না থাকলেও আমাদের রয়েছে তাঁর বাবার লেখা রোজনামচা। বলছি বঙ্গবন্ধুর ‘কারাগারের রোজনামচা’র কথা। যা পড়ে আমরা জেনে যাই পিতা-পুত্রের রসায়ন-ভালবাসা-স্নেহ। ‘কারাগারের রোজনামচা’য় উল্লিখিত হয়েছে:

এক. ‘‘সাড়ে চারটায় জেলের লোক এসে বলল- চলুন আপনার দেখা আসিয়াছে, আপনার স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে বসে আছে জেল অফিসে। তাড়াতাড়ি রওয়ানা করলাম। দূর থেকে দেখি রাসেল, রেহানা ও হাচিনা চেয়ে আছে আমার রাস্তার দিকে। ১৮ মাসের রাসেল জেল অফিসে এসে একটুও হাসে না-  যে পর্যন্ত আমাকে না দেখে। দেখলাম দূর থেকে পূর্বের মতোই ‘আব্বা আব্বা’ বলে চিৎকার করছে। জেল গেট দিয়ে একটা মাল বোঝাই ট্রাক ঢুকছিল। আমি তাই জানালায় দাঁড়াইয়া ওকে আদর করলাম। একটু পরেই ভেতরে যেতেই রাসেল আমার গলা ধরে হেসে দিল। ওরা বলল আমি না আসা পর্যন্ত শুধু জানালার দিকে চেয়ে থাকে, বলে ‘আব্বার বাড়ি’। এখন ওর ধারণা হয়েছে এটা ওর আব্বার বাড়ি। যাবার সময় হলে ওকে ফাঁকি দিতে হয়।’’ (পৃষ্ঠা: ৯৩)

দুই. ‘‘জেলগেটে যখন উপস্থিত হলাম ছোট ছেলেটা আজ আর বাইরে এসে দাঁড়াইয়া নাই দেখে একটু আশ্চর্য হলাম। আমি যখন রুমের ভিতর যেয়ে ওকে কোলে করলাম আমার গলা ধরে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে কয়েকবার ডাক দিয়ে ওর মার কোলে যেয়ে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে ডাকতে শুরু করল। ওর মাকে ‘আব্বা’ বলে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ব্যাপার কি?’ ওর মা বলল, ‘‘বাড়িতে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে কাঁদে তাই ওকে বলেছি আমাকে ‘আব্বা’ বলে ডাকতে।’’ রাসেল ‘আব্বা আব্বা বলে ডাকতে লাগল। যেই আমি জবাব দেই সেই ওর মার গলা ধরে বলে, ‘তুমি আমার আব্বা।’ আমার উপর অভিমান করেছে বলে মনে হয়। এখন আর বিদায়ের সময় আমাকে নিয়ে যেতে চায় না।’’ (পৃষ্ঠা: ২২১)

তিন. ‘‘পাঁচটায় আবার গেটে যেতে হলো। রেণু এসেছে ছেলেমেয়েদের নিয়ে। হাচিনা পরীক্ষা ভালই দিতেছে। রেণুর শরীর ভাল না। পায়ে বেদনা নিয়ে হাঁটতে কষ্ট হয়। ডাক্তার দেখাতে বললাম। রাসেল আমাকে পড়ে শোনাল, আড়াই বৎসরের ছেলে আমাকে বলছে, ‘৬ দফা মানতে হবে-সংগ্রাম, সংগ্রাম, চলবে চলবে’,- ভাঙা ভাঙা করে বলে, কি মিষ্টি শোনায়! জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ও শিখলো কোথা থেকে?’ রেণু বলল, ‘বাসায় সভা হয়েছে, তখন কর্মীরা বলেছিল তাই শিখেছে।’ বললাম, ‘আব্বা আর তোমাদের দরকার নাই এ পথের। তোমার আব্বাই ‘পাপের’ প্রায়শ্চিত্ত করুক।’’ (পৃষ্ঠা: ২৪৬-২৪৭)

চার. ‘‘৮ ফেব্রুয়ারি ২ বৎসরের ছেলেটা এসে বলে, ‘আব্বা বালি চলো’। কি উত্তর ওকে আমি দিব। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম ও তো বোঝে না আমি কারাবন্দি। ওকে বললাম, ‘তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আবার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো।’ ও কি বুঝতে চায়! কি করে নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটা, ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে! দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমি তো মানুষ আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলেমেয়েরা বুঝতে শিখেছে। কিন্তু রাসেল এখনও বুঝতে শিখে নাই। তাই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যায় বাড়িতে।’’ (পৃষ্ঠা: ২৪৯)

‘কারাগারের রোজনামচা’য় রাসেল সম্পর্কিত উপর্য্কুত অংশসহ আরও কিছু অংশ আমাদের কাছে হয়ে ওঠে আনা ফ্রাংকের ডায়েরির মতো করে রাসেলের ডায়েরি কিংবা রাসেলের রোজনামচারূপে। আমরা জানতে পারি, এই ভূগোলের মানুষের মুক্তির জন্য একজন বাবার লড়াই ও ত্যাগ স্বীকারের অনন্য নজিরসমূহ। এসব গল্পের মতো মনে হয়। রূপকথার অবিশ্বাস্য কল্পনাকে হাজির করা হয়েছে বলে মনে হয়। কিন্তু এসব গল্প নয়, এসব রূপকথা নয়। এসব রাসেলের জীবন ডায়েরি। যার বয়ান রয়েছে বঙ্গবন্ধুর ‘কারাগারের রোজনামচা’য়। রাসেলের জীবন ডায়েরির আরও পৃষ্ঠা-দিন-ক্ষণ-মাস-বছর আমরা পাই তাঁর প্রিয় দুইবোনের লেখায়।

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আদরের ভাইকে নিয়ে লিখেছেন- ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’। সেখানে উল্লেখ আছে: ‘আব্বা যখন ৬ দফা দিলেন, তারপরই তিনি গ্রেপ্তার হয়ে গেলেন। রাসেলের মুখে হাসিও মুছে গেল। সারা ঘুরে ঘুরে রাসেলকে আব্বাকে খুঁজত। রাসেল যখন কেবল হাঁটতে শিখেছে, আধো আধো কথা বলতে শিখেছে, আব্বা তখনই বন্দি হয়ে গেলেন। মা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন আব্বার মামলা-মোকদ্দমা সামলাতে, পাশাপাশি আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা। সংগঠনকে সক্রিয় রেখে আন্দোলন-সংগ্রাম চালাতেও সময় দিতে হতো।’

বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠা কন্যা শেখ রেহানা প্রিয় ছোট ভাইকে স্মৃতিচারণ করেছেন এভাবে: ‘আব্বার সঙ্গে আমার ও রাসেলের জাপান, মস্কো ও লন্ডন বেড়ানোর সুযোগ হয়। রাষ্ট্রীয় সফর বলেই রাসেল বিদেশিদের সাথে খুব সৌজন্যমূলক ব্যবহার করত। সে ছোট্ট হলেও বুঝতে পারত কোথায় কীভাবে চলতে, শিখতে হবে। ঢাকায় ফিরে আমি যখন মা ও সবার কাছে ওর এই সুন্দর ব্যবহারের গল্প করেছি, তখন সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনেছে। লন্ডনে বিখ্যাত মাদাম তুসোর মিউজিয়ামে আমরা যখন বেড়াতে যাই, রাসেলের বিস্ময় আর কাটে না! আমরা দুইজন আব্বার সাথে নাটোরের উত্তরা গণভবনেও গিয়েছি। রাসেল সেখানে মাছ ধরত, আমরা বাগানে ঘুরে বেড়াতাম। ঢাকার গণভবনেও রাসেল মাছদের খাবার খাওয়াত। ফুপাতো ভাই আরিফ তার খুব ভালো ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। তারা দুইজন একই স্কুলে পড়ত এবং একসঙ্গে খেলত। টুঙ্গিপাড়ায় তাদের একটা ক্ষুদে বাহিনী ছিল-যাদের সঙ্গে খালের পানিতে সাঁতার কাটা, ফুটবল খেলায় মেতে থাকত তারা।’

এসব লেখা পড়ে আমরা বেদনার্ত হই, আহত হই। এসব লেখার মধ্যেই আমরা মূলত রাসেলকে ভালোবাসার ব্যাকরণ খুঁজে পাই। ব্যাকরণ জানলে যেমন ভাষা শুদ্ধভাবে লিখতে-পড়তে ও বলতে পারা যায়, ঠিক তেমনি রাসেলকে ভালোবাসতে হলে, জানতে হবে রাসেলকে ভালোবাসার ব্যাকরণ। সেই ব্যাকরণের পাঠ নিতে হবে বঙ্গবন্ধুর ‘কারাগারের রোজনামচা’ থেকে, শেখা হাসিনার লেখা থেকে, শেখ রেহানার লেখা থেকে। এবং এসব লেখা শুধু পাঠ করলেই হবে না, তা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। জীবন ও কর্মে তার প্রয়োগ ঘটাতে হবে। যদি সেটা সম্ভব হয় তবেই রাসেলকে স্মরণ-বরণ করা স্বার্থক ও অর্থবহ হবে।

রাসেল তাঁর বাবাকে সেভাবে পায়নি, কারণ তাঁর ১১ বছরের জীবনের ৭ বছরের বেশীরভাগ সময় বাবা থেকেছে কারাপ্রকোষ্ঠে, জেলখানায়। জেলখানায় কেন? এ দেশের মানুষের ন্যায্য হিস্যা আদায়ের জন্য। ন্যায্য হিস্যা কী গণতন্ত্র দিতে হবে, স্বাধীকার দিতে হবে, সাম্য নিশ্চিত করতে হবে, অসাম্প্রদায়িক সমাজ নির্মাণ করতে হবে। জান ও মালের নিরাপত্তা দিতে হবে, মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এই অধিকার-দাবি আদায় করতে গিয়েই রাসেলের বাবাকে দিনের পর দিন কারাগারে থাকতে হয়েছে, রাসেলকে মাকে ‘আব্বা’ ডেকে আব্বা ডাকার ইচ্ছে-সাধ পূরণ করতে হয়েছে, কারাগারকে আব্বার বাড়ি মনে করতে হয়েছে।

বাংলাদেশ এখন স্বাধীন-সার্বভৌম এক দেশ, যার সুবর্ণজয়ন্তী চলছে এ বছর। শিশু রাসেল বাবার যে স্বপ্ন-সাধনা ও লক্ষ্য পূরণের জন্য পিতৃস্নেহ-আদর-ভালোবাসা বঞ্চিত হয়েছে, স্বাধীন-সার্বভৌম দেশে যদি সেই সব চর্চিত না হয়, পূরণ না হয় তাহলে রাসেলকে ভালোবাসার ব্যাকরণ অপূর্ণ থেকে যাবে। রাসেলকে স্মরণ-বরণ-ভালোবাসা-দিবসের স্বীকৃতি ও মর্যাদা তখনই তাৎপর্যবাহী হয়ে উঠবে যখন আমরা রাসেলকে ভালোবাসার ব্যাকরণ পূর্ণ করতে পারব, সেই লক্ষ্যে নিজেদের ঈমান ও নিশানা ঠিক করতে পারব। রাসেলের ৫৭ বছর জন্মবার্ষিকী যখন উদযাপিত হচ্ছে তার ঠিক ক’দিন আগে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দূর্গাপূজার শারদীয় উৎসবে অনাকাঙ্খিত এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে যা কিছু ঘটলো তা শুধু বিস্ময় ও বেদনার নয়, লজ্জারও।

অসাম্প্রদায়িক ও সকল ধর্ম-মত-বর্ণের মানুষের প্রীতিপূর্ণ সহাবস্থানে ফাটল ধরানোর লক্ষ্যেই যে এসব অপকর্ম তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই ফাটল যদি আমরা বন্ধ করতে না পারি তাহলে যে বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে রাসেল বাবার স্নেহবঞ্চিত হয়েছিল সেই বাংলাদেশ আমরা এখনও নির্মাণ করতে পারিনি। অর্থাৎ রাসেলকে ভালোবাসার ব্যাকরণ পূর্ণ করতে পারিনি, ধারণ ও চর্চা করতে পারিনি, সমাজ-রাষ্ট্র-জনগণের অঙ্গীকাররূপে প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূর্ণাঙ্গরূপে বাস্তবায়ন ও চর্চিত হলেই পূর্ণ হবে রাসেলকে ভালোবাসার ব্যাকরণ। পূর্ণ হবে ‘কারাগারের রোজনামচা’য় শিশুপুত্রের জন্য একজন বাবার লেখা দুঃখ-কষ্ট-বেদনার মিশেলে কিংবা আড়ালে দেশ ও দেশের জনগণকে ভালোবাসার লড়াই-সংগ্রাম ও ত্যাগ স্বীকারের অনন্য এক ইতিহাস।

লেখক: সাংবাদিক, লেখক ও গবেষক