মতামত

শহুরে ঈদ

প্রতি বছর মুসলমানরা দুটি বড় উৎসব উদযাপন করে। একটি ঈদুল ফিতর, অন্যটি ঈদুল আজহা। ঈদের দিন ঘনিয়ে এলেই সাধারণ মানুষের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়। প্রথমে পরিবারের জন্য কেনাকাটা, পরের ধাপ গ্রামের বাড়ি যাওয়া। সে এক বিরাট কর্মযজ্ঞ। আর কর্মজীবীদের পরিকল্পনা একটু আগেভাগেই করতে হয়। ছুটি থেকে শুরু করে বাড়ি যাওয়া অবধি বেশ গোছানো পরিকল্পনা থাকে।

প্রত্যেক বছরই রাজধানী ঢাকা থেকে কোটির উপরে মানুষ গ্রামের উদ্দেশে পাড়ি দেন। সড়কের সকল ক্লান্তি ভুলে তারা মিশে যেতে চান শেকড়ের সঙ্গে। আবার সবার ক্ষেত্রে চাইলেও সেটা হয়ে ওঠে না। প্রতিবছরই ঢাকার মোট জনসংখ্যার অর্ধেক থেকে যান আপন গৃহে। এখানে আবার দুই ধরনের কারণ থাকে। এক, যারা পরিবার-পরিজন নিয়ে রাজধানীতে বসবাস করেন তারা গ্রামমুখী হতে চান না ভোগান্তির কথা ভেবে। দুই, বেসরকারি চাকরিজীবী- সেটাও সবাই না।

এখানে সবার থেকে অনেকটা আলাদা গণমাধ্যমকর্মীরা। নিউজ মিডিয়ার যুগে গণমাধ্যম প্রসারিত হয়েছে। আগে আমরা গণমাধ্যম বলতে প্রিন্ট মিডিয়াকে বুঝতাম। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে অনলাইন গণমাধ্যম বেশ জনপ্রিয় এবং পাঠকের আস্থার জায়গা তৈরি করেছে। আর অনলাইন মানেই দিনের প্রতিটি ক্ষণ যুক্ত থাকা। এখানে এড়িয়ে যাওয়া নীরব থাকার সুযোগ বা কারণ কোনোটাই নেই। এজন্যই তো অনলাইন সাংবাদিকদের একটি অংশ প্রতিবছর যে কোনো এক ঈদ সেক্রিফাইস করেন।

শহর থেকে গ্রামমুখী মানুষের যখন জনস্রোত; গণমাধ্যমকর্মীরা তখন পাঠক, দর্শককে সর্বশেষ অবস্থা জানাতে চেষ্টা করেন। কারণ পাঠকের চোখ ক্ষণে ক্ষণে আপডেট খুঁজতে থাকে। তারা সমস্যা, সমাধান, পরিস্থিতি জানতে চান। আবার সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেন, পরিবর্তন করেন।

আমার বেলা এই অভিজ্ঞতা অনেকটা পুরোনো হয়েছে বললেই চলে। শহুরে ঈদ আমি বেশ কয়েক বছর ধরে উপভোগ করছি। একটা সময় রোজা শুরু হলেই ক্ষণ গণনা শুরু হতো- কবে আসবে ঈদ। কী কী করবো! আর এখনকার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। আগেই ভাবি, কোন ঈদ বাড়িতে করবো বা আদৌ পারবো কিনা। তবে আফসোস করি না। বাস্তব মেনে নিতে হবে এবং সেটা করা উচিত।

করোনার দুই বছরের অভিঘাত মানুষদের প্রায় একা চলতে শিখিয়েছে। যদিও এখনো করোনার প্রাদুর্ভাব শেষ হয়নি। তবে এদেশের মানুষ সয়ে যেতে শিখেছে, পেরেছে। আর সেটা রেল, বাস, নৌ স্টেশনে ঢুঁ মারলে আরো পরিষ্কার প্রমাণ পাওয়া যায়। গত দুই বছর সরকারি বিধিনিষেধ থাকা সত্ত্বেও মানুষের গ্রামমুখী স্রোত ধরে রাখা যায়নি। হয়তো, এটাই নাড়ির আসল টান।

যাইহোক, ফিরে আসি আগের কথায়। করোনার দুটি বছর সরকারি বিধিনিষেধ মেনে নিজেসহ অন্য সবার কথা চিন্তা করে গ্রামের বাড়িতে ঈদ উদযাপন করিনি। একাকী শহরে দাঁড়িয়ে থেকেছি নামাজে; যখন গ্রামে পরিবার, বন্ধু-বান্ধব ঈদ উদযাপন করছে। আনমনে কিছুটা খারাপ লেগেছে, তবে খানিক বাদেই মেনে নিয়েছি।

পরিবারের সবার ছোট সন্তান। তার উপর সাংবাদিকতার মহান পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করেছি; যেখানে কাজের প্রতি একনিষ্ঠ সবার আগে সবসময় থাকার চেষ্টা করি। মা এসব মানেন না, বুঝতে চান না। বলেন, ‘আর সবাই পারলে, তুমি কেন নয়’। মাকে বুঝানোর চেষ্টা করি। বলি, ‘আম্মা আমাদের (সাংবাদিক) জীবনচিত্রটাই এমন। একটা ঈদ সেক্রিফাইস করতে হয়, প্রয়োজনে দুটো। এটা পেশার প্রতি সম্মান-কর্তব্য’। মা মনের অমতে সায় দেন। আমি সেটা বুঝি, গলা ধরে আসে। বুঝতে দিই না।

এই শহুরে ঈদে আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি। একদমই খারাপ লাগে না। বরং চলমান প্রেক্ষাপটে কোলাহল মেনে নিতে পারি না। হয়তো শহরের প্রতিদিনকার শব্দ দূষণ আমাকে এমন করে তুলেছে। এখন আনন্দের হুল্লোড়ও আমাকে ডাকে না। ঈদের নামাজ শেষে বাসায় শুয়ে-বসে থাকতেই আমাকে বেশি আকর্ষিত করে। তবে ঈদের আগে-পরের দিন চারেক আমাকে খুব উদ্বেলিত করে। সেটার কারণ শহরের পরিবর্তিত চিত্র। এই সময়টাতে রাজধানীকে একদমই চেনা যায় না। সড়কে বের হলেই দুর্দান্ত অনুভূতি কাজ করে। রিকশার টুংটাং শব্দ, ফাঁকা সড়ক আর হর্নমুক্ত যাতায়াত- আহ কী যে শান্তি! এই দৃশ্য তো সারা বছরের স্বপ্ন, যা ধরা দেয় দুই ঈদে।

এই শহরে যেটা ঈদে ভীষণ মিস করি, সেটা কোলাকুলি-করমর্দন। করোনাতে এমনিতেই বিরত থাকতে হয়েছে। তবে গ্রামে সে চিত্র করোনাকালেও পাল্টেছে বলে মনে হয় না। এবার সেই সুযোগ এসেছে। সহকর্মীদের সঙ্গে অন্তত ঈদের রেওয়াজ পালন করা সম্ভব হবে। অফিস আমাদের দ্বিতীয় পরিবার। দিনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় এখানেই দিই। তাই সহকর্মীদের প্রতি টান-মায়া কোনটাই নেহায়েত কম নয়। শহুরে ঈদে এরাই প্রকৃত আনন্দের সঙ্গী।

এই শহরে ঈদ কাটিয়ে দিলেও, ঈদি পাওয়া হয় না। এখানে যে যার মতো করে আনন্দ গ্রহণ করে। গ্রামে ঈদের নামাজের পর আম্মাকে সালাম করলেই হাতে গুঁজে রাখা পকেটে দিতো। কর্মজীবনে পরিবার এখন অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। ঈদ-অনুষ্ঠান ছাড়া সবার একসঙ্গে হওয়া প্রায় দুষ্কর। আমাদের পরিবারের চার ভাই-বোন শেষ একসাথে হয়েছিলাম ২০১২ সালে। এরপর থেকে হয়ে ওঠে না, প্রত্যেকের নিজ নিজ ব্যস্ততায়। ফলে ঈদিও পাওয়া বা নেওয়া হয় না। 

এবার তো হয়ে গেলো, ঈদ শেষ। সামনে যাবো। হ্যাঁ, মায়ের কাছে। শেকড়ের টানে। ঈদিও পুষিয়ে নেবো। মা হয়তো জমিয়ে রেখেছেন। একটা দীর্ঘসময় পরে শহুরে ঈদকে মিস করতে চাই ভীষণভাবে। সবাইকে ঈদুল ফিতরের শুভেচ্ছা, ঈদ মোবারক।

লেখক: সাংবাদিক