মতামত

রুদ্র মাধুর্যে জয়তু নারী

অতিথি হিসেবে বর-কনেকে আশীর্বাদ করলেন কিভের মেয়র ভিতালি ক্লিটশেঙ্কো। তিনি বলেন, ‘প্রতিটি ইউক্রেনবাসীর একটাই আবেদন, দয়া করে যুদ্ধ বন্ধ করুন, সাধারণ মানুষের মৃত্যু আটকান। সেই যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে বিয়ের মতো সামাজিক অনুষ্ঠানের চেয়ে ভালো আনন্দ উপলক্ষ আর কি হতে পারে।’ 

গত দু’দশক ধরেই তাঁরা একসঙ্গে। কিন্তু আনুষ্ঠানিক বিয়েটা ঠিক করে ওঠা হয়নি। দেশ বাঁচাতে হাতে অস্ত্র তুলে নেওয়ার পর প্রথমবার বিয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন লেসিয়া আর ভ্যালেরি। কি জানি আর ক’দিন হাতে সময়! গত মঙ্গলবার কিভের যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়েই কেক-শ্যাম্পেনে বিয়ে সারলেন ভ্যালেরি ফিলিমোনোভ ও লেসিয়া ইভাসচেঙ্কো। সাদা গোলাপ আর সোনার আংটি বিনিময়ের পর আনুষ্ঠানিক দম্পতি হলেন তাঁরা। কেক, শ্যাম্পেন আর সংগীতে মেতে উঠলেন রাশিয়ার আক্রমণ থেকে দেশকে বাঁচাতে প্রাণ বাজি রেখে যুদ্ধে নামা সৈনিকরা।

নারী দিবসে এর চেয়ে ভালো গল্প আর কি হতে পারে? আমাদের দেশে যুদ্ধ নাই একথা ঠিক। তবে সে যুদ্ধ রণাঙ্গনে না থাকলেও হাটে মাঠে বাজারে ঘরে আছে। নারী কী পরবে, কী পরবে না, কীভাবে তাকাবে, কীভাবে তাকাবে না, কী শিখবে, কী শিখবে না- সব ঠিক করে দিতে চায় পুরুষ। যে সমাজে এখনো পরুষ সেজেগুজে একটি মেয়েকে বিয়ে করতে যায়, আর মেয়েটি বিয়ের পর তার পদবি মুছে ফেলে- সেখানে নারী অপমানিত হবে এটাই স্বাভাবিক। বাইরের দেশগুলোতে চার্চে এসে উভয়ে বিবে করে। কারো বাড়ি যায় না কেউ। থাকে না আলাদা করে বর বা কনের বাড়ির বাড়তি আয়োজন। তবু বলবো, বাংলাদেশের নারী এগুচ্ছে। গার্মেন্টস থেকে শিল্প কারখানা, কলম থেকে সুঁচ সর্বত্র তারাই আজ জয়ী। এ জয় আমাদের দেশে নতুন কিছু না। পরুষ মানুক আর না-মানুক, গত ৩০ বছর ধরেই দেশ চালাচ্ছেন দুই নারী। তাঁদের হাতেই ছিল আছে বাংলাদেশের ভার। নারী দিবসের বাইরেও তাই আমরা দেখছি নারীত্বের জয়জয়াকার।

বাংলাদেশ যে এগিয়েছে তার মূল কারণগুলোর একটি হচ্ছে নারী জাগরণ। তার মানে কি এতোদিন নারীরা ঘুমিয়ে ছিলেন? মোটেও না। আপনি যদি আমাদের ইতিহাসের দিকে তাকান, জানবেন নারীরাই ছিলেন চালিকা শক্তি। তাঁরা এখনো সে জায়গায় আছেন, ভবিষ্যতেও থাকবেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে পুরুষ রক্ত দিয়েছেন। কিন্তু প্রথম শহিদমিনার নির্মাণ করলেন কা'রা? নারীরাই এগিয়ে এসে ইট বালি যুগিয়ে গড়ে তুলেছিলেন শহিদমিনার।

একাত্তরের যে কোনো ঘটনাতেই আমরা নারীর জয় দেখবো। আজ যখন ইতিহাস প্রকাশ্য হতে শুরু করেছে আমরা জেনেছি বেগম মুজিবই ৭ মার্চ ভাষণ দিতে যাবার আগে একখিলি পান বানিয়ে বঙ্গবন্ধুর হাতে দিতে দিতে বলেছিলেন- তোমার মনে যা আছে তুমি শুধু তাই বলবা। বাকীটা ইতিহাস।

একাত্তরের যুদ্ধ আর ত্যাগে লাখো মানুষের মৃত্যু যেমন আমাদের স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করেছিল তেমনি পাকিস্তানিদের পরাজয় নিশ্চিত করেছিল বাঙালি নারীদের ওপর অত্যাচার। সে পাপে কি হয়? উপহাদেশের মহাকাব্য রামায়ণ। মহারাজ মহা শক্তির অধিকারী রাবণ ধ্বংস হলেন সীতার কারণে। মহাভারত উপমহাদেশ কেন- বিশ্বের সবচেয়ে বড় এপিক বা মহাকাব্য। তার রূপ রস বর্ণ গন্ধও ক্লাসিক। সে মহাভারতের যুদ্ধে কৌরবের পরাজয়ের অন্যতম বড় কারণ দ্র্রৌপদীর বস্ত্র হরণ। যা না ঘটলে হয়তো এতোটা ক্রোধ বা জেদ থাকতো না পান্ডবদের মনে।

ইসলামের ইতিহাসেও আমরা দেখি নারীর অপমান মানেই পরাজয় ডেকে আনা। 

সৃষ্টির বড় বৈচিত্র এই নারী। যাকে দেখা যায় পাওয়া যায় কিন্তু পুরোটা কখনো বোঝা যায় না। এই নারী শক্তি যে কি সাংঘাতিক শক্তিশালী হতে পারে তার প্রমাণ আমরা ঘরের পাশাপাশি বাইরেও দেখতে পাই। যখন আমাদের সমাজে স্বাধীনতা-বিরোধী আর দালালেরা কিলবিল করতো, একসময় মনে হতো আর বোধকরি উত্তরণ অসম্ভব। তখনো পথ দেখিয়েছিলেন এক নারী। জননী জাহানারা ইমামের শক্তি তখন রাজনৈতিক দল বা যে কোনো শক্তির চেয়ে বড় হয়ে উঠেছিল। আর বাংলাদেশের শাসনভারের কথাই ধরুন- গত ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশ শাসন করছেন দুই নারী। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার অধীনেই চলেছে চলছে বাংলাদেশ। যত মৌলবাদ যত হম্বিতম্বি সব কাগুজে বাঘ। নারীর মুখোমুখি পড়লেই সে বাঘ বিড়াল হতে দেখেছি আমরা ।

কিন্তু নারী দিবস? সে কেন? বা এর মানে কী? সমাজে দেখুন ‘যে পুরুষ তার প্রিয় নারীতে যত মুগ্ধ, তার দাম তত বেশি। সেই মতো উপহারে সেজে ওঠে ভোগবাদী দুনিয়ার কাচ ঝলমল দোকান। হিরের হার বা নিদেনপক্ষে আংটি। নয়তো অনলাইনের ঘর সাজানোর জিনিস আসে স্বামী, প্রেমিকের, বন্ধুর হাত ধরে। শাড়ি, গয়না বা ঘরের জিনিসের মধ্যেই শহুরে নারীর ‘আন্তর্জাতিক দিবস’। এমন নারী দিবস ঘটা করে পালনের ভেতর বাণিজ্য যতোটা, সম্ভাবনা ততোটা নাই। তবু দিবসের একটা গুরুত্ব থাকে। কারণ তা পালন করলে মিডিয়া প্রচার করে। নানা অনুষ্ঠান হয় চারদিকে। এর ভেতরেই ছড়িয়ে পড়ে নারীর সুবাস। এইটুকু ঠিক আছে।

কিন্তু নারীর সমমর্যাদা কিংবা ঘরে-বাইরে তাকে সমান ভাবা আসলেই হয়নি। যে দেশে বাস করি সেখানে নারীদের কর্তৃত্ব প্রশ্নহীন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কেন আমেরিকা এখনো একজন নারী প্রেসিডেন্ট মানতে পারছে না? কেন জাতিসংঘের প্রধান এখনো নারী হতে পারলেন না? এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা পৃথিবীতে নারীর অধিকার বিষয়ে ধারণা পাবো। তবে এ কথা মানি পশ্চিমারা নারীদের মুক্ত রাখতে পেরেছে। যা আমাদের সমাজে হয়ে ওঠেনি। গার্মেন্টস বা অন্য শিল্পে কাজ করা এক বিষয়, সমাজে মাথা তুলে নিজের মতো করে বাঁচা অন্য ব্যাপার। আমরা এই বিষয়ে নারীকে নিরাপদ রাখতে পারি নি।

নারী দিবস বা এমন কোনো আড়ম্বরে যতোটা তারচেয়ে অনেক বেশি জেগে থাকে গৃহকোণে। এমন একটি পরিবারও নেই যে পরিবার নারীর কথা মতো চলে না। যে যতো বড় পদ পদবি ধারণ করুক না কেন ঘরে ঘরে নারীই মূলত পরিচালনা করেন সবকিছু। মায়া মমতা আর স্নেহের পাশাপাশি সময়মতো কঠিনও হতে পারেন তারা। দূরে যাবার দরকার পড়ে না। নিজেকেই প্রশ্ন করুন আপনার সন্তানদের আপনি কতোটা চেনেন আর আপনার স্ত্রী কতোটা জানেন? এটাই তাদের বৈশিষ্ট্য।

সব সময়ই মনে হয়, কোনো বাবা-মায়ের যদি মেয়ে হয়, তারা ভাগ্যবান। এত কিছুর পরেও এটাই মনে হয়। ছেলে আর মেয়ে সমান, যতই বলি আমরা- তবু আমার মনে হয়, যাঁদের কন্যাসন্তান আছে, তাঁরা অনেক বেশি যত্ন পান সন্তানের থেকে। সেটা প্রকৃতিগত কারণেই। ছেলেরা বাবা-মা’কে সেই জায়গাটা দিতে পারে না।

নারী আছে বলেই প্রেম। নারী আছে বলেই সুন্দর অসুন্দরের বর্ণনা। নারীর জন্যই যুদ্ধ থেকে কবিতা। সবকিছু মিলিয়ে নারী মানেই এক অনুপম মাধুর্য আর রহস্যের আধার। যা লিখতে লিখতে আঁকতে আঁকতে ক্লান্ত হলেও ফুরোয় নি। এই অনিঃশেষ মাধুরী নারীই আমাদের প্রাণ শক্তি। জয়তু নারী ।

সিডনি