মতামত

শোলাকিয়ায় ঈদের নামাজ: ঝুম বৃষ্টিতে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা

কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক শোলাকিয়ার মাঠে লাখো মুসল্লির সঙ্গে ঈদের নামাজ আদায়ের ইচ্ছা আমার অনেক দিনের। এবার ঈদের ছুটি পেয়ে সেই ইচ্ছাপূরণের জন্য আগেভাগেই কিশোরগঞ্জ চলে আসি। আমি যেখানে অবস্থান করছিলাম সেখান থেকে শোলাকিয়ার মাঠে প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে। তাই ১০টায় ঈদ জামাত হলেও বাসা থেকে বের হই সাড়ে ৭টায়। বাড়তি ১৫ টাকা ভাড়া গুণে ৮টার পর পরই পৌঁছে যাই মাঠের প্রবেশ পথে। পুরো এলাকা লোকে-লোকারণ্য। বিভিন্ন এলাকার মুসল্লিদের সব পথ-স্রোত যেন মিশেছে শোলাকিয়ার প্রবেশ পথে।

জনস্রোতে গা এলিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যাই মূল মাঠে। সবুজ ঘাসের গালিচার ওপর জায়নামাজ বিছিয়ে বসে পড়ি এবং আল্লাহকে স্মরণ করতে থাকি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে জনস্রোত। মূল মাঠের প্রত্যেকটি প্রবেশ পথে বাড়ে মানুষের ভিড়। মানুষের চাপে তিন নম্বর গেটের সিকিউরিটি স্ক্যানার অকেজো হয়ে যায়। সেটাকে পথ থেকে সরিয়ে পাশে রাখা হয়। এরপর নির্বিঘ্নে মুসল্লিরা প্রবেশ করেন মাঠে। যে যেখানে সুযোগ পান, জায়নামাজ, পাটি, পলিথিন, গামছা, লুঙ্গি, বেড শিট, পেপার বিছিয়ে বসে পড়েন। যেহেতু মহামারির করোনার কারণে দুই বছর পর এখানে ঈদ জামাত হচ্ছে তাই মুসল্লিদের ভিড় ছিল অন্যান্য বারের চেয়ে অনেক বেশি। অল্প সময়ের ব্যবধানে মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়।

ঘণ্টাখানেক বসে থাকার পর পেট মহাশয় বিদ্রোহ শুরু করলেন। সকালে মলিদা, নবাবী সেমাই, শুকনো সেমাই ও অল্প ভাত খেয়ে বের হয়েছিলাম। যেহেতু নামাজ শেষ করে ফিরতে ফিরতে দুপুর হবে ধরেই নিয়েছিলাম। এতদিন রোজা রাখার কারণে সকালের খালি পেট হঠাৎ ভরপুর অভিজ্ঞতায় ভড়কে যায়। সঙ্গীকে জায়গা দেখে রাখতে বলে আমি ছুটলাম জনস্রোতের বিপরীতে। জনস্রোত যেখানে, লাইন হবে সেখানে- সেটা ছিল অনুমেয়। গিয়ে অভিজ্ঞতাও হলো তাই। দুজনের পেছনে আমি। হঠাৎ দেখি একজন পুলিশ সদস্য মলিন বদনে এদিকে ধেয়ে আসছেন। মনে মনে ভাবছিলাম আমার লাইনের দিকে যেন না আসেন। কিন্তু ভাবনায় কী আসে যায়, তিনি এসে জিজ্ঞেস করলেন সিরিয়াল নাকি? আমি ঘাড় নেড়ে ইশারায় উত্তর দিলাম। করুণ কণ্ঠে তিনি বললেন, ভাই যদি সম্ভব হয় আমাকে একটু আগে দিয়েন; কঠিন চাপে বাধ্য হয়ে ডিউটি ফেলে আসছি। আমার পালা যখন আসলো তখন তার দিকে তাকালাম। তার মলিন চেহারা দেখে মায়া হলো। নিজেকে আরো একটু নিয়ন্ত্রণের চ্যালেঞ্জ নিয়ে তাকে বললাম- আপনি যান প্লিজ। তিনি প্রথমে ইতস্তত করে পরে ধন্যবাদ দিয়ে প্রবেশ করলেন। তাকেও ধন্যবাদ, যে বেশি সময় নেননি।

সেখান থেকে বের হয়ে এবার ওজু করার পালা। ওজুখানায় যথারীতি প্রচুর ভিড়। সামনে পুকুরে তুলনামূলক কম। তাও কয়েকজনের পেছনে দাঁড়িয়ে সুযোগ হচ্ছে। পানির কোনো রং নেই, কিন্তু কিছু কিছু পুকুরের পানির রং হালকা টিয়ে রঙের হয়। এই পানিও ছিল তেমন। সকাল থেকেই আকাশ ছিল গোমরা মুখে। সান বাঁধানো ঘাটে হাঁটু পানিতে নেমে যখন ওজু করছি, তখন পিঠে বৃষ্টির ফোঁটার শীতল পরশ টের পাচ্ছিলাম। দ্রুত ওজু সেরে ফিরলাম মাঠে। ততক্ষণে বৃষ্টি একটু একটু করে বাড়ছে।

আসতে না আসতেই আমার সঙ্গী বললেন, বাইরে জায়নামাজ সাইজের পলিথিন কিনতে পাওয়া যায়। দুটো নিয়ে আসো। আমি আবার ছুটলাম পলিথিনের খোঁজে। কিন্তু সেই পলিথিনের যে আর দেখা পাই না। অগত্যা ছোট পলিথিনের ব্যাগ কিনতে গেলাম টঙ দোকানে। গিয়ে দেখি বিশাল কাড়াকাড়ি। হট কেকও এরকম বিক্রি হয় না। সুযোগ বুঝে দোকানিও এক পিস পলিব্যাগ ৫ টাকা করে নিচ্ছেন। আমি ১৫ টাকা দিলেও পেছনের ধাক্কা সামাল দিতে না পেরে পেলাম মাত্র ২টা। দোকানদারের কথা শোনার সময় কই? পেছনের মানুষেরই বা সময় কই? ধাক্কায় এক সাইডে চলে গেলাম।

ততক্ষণে বৃষ্টি ঝরছে মুষলধারে। পলিথিন নিয়ে এসে সঙ্গীকে আর খুঁজে পাই না। আজব! এখানেই তো ছিল! গেল কই? বেশ কিছুক্ষণ খোঁজার পর হঠাৎ তার ডাক শুনতে পেলাম। চেয়ে দেখি পাশের ব্যক্তির জায়নামাজ সাইজের পলিথিনের নিচে তিনি আশ্রয় নিয়েছেন। এটাকে আসলে আশ্রয় বলে না, কেবল মাথা গোঁজা বলে। একজনের বামপাশ, অন্যজনের ডানপাশ ভিজে সারা। যে যেভাবে পারছেন নিজেকে কোনোরকমে রক্ষা করার চেষ্টা করছেন বৃষ্টি থেকে। জায়নামাজ থেকে শুরু করে যে যা বিছিয়ে মাঠে বসেছিলেন, সেগুলো এখন পায়ের নিচ থেকে মাথায় উঠেছে। কিন্তু কাকভেজা হওয়া ঠেকায় কে? বৃষ্টির মধ্যেই একটু পর পরই র‌্যাবের একাধিক ড্রোন টহল দিচ্ছিল।

ধীর ও দ্রুতলয়ে বৃষ্টি চললো অনেকক্ষণ। কিছুক্ষণ পর মাইকে শোনা গেল কাতার সোজা করেন। কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞা মেনে ছাতা কিংবা মোবাইল কিছুই নিইনি আমরা। সে কারণে সময়ের ব্যাপারে রীতিমতো অন্ধকারে ছিলাম। এই ঘোষণা শুনে বুঝলাম ১০টা বাজে। ইতোমধ্যে প্রায় ১ ঘণ্টার মতো বৃষ্টিতে ভেজা হয়ে গেছে। কিন্তু আশ্চর্য বিষয় একজন মুসল্লিও মাঠ ত্যাগ করেননি! তাদের মধ্যে যেমন বৃদ্ধরা ছিলেন, তেমনি ছিল ছোট ছোট শিশুরাও।

অতিরিক্ত তিন তাকবিরে নামাজ শুরু হলো, সঙ্গে মুষলধারে বৃষ্টিও। ইমাম সুরা ফাতিহার শেষ আয়াতে ওয়ালা দ্দ-ল্লি-ন বললেন, মুসল্লিরা সমস্বরে আমিন বলার আগেই এলাকাজুড়ে বিদ্যুতের চোখ ঝলসানো ঝলকানি। মুহূর্তেই আকাশ-পাতাল কাঁপিয়ে বজ্রপাত। সঙ্গে সঙ্গে সাউন্ড সিস্টেম অফ! ইমাম কী বলছেন, আমরা পেছনে থেকে কিছুই শুনছি না। শোনার কথাও না। অপেক্ষা করছি। হঠাৎ সামনে থেকে মুসল্লিদের কণ্ঠে সমুদ্রের গর্জনের মতো ভেসে আসতে থাকলো আল্লাহু আকবার। এ যেন ঠিক সমুদ্রের ঢেউ- যেটা উঁচুনিচু হয়ে আসতে আসতে পাড়ে মিইয়ে যায়। মুসল্লিদের আল্লাহু আকবার ধ্বনি পৌঁছে গেলো একেবারে শেষ সারি এবং তার পেছনেও। আমরা রুকুতে গেলাম। কিছুক্ষণ পর আবার ভেসে এলো- সামিআল্লাহ হুলিমান হামিদা। রাব্বানা লাকাল হামদ- বলে আমরা দাঁড়ালাম। এরপর আল্লাহু আকবার গর্জন শুনে সিজদায় গেলাম। ভেজা ঘাসের ওপর ভেজা জায়নামাজ, তার ওপর ভেজা মাথা ঠেকিয়ে আল্লাহকে সিজদা করার অনুভূতি ছিল অন্যরকম।

ইতোমধ্যে জেনারেটর চালু করায় সাউন্ড সিস্টেম কাজ করতে শুরু করেছে। অতিরিক্ত ৬ তাকবিরে নামাজ শেষ হলো। খুতবা শেষে মোনাজাতের পালা। সে সময় বৃষ্টি ভীষণ তেজে বর্ষিত হচ্ছিল। মোনাজাতের জন্য তোলা হাত বৃষ্টির ফোঁটার ভারী বর্ষণে যেন নিচে নেমে যাচ্ছিল। তার মধ্যেই আমিন আমিন ধ্বনিতে লাখো মুসল্লি ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠছিলেন। তাদের চোখের জল আর বৃষ্টির জল মিলে-মিশে যেন একাকার। মুসলিম উম্মাহ, দেশ, সরকার ও জনগণের কল্যাণ কামনায় শেষ হয় মোনাজাত।

বৃষ্টির শীতল পরশে ঠান্ডা শরীর আর মোনাজাতে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে প্রশান্ত হওয়া মন নিয়ে এবার ফেরার চ্যালেঞ্জ। যথারীতি মূল মাঠ থেকে বের হওয়ার প্রত্যেকটি গেটে বিশাল ভিড়। কোনোরকমে সেই ভিড়ের মধ্যে নিজেকে সপে দিয়ে ধাক্কায় ধাক্কায় অটোমেটিক বেরিয়ে গেলাম পাশের রাস্তায়। সেখানে তখন পানি জমে গেছে। তাতে জুতা তো বটেই পায়ের পাতাও ভিজে যাচ্ছে। মুসল্লিরা ‘আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর, ওয়ালিল্লাহিল হামদ্’ পাঠ করতে করতে ভীষণ আস্তে চলা জনস্রোতের সঙ্গে আস্তে আস্তে ধাক্কা খেতে খেতে মেইন রাস্তায় উঠে আসেন। তিন লক্ষাধিক মুসল্লির চাপে যানবাহনের সংকট সৃষ্টি হওয়া খুব স্বাভাবিক। বৃষ্টির মধ্যে আধা কিলোমিটার তন্ন তন্ন করে খুঁজেও একটা সিএনজি, টমটম, অটো কিংবা অটোরিকশা মিলাতে পারিনি। বৃষ্টির মধ্যে রাস্তায় এক ঘণ্টা ঠাঁই দাঁড়িয়েছিলাম।

অবশেষে বেশ কিছুটা সামনে এগিয়ে গিয়ে সেখানে একটি টমটম পাই। ড্রাইভারের পাশে সিট ফাঁকা একটি, আমরা দুজন। নিরুপায় হয়ে ড্রাইভারের পাশেই চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে বসে যাই। আমি কেবল একটু করে বসতে পেরেছিলাম। আমার অর্ধেক টমটমের ভেতরে, বাকি অর্ধেক বাইরে। চলন্ত টমটমের গতির সঙ্গে বৃষ্টির গতি যোগ হয়ে এক একটা বৃষ্টির ফোঁটা সুঁইয়ের গুঁতোর মতো লাগছিল কপালে আর গালে। ঝুঁকি নিয়ে ১৮ মিনিটের মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছে যাই। যখন বাসার সিঁড়ি দিয়ে উঠছিলাম তখন প্রায় তিন ঘণ্টা বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডায় জমে যাচ্ছিলাম। দাঁত-কপাটি ঠকঠক করছিল। বাসায় প্রবেশ করে দেখি সময় তখন দুপুর ১২টা ৫ মিনিট। তাতে কী? যে অভিজ্ঞতা আর প্রশান্তি পেয়েছি তাতে এমন বৃষ্টিতে ভেজা সার্থক হয়েছে।

লেখক: সাংবাদিক