মতামত

বিসিএস-এ চিকিৎসক, প্রকৌশলীদের প্রথম পছন্দ প্রশাসন কেন?

৩৮তম বিসিএস পরীক্ষায় প্রশাসন ক্যাডারে চাকরিতে প্রবেশ করেছেন বুয়েট থেকে পাস করা ইঞ্জিনিয়ার ৮২ জন, কুয়েট থেকে ৬৪ জন, রুয়েট থেকে ৫৯ জন এবং চুয়েট থেকে ৫৫ জন। সম্প্রতি ৪০তম বিসিএস পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে সরকারি কর্ম কমিশন সরকারের কাছে নিয়োগের জন্য চূড়ান্ত সুপারিশ পেশ করেছে যেখানে প্রশাসন, পররাষ্ট্র ও পুলিশ ক্যাডারে নিয়োগের সুপারিশপ্রাপ্তদের তালিকায় সর্বোচ্চ স্থান প্রকৌশলীদের।

উল্লেখ্য অতীতের অন্য সব বিসিএস পরীক্ষার নিয়ম আমূল পরিবর্তন করে শুধু মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহনের পর এটিই প্রথম ব্যাচ। অতএব, বোঝা যাচ্ছে যারা এই ৪০তম বিসিএস-এর মাধ্যমে  সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন তারা প্রকৃতই মেধাবী। প্রশ্ন হচ্ছে এই মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিশেষায়িত বিষয়ে পড়াশোনা করে ইতোমধ্যে সুনামের সঙ্গে শিক্ষাজীবন শেষ করে তারা কেন প্রশাসক হতে চাচ্ছেন? এক কথায় উত্তর হচ্ছে, প্রশাসন ক্যাডারের যে সুযোগ-সুবিধা ও হাঁক-ডাক সমাজে বিরাজ করছে সেই অনুপাতে মেধাবী প্রকৌশলীদের দেশে মূল্যায়ন নেই। সে কারণেই মূলত এসব মেধাবীরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। 

বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস ২৬টি ক্যাডার নিয়ে গঠিত। এর মধ্যে কয়েকটির সাব ক্যাডার রয়েছে। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা, বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের মধ্যে একটি। তবে, এগুলোর মধ্যেও রয়েছে অনেক তফাৎ ও বৈষম্য। অন্যান্য ক্যাডারের সাথে শিক্ষা ও বিশেষায়িত ক্যাডারের যে বৈষম্য সেগুলো সবারই জানা। প্রতিটি চাকরির, প্রতিটি ক্ষেত্রের রয়েছে আলাদা কাজ, আলাদা বৈশিষ্ট্য ও কাজের ধরন। এটি আমাদের মেনে নিতে হবে। কিন্তু একটি থেকে আরেকটি যে বিশাল ব্যবধানে থাকবে সেটি কাম্য নয়। সেটি মিনিমাইজ করার ব্যবস্থা আমাদের থাকতে হবে। এটি রাষ্ট্র থেকেই করা উচিত। সেটি নেই বলেই আজ ডাক্তাররা ব্যাঙ্কার, ফিন্যান্স থেকে পাস করা শিক্ষার্থী ইংরেজি কিংবা বিজ্ঞানের শিক্ষক, কৃষিবিদ হচ্ছেন পুলিশ!

প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে এর পেছনে একটি যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায়। সেটি হচ্ছে ডাক্তার ও প্রকৌশলীগণ  মেধার স্বাক্ষর রেখেই এসব প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছিলেন, প্রশাসন ক্যাডারে অর্ন্তভুক্ত হয়ে আরও একবার সেই স্বাক্ষর তারা রেখেছেন। বর্তমান ধারায় যেটি হচ্ছে- একজন ডাক্তার চিকিৎসা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হচ্ছেন অতিরিক্ত সচিবের পদমর্যাদায়। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের সচিব যার কাছে তিনি জবাবদিহি করছেন তিনি হয়তো রাষ্ট্রবিজ্ঞান কিংবা ইংরেজি কিংবা অন্য কোনো বিষয়ে পড়াশোনা করে প্রশাসন ক্যাডারে চাকরি করার সুবাদে সচিব হয়েছেন। বিষয়টি কিন্তু এখন অনেকটা মিনিমাইজ হবে যখন একজন ইঞ্জিনিয়ার কিংবা একজন ডাক্তার প্রশাসন ক্যাডারে ঢুকে সচিব হবেন। 

বর্তমান বাস্তবতায় প্রশাসন, পুলিশ এবং পররাষ্ট্র ক্যাডারই চোখে পড়ার মতো এবং অন্যান্য ক্যাডার থেকে বলা যায় এগুলো শক্তিশালী। আমাদের মেধাবী চিকিৎসক ও প্রকৌশলীগণও তাদের নিজেদের দক্ষতানির্ভর পেশায় না গিয়ে এই পদগুলোর দিকে ঝুঁকছেন। সৎ উপায়েই যদি বলি- একজন ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার কি একজন প্রশাসন ক্যাডারের চেয়ে কম উপার্জন করেন? বরং অনেক বেশি করেন। প্রশাসন ক্যাডারের কেউ সৎ উপায়ে একজন ডাক্তারের চেয়ে বেশি উপার্জন করতে পারেন না। 

উদাহরণ দিয়ে বলি, প্রশাসন ক্যাডারের সৎ কর্মকর্তা কি নিজে গাড়ি কিনতে পারেন? পারেন না। পুলিশ অফিসার পারেন না। একটা পর্যায়ে গিয়ে ডেপুটি সেক্রেটারি কিংবা জয়েন্ট সেক্রেটারি হন। পুলিশে যারা এসপি বা ডিআইজি হন তখন সেই সক্ষমতা অর্জন করেন। তবে, বিসিএস পররাষ্ট্র ক্যাডারের একটি আলাদা চার্ম আছে, সেটি হচ্ছে দেশের বাইরে ভ্রমণ ও চাকরির বহু সুযোগ। আর সরকারি টাকায় দেশের বাইরে যাওয়ার সুযোগটিকে সবাই পছন্দ করবেন এটিই স্বাভাবিক। 

ডাক্তার যদি সরকারি কিংবা বেসরকারি হাসাপাতালে চাকরি করেন, তাহলে তার মানবসেবার সুযোগ রয়েছে। তিনি প্রশাসনে গিয়ে ফাইল চালাচালি, অধনস্তদের ধমক, ‘স্যার স্যার’ সম্বোধনে খুশি হওয়া, আর সাধারণ মানুষকে ভয়-ভীতি দেখানোর মধ্যে কি মজা পান বুঝি না। একজন ইঞ্জিনিয়ার মনের মাধুরী মিশিয়ে নকশা করেন, সৃজনশীল কাজ, তিন নতুন নতুন সৃষ্টির নেশায় মত্ত থাকবেন। অথচ তিনি প্রশাসন ক্যাডারে গিয়ে কোথায় কাজে লাগাবেন তার অর্জিত জ্ঞান? 

অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে, আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিভাগে যারা পড়াশোনা করছেন, ক্লাসে শিক্ষকদের কথা শুনছেন, পত্রপত্রিকা পড়ছেন, বিষয়গুলো ক্রিটিক্যালি অ্যানালাইসিস করছেন, বিভিন্ন দেশের পররাষ্ট্রনীতি পড়ছেন, কমপক্ষে বিদেশী একটি ভাষা শিখেছেন তারা যদি পররাষ্ট্র ক্যাডারে না যান তাহলে একজন ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার কিংবা কৃষিবিদ ওই ক্যাডারে গিয়ে কতটা অবদান রাখবেন সেটি একটি বড় প্রশ্ন। প্রথম দিকে অনেক বছর তো সে অর্থে তিনি অবদানই রাখতে পারবেন না। তাকে শিখতে হবে। একজন ডাক্তারের মেধা আছে, কৃষিবিদের মেধা আছে, শিক্ষক যিনি একটি বিশেষ বিষয়ে পড়াশোনা করে এসেছেন তার মেধা আছে কিন্তু এক বিষয়ের মেধা অন্য বিষয়ের কাছে শিশুতুল্য। যেমন একজন কৃষিবিদের কাজ একজন ইঞ্জিনিয়ার করতে পারবেন না। প্রশাসন ক্যাডারেও তাদের অন্তুর্ভুক্তির ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য। 

প্রশাসন ক্যাডারের আর পুলিশ ক্যাডারের সাময়িক দাপট দেখে সমাজে একটি অন্যরকম ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে একজন প্রশাসন ক্যাডারের এন্ট্রি লেভেলের কর্মকর্তা কি আগের মতো সুবিধা ভোগ করেন? তিনি কি উপজেলা পর্যায়ে প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করতে পারেন? অথচ এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা হয়ে উঠেছে বিসিএসমুখী। শিক্ষার্থীরা প্রথমবর্ষ থেকেই বিসিএস গাইড পড়তে শুরু করেন। সেটির প্রতি তারা যতটা গুরুত্ব দেয় বিভাগীয় পড়ায় ততটা নয়। কারণ মুখ্য উদ্দেশ্য বিসিএস অফিসার হওয়া। খুব কমসংখ্যক শিক্ষার্থী যারা যে বিষয় পড়ছেন সেই বিষয়ের গভীরে ঢুকছেন। অর্থাৎ পড়া ও জানার আনন্দ থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছেন। তারা সমাজ পরিচালনা করতে গিয়ে তাদের সে রকম  দর্শনই কাজে লাগাচ্ছেন। ফলে সমাজে সৃষ্টি হয়েছে প্রকৃত জ্ঞানার্জন বিমুখতা। 

যখন দেশের তরুণ ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ার গণহারে পেশা বদলের চয়েস দেন তখন বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। চিকিৎসা, প্রকৌশল ও কৃষিবিদ্যায় স্নাতকেরা তাদের পেশাগত বিদ্যাবলয় ছেড়ে কেন বেরিয়ে আসতে চাচ্ছেন? উত্তর পেশাগত জীবনে চরম আন্তঃক্যাডার বৈষম্য। এই বৈষম্য রাষ্ট্রকেই দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে। 

যে সমাজ চায় না যে, ডাক্তার রোগীর সেবা করুক, যে সমাজ চায় কৃষিবিদরা কৃষির দিকে না তাকিয়ে পুলিশ হোক, যে সমাজ চায় প্রকৌশলীরা প্রকৈাশলবিদ্যা কাজে না লাগিয়ে ফাইল চালাচালি করুক, সে সমাজে তো আমরা এসব পেশাজীবীদের দোষ দিতে পারি না।

লেখক: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক