মতামত

দ্বিমুখী সঙ্কটে শ্রীলঙ্কা

অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে শ্রীলঙ্কার বর্তমান উত্তাল পরিস্থিতির শুরু। বিক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে জনগণ। সহিংসতায় মারা গেছেন একজন সরকার দলীয় এমপি। সহিংস আন্দোলন ঠেকাতে কারফিউ জারিসহ কঠোর অবস্থানে গেছে সে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

তীব্র অর্থনৈতিক দুরবস্থা, জনরোষ, নেতৃত্বের ব্যর্থতা এবং বর্তমান সংকটপূর্ণ পরিস্থিতি শ্রীলঙ্কাকে কোণঠাসা করেছে। বহু বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা একটি পরিবারের দাপট জনরোষের সৃষ্টি করেছে। সেখানে দুই দশক ধরে রাজাপাকসে পরিবার ক্ষমতায় আছে। আলউইন রাজাপাকসের হাত ধরেই গড়ে ওঠে এসএলএলপি (শ্রীলঙ্কা ফ্রিডম পার্টি)। ২০০৫ সালে মাহিন্দা রাজাপাকসে প্রেসিডেন্ট ও তার ভাই গোতাবায়া প্রতিরক্ষা সচিব ছিলেন। ২০২০ সালের পার্লামেন্টারি নির্বাচনেও জয় পান তারা। এই পরিবারের প্রায় সবাই রাজনীতিতে প্রবেশ করেছেন। জনগণের তীব্র আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজপাকসে পদত্যাগ করেছেন। পদত্যাগ করেছেন প্রায় সব মন্ত্রী। এখন কেবল প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া আছেন। তারও পদত্যাগ দাবি করছেন বিক্ষোভকারীরা। শ্রীলঙ্কার বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ী করা হয় এই রাজপাকসে পরিবারকে। ফলে, এই পরিবারের রাজনৈতিক ভবিষ্যত কী হবে, তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। দ্রতই নতুন মন্ত্রিসভা না হলে রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণ হবে না। সেক্ষেত্রে সামরিক অভ্যুত্থানের শঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাছাড়া, এই চরম সংকটময় মুহূর্তে আছে গুজব ছড়ানোর আশঙ্কা, যা পরিস্থিতিকে আরও খারাপের দিকে ঠেলে দিতে পারে। যদিও প্রতিরক্ষামন্ত্রী কমল গুনারত্নে জানিয়েছেন, এ ধরনের কোনো শঙ্কা নেই। এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, কোনো দেশ ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে পড়লে, কেবল তখনই সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা গ্রহণের জন্য আহ্বান জানানো হয়। শ্রীলঙ্কায় এখনো সে পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। সেনাবাহিনীরও সে ধরনের কোনো চিন্তা নেই।

এখন প্রশ্ন হলো শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতির বর্তমান অবস্থা কী? দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এখন অর্থনীতিতে সবচেয়ে বিপর্যস্ত সময় পার করছে চায়ের দেশ বলে খ্যাত দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা। জনরোষের অগ্নিকাণ্ডে পুড়ছে শ্রীলঙ্কা।

শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট চন্দ্রিকা বন্দরনায়েক কামারাতুঙ্গা বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশে সেনাশাসনের হাতছানির বিষয়ে জনগণকে সতর্ক করেছেন। তিনি চলমান পরিস্থিতিতে শ্রীলঙ্কায় ঐক্যমতের মাধ্যমে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। ২ কোটি ২২ লাখ জনসংখার দেশটি সংকটপূর্ণ পরিস্থিতি পার করছে। শ্রীলঙ্কার বর্তমান সংকটের পেছনে যে ঋণ একটি বড় কারণ, তা এখন মোটামুটি সবারই জানা।

শ্রীলঙ্কার ইতিহাস একটু জানা দরকার। শ্রীলঙ্কা ব্রিটিশ উপনিবেশের অংশ ছিল। স্বাধীন হয় ১৯৪৮ সালে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের বাবা ডি এ রাজাপাকসে ১৯৪৭ সালে হামবানটোটা জেলা থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৫১ সালে শ্রীলঙ্কা ফ্রিডম পার্টি গঠনের মধ্য দিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে পরিবারটি গুরুত্বপূর্ণ হতে শুরু করে। রাজাপাকসে পরিবার বহু বছর ধরেই শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে প্রভাবশালী। ২০২০ সালের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন গোতাবায়া। অথচ এই সময়ে এ পরিবারকে শ্রীলঙ্কার ডুবন্ত পরিস্থিতির জন্য দায়ী করা হচ্ছে। মূলত, অদূরদর্শী সিদ্ধান্তই দেশটাকে এ পর্যায়ে এনে দাঁড় করিয়েছে। গত দুই বছরের করোনা মহামারির কারণে অর্থনীতির গতি শ্লথ হওয়া, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এবং শ্রীলঙ্কা সরকারের কয়েক বছরের কিছু সিদ্ধান্ত বর্তমান পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। দেশটির রিজার্ভ প্রায় শূন্য। মুদ্রা ঘাটতি আরও তীব্র হয়েছে। খাদ্যপণ্যের দাম গত বছরের তুলনায় এ বছর বেড়েছে ৩০ শতাংশ।

বিভিন্ন প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করার জন্য যে অর্থের দরকার, তা শ্রীলঙ্কার হাতে নেই। ফলে, খাদ্যপণ্য থেকে শুরু করে ওষুধ ও অন্যান্য চিকিৎসা সামগ্রীর ঘাটতি ব্যাপক। অবস্থা এমন যে শ্রীলঙ্কার মানুষকে বিদ্যুতের অভাবে একটি বড় সময় পার করতে হচ্ছে।

শ্রীলঙ্কা মূলত চা উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। দেশটিতে নগদ অর্থের চরম সংকট চলছে। সাগরপাড়ের চমৎকার এই দেশটি এখন মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকটে। ভয়াবহ এই অর্থনৈতিক সংকট একদিনে সৃষ্টি হয়নি। এর পেছনে আছে একাধিক সিদ্ধান্ত বা পরিকল্পনা, যা আজকের সময়ের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। বিভিন্ন কারণে শ্রীলঙ্কার জনগণ এখন মারাত্মক পরিস্থিতিতে পড়েছে। প্রতিদিনের খাবার জোগাড় করতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। কারণ, পণ্য সংকটে দাম আকাশছোঁয়া। বৈশ্বিক অর্থনীতির পরিস্থিতিও সুবিধার নয়। করোনার ধাক্কা সামলে উঠতে না উঠতেই পৃথিবী রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে ধুঁকছে। এর জেরে বিশ্বজুড়েই মূল্যস্ফীতি ব্যপক আকার ধারণ করেছে। অর্থনৈতিক অস্থিরতা, বেকারত্ব,খাদ্য সঙ্কট,পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি প্রভৃতি জীবনযাত্রাকে অস্থির করে তুলেছে বিশ্বজুড়েই।

২০১৯ সালে বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে ক্ষমতায় আসা দেশটির প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের সরকারের বিরুদ্ধে এখন দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ উঠেছে। ২০১০ সাল থেকে ২০২০ সালের মধ্যে দেশটির ঋণ দ্বিগুণ হয়ে যায়। তারপর করোনায় অর্থনীতি চাপের মধ্যে পরে। ২০২০-২১ সালে কলম্বোকে ২ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হয় চীনকে। এতে চাপ পরে দেশটির রিজার্ভের ওপর। শ্রীলঙ্কার রিজার্ভ কমতে কমতে এখন পাঁচ কোটি মার্কিন ডলারেরও নিচে নেমে গেছে। অথচ ২০২৬ সালের মধ্যে শ্রীলঙ্কাকে বিদেশি ঋণের আড়াই হাজার কোটি ডলার পরিশোধ করতে হবে। যার মধ্যেই চলতি বছরই দিতে হবে অন্তত ৭০০ কোটি ডলার। ইতোমধ্যেই বিদেশি ঋণের কিস্তি প্রদান স্থগিত করা হয়েছে। এই অর্থনৈতিক সঙ্কটই শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে। জনগণ এখন একটি স্বাভাবিক জীবনব্যবস্থা চায়, যেখানে তারা অন্তত মৌলিক দাবিগুলো সামর্থ্যের মধ্যেই পূরণ করতে সক্ষম হয়। রাজাপাকসের পরিবারের ওপর জনগণের অনাস্থা জন্মেছে। কিন্তু, এই পরিস্থিতি থেকে শ্রীলঙ্কাকে বের করে আনতে পারে কে? প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া কতদিন পরিস্থিতির সামাল দিতে পারবেন? কারণ, জনগণ তারও পদত্যাগ চায়। শ্রীলঙ্কাকে এখন অর্থনীতির সাথে সাথে রাজনৈতিক সংকটও সামাল দিতে হবে। সুতরাং সবার মধ্যে ঐক্যের বিকল্প নেই।