মতামত

মাতাল বাজার ও টি‌সি‌বির প‌ণ্যের জন্য ‘মুখ ঢাকা’ মধ্য‌বিত্ত

নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে জীবন কতটা বিষিয়ে উঠেছে অন্তত একবার বাজারে না-গেলে অনেকেই তা বুঝতে পারবেন না। কিংবা এই কাঠফাটা রোদে টিসিবি’র ট্রাকের লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও যে পণ্য কিনতে পারছেন না তিনিও বলতে পারবেন কতটা অসহায় সময় তিনি পাড়ি দিচ্ছেন। নিত্যপণ্যের বাজার তার জীবন কতটা এলোমেলো করে দিয়েছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষের ভেতর আরাম কেদারায় বসে কিংবা বিলাসবহুল গাড়িতে চড়ে আর যা-ই হোক বাজার পরিস্থিতি সম্পর্কে বোঝা যায় না। 

একটা ঘটনার বর্ণনা দিলে সাধারণ মানুষের কষ্টের চিত্র আরেকটু পরিষ্কার হবে। গত রবিবার (১৩ মার্চ) দুপুরে সরকারের প্রশাসনযন্ত্রের প্রাণকেন্দ্র বাংলাদেশ সচিবালয়ের ভেতরে হঠাৎ করেই চোখে পড়ল নারী-পুরুষের বিশাল লাইন। একটু কাছে যেতেই দীর্ঘ লাইনের রহস্যটা জানা গেল। সুলভ মূল্যে দুই লিটার সয়াবিন তেল, দুই কেজি মুসুর ডাল, দুই কেজি চিনি আর তিন কেজি পিঁয়াজ নিতে শেষ ফাগুনের তীব্র গরম আর কাঠফাটা রোদ উপেক্ষা করে এবং সরকারি দপ্তরে কাজ ফেলে রেখে অনেকেই লাইনে দাঁড়িয়েছেন সংসারে একমুঠো স্বস্তি আনার আশায়। 

সচিবালয়ের ভেতরে লাইনে দাঁড়ানোটা সংবাদ হিসেবে খুব একটা গুরুত্ব পাবে না। তবে এখানে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটা হচ্ছে যারা লাইনে দাঁড়িয়েছেন তাদের পরিচয়। তারা সবাই সরকারি কর্মচারী। এদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে অসুবিধা হলো না যে, তারা এখন সংসার চালাতে গিয়ে কঠিন সময় পার করছেন। অনেকেরই নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা।’ তাই বাধ্য হয়ে কার্ড করেছেন শুধু টিসিবির নিত্যপণ্য ক্রয় করার জন্য।

চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী ইশরাত জাহান কিংবা আরিফ হোসেন অথবা রবি শিব দাসের মতো যে তিন-চারশ কর্মচারী লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন তাদের প্রত্যেকের কণ্ঠে একই সুর- ‘সংসার যে আর চলে না’। এই হাহাকার শুধু তাদের নয়, দেশের প্রতিটি নিম্নমধ্যবিত্ত নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখি যাতাকলে চিড়েচ্যাপ্টা হচ্ছে। এমনকি মধ্যবিত্তরাও এখন আর কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। 

প্রতিদিন রাজধানীর কোনো না কোনো এলাকায় টিসিবির পণ্য বিক্রি হচ্ছে ট্রাকে। সেই ট্রাকের জন্য তির্থের কাকের মতো অপেক্ষায় থাকেন সাধারণ মানুষ। ‘টিসিবির পণ্য’ লেখা ব্যানার লাগানো ট্রাক দেখার সঙ্গে সঙ্গেই তার পেছনে দৌড়াচ্ছেন নারী-পুরুষ- এমন ছবি ভাইরাল হয়েছে। কার আগে কে লাইনে দাঁড়াবেন- চলে সেই প্রতিযোগিতা। শুধু নয় কেজি পণ্য ক্রয়ের আশায় এই চিত্র এখন প্রতিদিন আমাদের দেখতে হচ্ছে। উঠে আসছে খবরের পাতায়। 

আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে গত এক বছরে ভোজ্যতেল বা বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে আট দফা। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে এই দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক গতিতে। ১১৫ টাকা লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম এখন ১৬৮ টাকা। তাতেও মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের পেট ভরেনি। এরই মধ্যে বিশ্ব বাজারে দাম বৃদ্ধির অজুহাত দেখিয়ে দেশীয় বাজারে সয়াবিন তেলের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে সরকারের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ইচ্ছামত দাম বাড়িয়ে মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা হাতিয়ে নিয়েছে হাজার কোটি টাকা। এক সপ্তাহ আগে এ তথ্য দিয়েছে খোদ জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।   শুধু সয়াবিন তেল নয়, একইভাবে চিনি, ডাল, পিঁয়াজসহ প্রায় প্রত্যেকটি নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। 

ব্যবসায়ীদের এই অতি মুনাফার কারণে মানুষের জীবনে এখন ত্রাহি অবস্থা। জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও বেতন বাড়েনি। অনেকে আবার চাকরি হারিয়ে দুঃসহ বেকার জীবন কাটাচ্ছেন এই মহামারি করোনার অভিঘাতে। 

এখানে সবচেয়ে বেশি অসহায় মধ্যবিত্তরা। তাদের একটা বড় অংশ আত্মসম্মানবোধের কথা চিন্তা করে টিসিবির ট্রাকের লাইনে দাঁড়াতে সংকোচবোধ করেন। আবার বাজার থেকে পণ্য কিনতে গিয়ে দেখেন পকেটে প্রয়োজনীয় টাকা নেই। এই শ্রেণীর অবস্থা একেবারেই নাকাল। তাদের কষ্টের কথা ‘না পারছেন সইতে, না পারছেন কাউকে বলতে’। নীরবে চোখের জল ফেলতে ফেলতে ঘরে  ফিরছেন।  

‘মাতাল’ বাজার পরিস্থিতির কারণে মধ্যবিত্তের সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থা। কঠিন সংকটে থাকা মধ্যবিত্তের আর্তনাদ কারো কানেই পৌঁছাচ্ছে না। তাদের আয় বাড়েনি, কিন্তু গত দুই বছরে ব্যয় বেড়েছে কয়েকগুণ। বাড়ি ভাড়া, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাসের দাম বেড়েছে দফায় দফায়। তেল, চাল, ডালের সঙ্গে আমিষ জাতীয় খাবার মাছ, মাংসের দামও বেড়েছে। সবজির দাম তো নাগালের বাইরে। সন্তানের পড়ালেখার খরচ থেকে শুরু করে চিকিৎসা ব্যয়ও বেড়েছে। 

এই অবস্থায় দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বড় অংশই সংসার চালাতে ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণ করেছেন। সংসারের খরচ কমিয়ে জীবন টেনে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু কোনোভাবেই অর্থনৈতিক সংকট থেকে বের হতে পারছেন না। ঋণের বোঝায় জর্জরিত হচ্ছেন অনেকে। কেউ জানেন না এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ মিলবে কীভাবে? কবেই বা কাটবে এই নাভিশ্বাস অবস্থা?   

লেখক: সাংবাদিক