মতামত

এভাবেও যদি ফিরে আসা যায়

বাংলা শিক্ষা এ-ভূমিতে বরাবরই অবহেলিত। ক্লাসে ইংরেজি না-পারার কারণে আমিও কম অবহেলার শিকার হইনি। তাই বলে চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। দেরী করে ক্লাসে পৌঁছালে স্যার যখন দরজায় দাঁড় করিয়ে রেখে কারণ ইংরেজিতে জানতে চাইতেন, তখন অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়তেই হতো। ঢোক গিলে গলায় আটকে থাকা দ্বিধা দূর করার চেষ্টা করতাম। একদিন তো বলেই ফেললাম- সরি হইছে স্যার। 

স্যার অগ্নিমূর্তি ধারণ করলেন। মাথার ওপর যে হাত আশীর্ব্বাদ হতে পারতো, সেই হাত মাথার চুল ধরে টেনেহিঁচড়ে ক্লাসের মাঝখানে নিয়ে আমাকে দাঁড় করালো। ‘সাম বাংলা সাম ইংলিশ, মাদার মাদার ট্যাংরা ফিশ!’ স্যার গর্জে উঠলেন।  

প্রারম্ভিক পেরিয়ে এখন প্রবীণ সময়। বিলক্ষণ জানি, শুধু আমি কেন, পুরো জাতি সাম বাংলা সাম ইংলিশ রপ্ত করে নিয়েছে। এ ছাড়া তার চলেই না! তবে হ্যাঁ, বছরের ওই একদিন; দিনটিও কিন্তু ইংরেজি তারিখ মেনে; বাংলার জন্য আমাদের শোক উথলে ওঠে। দিকভ্রান্ত আমরা চেষ্টা করি বাংলায় ফিরে আসার। সেদিন অন্তত বাংলা তাঁতের শাড়ি, পাজামা-পাঞ্জাবি, হাতে গোলাপ-গাঁদা, চেহারায় অ আ ক খ-এর আল্পনা, আর ওই করুণ সুরে বাংলা গান। এরপর দিন ফুরোলো, নটে গাছটিও মুরোলো। বাইশ থেকে আবার সেই ইয়েস নো ভেরি গুড। 

আর হবে নাই-বা কেন? বাবা সন্তানকে যে বুঝিয়ে-সুজিয়ে বলবেন, ‘বাংলায় ফিরে আয় বাবা’- এই কথাটিকেও আমরা কত সহজেই না কৌতুকময় করে তুলেছি। রঙ্গ ভরা বঙ্গ বটে!

‘বাংলা’ মানেই যেন ইজ্জতে খামতি। ‘নয়-ছয়’ কথাটির কোনো সম্ভ্রমই নেই। অথচ নাইনটি সিক্স দিব্যি আছে। বাংলার পাঁচের ক্ষেত্রেও এ কথা বলা যায়। বেচারার মুখ রক্ষা পর্যন্ত হচ্ছে না। ‘দ’-কে বলি ‘হাঁটু ভাঙা দ’। মূর্ধণ্য ষ-কে বলা হয় পেট কাটা। কিন্তু দেখুন ‘ও’ কেটেই ‘কিউ’ হচ্ছে। ‘ডি’ ভেঙে ‘বি’। ‘ভি’ জোড়া দিয়ে ‘ডাব্লিউ’। আর ‘এক্স’ ক্রস চিহ্ন অর্থাৎ ভুল হয়েও কি প্রতাপেই না টিকে আছে। 

যাক্‌গে, ভাষার রাজনীতি বলে একটা কথা আছে। সেদিকে না এগুনোই ভালো। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘মাস্টার মহাশয়’-এর কথা মনে নেই? সেই যে নন্দীপুরের হারাণ মাস্টার আই ডোন্ট নো-এর তর্জমা করেছিলেন ‘আমি জানি না’। তাই শুনে গ্রামসুদ্ধ লোক ধরেই নিলো মাস্টার ইংরেজি জানে না। শেষ পর্যন্ত শুধু এ কারণে হারাণ মাস্টারকে গ্রামছাড়া হতে হয়েছিল। 

যিনি হারাণ মাস্টারকে গ্রামছাড়া করেছিলেন তিনি গোঁসাইগঞ্জের ব্রজ মাস্টার। তারা এ কালেও চাতুরির দ্বারা টিকে আছেন। সমাজে, বিশেষ করে কর্পোরেট দুনিয়ায় তাদেরই তো রমরমা। তারা একুশে ফেব্রুয়ারি জানে, ৮ ফাল্গুন চেনে না। চেনাতে গেলেও বিপদ। সটান বলে দেবে, তুই তুমি তোমরা আমার ঠিক আসে না। এরচেয়ে ‘ইউ’ বেটার। এক ইউ দিয়ে সব হয়ে যায়। 

যায় বটে! কিন্তু ‘এ গ্যাদা’ ‘ওই ছেড়ি’ ‘ওহ্ তুমি’ ভাবগুলো বোঝানো যায় কি? সেই কবে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ব্যঙ্গ করে লিখেছেন: ‘যত ছুঁড়ীগুলো তুড়ী মেরে/ কেতাব হাতে নিচ্ছে যবে/ তখন এ বি শিখে/ বিবি সেজে/ বিলাতী বোল কবেই কবে।’ 

তা তারা বলতেই পারেন। কিন্তু একটু বুঝেশুনে। ইংরেজি ‘লেট’ শব্দটির একাধিক মানে। লেট লতিফ ও লেট লতিফুর রহমানে বেজায় ফারাক। আবার সেই লেট-এর আগে ‘টু’ বসালে ভাড়া। সেই টু-লেটকে ভুল করে ‘টয়লেট’ ভাবলেই সর্বনাশ!

এমন সর্বনাশ অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করীদের বেলায় প্রায়ই ঘটে। সতর্ক করতে চাইলে উল্টো হয়তো শুনিয়ে দেবে- আরে এসব প্রব্লেম কোনো সমস্যাই না। নো চিন্তা ডু ফুর্তি। এদের প্রেসক্রিপশন রবিঠাকুর অনেক আগেই দিয়েছেন- ‘আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি, তারপর ইংরেজি শিক্ষার পত্তন।’ নইলে পতন অনিবার্য। একুশে ব্যর্থ হতে বাধ্য। তারা প্রাণ দিয়েছেন, আপনাকে শুধু সম্মান দিলেই হবে- ব্যস এটুকুই।  

‘দৈনিক আজাদ’ এর সাহিত্য পাতায় ফররুখ আহমদ হায়াত দরাজ খান পাকিস্তানি ছদ্মনামে ব্যঙ্গ কবিতা লিখতেন। রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে উর্দুকে ঘায়েল করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন সেই অব্যর্থ পঙ্‌ক্তি: ‘চুলের উর্দু খুঁজতে গিয়ে কুলবধূরা মুচকি হাসে।’

বাংলারও হাসির দিন সমাগত। আগে গণিত, বিজ্ঞান, ইংরেজি প্রাইভেট পড়ত ছেলেমেয়েরা। শুনছি এখন অনেকে বাংলাও পড়ে। মাস্টারমশাইয়ের কপাল খুললো তবে। ঘটনা কী? সেই মাস্টারমশাইয়ের কাছেই জানলাম, বাংলার পাঁচ মুখ করে তিনি জানালেন, সব বিষয়ে এ প্লাস পাতি হবি যে! হোক। বঙ্গসন্তান তবুও বাংলা পড়ছে; এভাবেও যদি ফিরে আসা যায় ক্ষতি কি!