মতামত

বুদ্ধিজীবীর দায় ও আজকের বাংলাদেশ

১৪ ডিসেম্বর, শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ৫০ বছর আগে নয়মাসের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী সারাদেশে লাখ লাখ মানুষ নিধন করেছে। এই নিধনযজ্ঞে ১৪ ডিসেম্বর চিন্তাবিদ, সংস্কৃতিকর্মী, চিকিৎসক, শিক্ষক ও সংবাদকর্মীকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়। পরাজয় নিশ্চিতের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের এদেশের দোসরদের সহায়তায় হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। তাদের মূল অভিপ্রায় ছিল এদেশের চিন্তাকে হত্যা করা। যাতে দেশ আর কখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে। ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশ এই দিনটিকে শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে পালন করে।

আজ আমাদের সামনে দুটি প্রশ্ন উপস্থিত। প্রথম প্রশ্ন হলো- বুদ্ধিজীবী বলতে আমরা কী বুঝি? আর দ্বিতীয় প্রশ্ন- বুদ্ধিজীবীর দায় কী? প্রথম প্রশ্নের উত্তর পেলে দ্বিতীয় প্রশ্নের সমাধান পাওয়া যাবে। প্রথমে আমরা বুঝতে চেষ্টা করবো ‘বুদ্ধিজীবী’ মানে কী? এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন ইতালিয় মার্ক্সবাদী দার্শনিক আন্তেনিও গ্রামশি (১৮৯১-১৯৩৭) তাঁর ‘দ্য প্রিজন নোটবুক’ গ্রন্থের একটি অধ্যায়ে। তিনি লিখেছেন: ‘সব মানুষই বুদ্ধিজীবী, কিন্তু সব মানুষই সমাজে বুদ্ধিজীবীর কাজ করে না।’

এর অর্থ হলো একটি বিশেষ শ্রেণি সমাজে বুদ্ধিজীবীর কাজ করে। এই বিশেষ শ্রেণিকে তিনি দুইভাগে ভাগ করেছেন। প্রথমভাগে রয়েছেন ট্রাডিশনাল ইন্টেলেকচুয়াল আর দ্বিতীয় ভাগে অর্গানিক ইন্টেলেকচুয়াল। ট্রাডিশনাল ইন্টেলেকচুয়ালরা সরাসরি উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত নন। তারা পরোক্ষভাবে উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে থাকেন। এই শ্রেণির বুদ্ধিজীবীরা হলেন শিক্ষক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের গুরু। গ্রামশির ভাবনা অনুসারে বলা যায়, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মী, আইনজীবী, সাহিত্যিক- তারা এই শ্রেণিভুক্ত। অন্যদিকে উৎপাদন ও বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত বুদ্ধিজীবীরা হলেন অর্গানিক বুদ্ধিজীবী। গ্রামশির মতে, তারা সবসময় সক্রিয় থাকেন। তারা মানুষের মন পরিবর্তন ও বাজার প্রসারে মনোযোগ দেন। এই বুদ্ধিজীবী শ্রেণি পুজিবাদী সমাজ কাঠামোর ফল। বাংলাদেশে বাজার অর্থনীতির কারণে এই শ্রেণির বুদ্ধিজীবীর প্রসার ঘটেছে। তারা বাণিজ্যকে প্রাধান্য দেন, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে তাদের প্রভাব বাড়ছে। রঙ ফর্সা করা ক্রিমের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা কিংবা পুরুষের দাড়ি গোফ কামানোর অস্ত্রে নারীর উপস্থাপনে বাণিজ্যের প্রসার ঘটায়।

গ্রামশির বাইরে বুদ্ধিজীবী শ্রেণি নিয়ে কথা বলেছেন ফরাসি দার্শনিক জুলিয়েন বেন্দা (১৮৬৭-১৯৫৬)। তাঁর মতে আসল বুদ্ধিজীবীরা শুধু নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন না। তারা দুর্নীতিকে প্রত্যাখ্যান করেন, দুর্বলকে রক্ষা করেন এবং শোষণমূলক কর্তৃত্ব অমান্য করেন। ১৯২৭ সালে লেখা ‘দ্য ট্রিজন অব দ্য ইন্টেলেকচুয়ালস’ গ্রন্থে তিনি বুদ্ধিজীবীর বৈশিষ্ট্য আলোচনা প্রসঙ্গে এই শ্রেণিকে নৈতিকতা তৈরির দায়িত্ব দিয়েছেন। বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থায় যাদের আমরা চিন্তাবিদ বা বুদ্ধিজীবী হিসেবে বিবেচনা করছি তারা কি সে দায়িত্ব পালন করছেন? আমাদের শিক্ষকসহ নানা পেশার মানুষের বড়ো একটা অংশ নৈতিকতাকে বিক্রি করে দিয়েছেন। আপন রাজনৈতিক বিশ্বাসপ্রসূত হয়ে ভাবনাকে সম্মুখে নিয়ে আসেন। এমনকী প্রধান দুই রাজনৈতিক ধারার বাইরে যারা প্রগতিশীলতার চর্চা করেন তারাও এই স্থানে অস্পষ্ট ভূমিকা রাখেন। ফলে সাধারণ মানুষের কাছে ভুল বার্তা যায়। তাদের অনেকে জনগণের ভাবনা থেকে দূরে সরে যান। 

এডওয়ার্ড সাঈদ (১৯৩৫-২০০৩) ‘রিপ্রেজেন্টেশন অব দ্য ইন্টেলেকচুয়াল’ গ্রন্থে রচনা করেন: ‘একজন বুদ্ধিজীবী তাঁর শ্রোতা-দর্শক বা পাঠকের সামনে কোনো বিষয় শুধু তুলে ধরার জন্যই তুলে ধরেন না। তিনিও একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে মানুষের স্বাধীনতা বা ন্যায়বিচারের জন্য কাজ করেন।’ আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের বড়ো একটা অংশ ন্যায়বিচার বিবেচনা করেন আপন প্রাপ্তির বিবেচনায়। রাজনৈতিক শক্তির হিসেবে সমস্ত পেশাজীবী সংগঠনগুলো বিভক্ত। এই বিভাজনে আদর্শের চেয়ে প্রাপ্তির হিসেব বড়ো হয়ে যায়। তাই তারা নিজ রাজনৈতিক শক্তিকে ক্ষমতায় আনতে চান। কেননা পছন্দের দল ক্ষমতায় এলে তার ভাগ তারা পাবেন। নিজ রাজনৈতিক শক্তির অপরাধ তারা দেখেন না। এমনকী তাদের লেখা কিংবা ভাষণে তারা এ বিষয়ে নিশ্চুপ থাকেন।

আমরা বাংলাদেশে সংবাদপত্রের লেখা, টকশো কিংবা আলোচনাসভায় নাম দেখে বুঝতে পারি কোন পক্ষে তাঁর অবস্থান। এর মানে আত্মবিক্রয় করে তারা নিজেদের পরিচিত করেন। এর ফলে সব পক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যিনি এই কাজটি করছেন তিনি প্রাপ্তিলিপ্সায় নিজের শক্তি সম্পর্কে কিছুই জানতে পারেন না। আবার যাদের পক্ষ হয়ে করছেন তারাও নিজেদের ত্রুটি দেখতে পায় না। বরং এটাকে অলঙ্কার বিবেচনা করেন। এই শ্রেণির বুদ্ধিজীবীরা যে কোনো পক্ষের জন্য বিপজ্জনক। এটা বলা যায় অধ্যাপক, গবেষক, ইতিহাসবিদ, সাংবাদিক, শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, শিল্পবোদ্ধা, আইনজীবী, রাজনীতির বিশ্লেষক, সমাজবিজ্ঞানী প্রভৃতি পেশার মানুষের সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি দায় পালনের মাধ্যমেই দেশ এগিয়ে যাবে। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আরেক শ্রেণির সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটেছে- তারা মনোযোগ আকর্ষণ করতে চান। অর্থাৎ নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলা ও অন্যের কাছে নিজেকে পরিচিত করানোর মাধ্যমে প্রচারের কেন্দ্রে থাকা। এই তরুণ বুদ্ধিজীবী শ্রেণি ভবিষ্যতের বিপদ ডেকে আনছেন। বিশ্লেষণ নেই, পাঠ নেই, আছে শুধু আমিত্ব। আমরা আরও গভীর অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছি।

চিন্তাবিদ এডওয়ার্ড সাঈদও বলেছেন, বুদ্ধিজীবীদের কাজই হলো ক্ষমতা ও শক্তির মুখোশ উন্মোচন করা। কিন্তু আমরা দেখেছি আমাদের বুদ্ধিজীবীরা ক্ষমতার কাছে আত্মসমর্পন করেছেন। সেটা যে পক্ষেরই হোক না কেন? দেশ হয়তো অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে অগ্রসর হচ্ছে কিন্তু মানবিক বোধ কি তৈরি হচ্ছে? যার খারাপ প্রতিক্রিয়া আমরা চারপাশে প্রতিনিয়ত দেখতে পাচ্ছি। সমাজ ও রাষ্ট্র এক অন্ধকার গলি পথে হাঁটছে। এর অনেকখানি দায় আমাদের বুদ্ধিজীবীদের, কেননা তারা নিরপেক্ষ অবস্থান তৈরি করতে পারেননি। তাদের অবস্থান হবে জনগণের পক্ষে, এর পরিবর্তে আত্মপ্রাপ্তির দিকেই তারা নজর দিয়েছেন। ফলে তারা শক্ত ভূমিতে দাঁড়াতে পারেননি। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ কিন্তু তার অবস্থান থেকে সরে যায়নি। তার পক্ষে গণমাধ্যম নেই, ক্ষমতা নেই। কিন্তু তার চিন্তার চাষ করে চলেছেন। এটাও সত্য যে তারাও রাষ্ট্রের বা ক্ষমতার বাইরে নন, তারপরেও সম্ভাবনা জাগিয়ে রাখেন। তবে এক্ষেত্রে গ্রামশির অর্গানিক বুদ্ধিজীবীরা শক্তিশালী ও প্রধান ভূমিকা পালন করেন। তারা নিজ ক্ষেত্রের বাইরে বৃহত্তর সমাজ ও রাষ্ট্র নিয়ে ভাবেন। 

একজন বুদ্ধিজীবী স্বদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের গতিবিধি বিষয়ে সচেতন থাকবেন। ক্ষমতাধরেরা এই গতি পাল্টে দিতে চায়, তারা নিজেদের মতো করে পথ তৈরি করে। বুদ্ধিজীবী সেখানে নিজের মত দিবেন। এই মত হবে বিচার-বিশ্লেষণপ্রসূত, এখানে তিনি বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে জনগণের স্বার্থকে প্রধান করে দেখবেন। জাতীয় স্বার্থ ও মনন তৈরি করতে না পারলে দেশ সামনে যেতে পারে না। নাগরিক মধ্যবিত্ত তার লোভের কারণে মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতার পক্ষে নিজ ভাবনা প্রকাশ করবেন না। তাই আমাদের তাকাতে হবে এর বাইরে কৃষক ও শ্রমিক সমাজের দিকে যারা হয়তো মানসিক দাসত্ব ও চিন্তার দীনতার বদলে নতুন একটা প্রক্রিয়া নির্মাণ করবেন। যারা সমাজের বিভিন্ন স্তরে রয়েছেন তাদের আত্মউপলব্ধির সময় এসেছে। শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস যেন আমাদের চিন্তার দীনতা দূর করে। আজকের বাংলাদেশে মানবিক বোধ জাগানোর জন্য বুদ্ধিজীবী শ্রেণি এগিয়ে আসে।

লেখক: নাট্যকার ও শিক্ষক, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ