মতামত

বঙ্গবন্ধু: মননে ও চেতনায়

নিজেদের দিকে তাকিয়ে আমি নিতান্তই নিরুদ্যোম সাধারণ বাঙালিকে দেখি, যারা মোটাদাগে মাথামোটা প্রাণী। যাদের অধিকাংশই বিত্তহীন বা নিম্নবিত্ত হয়েও অসম্ভব রকমের মধ্যবিত্ত স্বভাবের- নিজের হাঁড়ি-কড়াইয়ের ঠোকাঠুকির সংগীতেই ভরে রাখে প্রাণ, আর নিজের মাথায় চড়ার আগে কোনো ব্যথা নিয়েই তাদের মাথাব্যথা থাকে না। গায়ে পায়ে মুখে তাদের যে-মাটির ছাপ, সুফলা হলেও যার ফলা তীক্ষ্ণ নয় খুব, সুযোগসন্ধানীদের পায়ে দলিত মথিত হয়েই টিকে আছে তা। এই মুখচোরা মাটি আর গোবেচারা মানুষের মধ্যেই ‘খোকা’র জন্ম। এই আমাদের মতো সাধারণ বাঙালির স্বেদ ও ক্লেদ ভরা বাতাসে শ্বাস নিয়ে নিয়েই তিনি হয়ে উঠেছেন বঙ্গবন্ধু।

তাঁকে নিয়ে যত ভাবি, তত মুগ্ধতা জাগে, নত হই তত শ্রদ্ধায়। প্রশ্নও জাগে ঢের-  লিলিপুটের দেশে তিনি কীভাবে হয়ে উঠলেন অমন অবতার, দার্শনিক অমন, কিংবা অত মহৎপ্রাণ? রবীন্দ্রনাথের ‘রেখেছো বাঙালি করে, মানুষ করোনি’র অভিযোগে অভিযুক্ত দেশের কোলে-পিঠে কীভাবে হলেন অমন দরাজদিল, অত মানবিক, তুলনাহীন মানুষ? 

ফলে একরকম নিশ্চিত করেই বলা যায়, তাঁর মতো হওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব না। তবে তাঁর কিছু গুণ, কিছু বৈশিষ্ট্য, কিছু অভ্যাস তো টুকে নিতেই পারি চরিত্রে আমাদের। পারি চেতনায় তাঁর অনন্য চেতনাকে গেঁথে নিতে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো হয় তাঁর বেড়ে ওঠার সঙ্গী হতে পারলে, প্রত্যক্ষ করতে পারলে তার প্রস্তুতির বহর। ফলের সফলতা তো শেকড়ের জোরেই লেখা, যুদ্ধজয়ের রহস্য যেমন লেখা থাকে প্রস্তুতিতে। বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠবার প্রস্তুতি বা শেকড়কথাও নিশ্চয়ই তেমন ছড়িয়ে আছে বঙ্গবন্ধুর কৈশোর তারুণ্যের কথকতায়, যাপিত জীবনের বাঁকে বাঁকে। যার অনেকখানি নিজেই তিনি অবারিত করে গেছেন আমাদের জন্য। জীবনভর যে জীবনটা লিখে গেলেন তিনি, পড়তে পড়তে যদি আমরা ঢুকে পড়ি তাতে, ব্যক্তি মুজিবকে তাহলে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়।

আটপৌরে দিন যাপনের ভেতর দিয়েই যে তিনি প্রস্তুত হচ্ছিলেন ইতিহাসস্রষ্টা হওয়ার, বোঝা যায় তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে চোখ বুলালে। স্কুলজীবনেই শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। সান্নিধ্য পেয়েছেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশেম ও মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীসহ সে-সময়ের সম্মুখবর্তী মানুষের। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর চিন্তা ও কর্মকাণ্ডের প্রতিও মুগ্ধতা ছিল। অসাম্প্রদায়িক, সংগ্রামী, আধুনিক, গতিশীল এবং পরিশ্রমী এসব যুগস্রষ্টা ব্যক্তিত্বের স্পর্শ স্বভাবতই বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক অন্তর্দৃষ্টিকে নিয়ে গিয়েছিল অন্য উচ্চতায়। সঙ্গে ছিল হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা বাঙালির উদারপন্থী মানবতাবাদী লোকদর্শন। 

ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে রাজনীতির শিখর, সবখানেই তাঁর এই মানবতাবাদী অসাম্প্রদায়িক দর্শনের প্রয়োগ ঘটেছে। যত আন্দোলনে তিনি যোগ দিয়েছেন, দিয়েছেন নেতৃত্ব, তার সবই ছিল তাই শোষিত ও নিপীড়িতের পক্ষে। মুণী ঋষীদের মতোই স্থির প্রতিজ্ঞার জোরে তিনি ধাপে ধাপে তাঁর স্বাধীন দেশের স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে গেছেন। আপোসহীন সংগ্রাম করে গেছেন সমগ্র জাতিকে সে-লক্ষ্যে তৈরি করে নিতে। জেল-জুলুম, অত্যাচার নির্যাতনে পিছপা হননি। ভোলেননি বাবার শেখানো Honesty of Purpose আর  Sincerity of Purpose এর কথা।

The Tortured and the Damned গ্রন্থে লেখক রবার্ট পেইন দেখিয়েছেন, পাকিস্তান কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায়, সকল প্রকার যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হয়েও, বঙ্গবন্ধু কী প্রবলভাবে অটল ছিলেন নিজের আদর্শে। সাজানো বিচারের নামে তাঁকে মেরে ফেলার পাঁয়তারা চলছে বুঝেও তিনি দমে যাননি। তাদের শর্ত মেনে উকিল নিয়োগ দিতে হবে বলে নিয়োগই দেননি কাউকে। নানান ভয়ভীতি হুমকি ধমকির পরও সই করেননি কোনো কাগজে। স্বাধীনতার পর যখন কারাগার থেকে তাকে বিমানবন্দরে নিয়ে যাচ্ছেন জুলফিকার আলী ভুট্টো, বারবার তিনি অনুরোধ করছেন, একটা কোনো ব্যবস্থা মুজিব রাখুন যাতে করে তাদের মানটা অন্তত বাঁচে। কিন্তু না, এক ট্রিগার দূরত্বে বসেও বঙ্গবন্ধু জোরগলায় বলেছেন, জনগণের সঙ্গে কথা না বলে তিনি করবেন না কিছুই। এক পা এগিয়ে দু’পা পিছিয়ে আসা বাঙালিরই একজন হয়েও এত মনোবল তিনি কোথায় পেলেন? শৈশব থেকেই যে স্বাধীনচেতা মানসিকতা তাঁর, প্রিয়তম বাবার মুখোমুখি দাঁড়িয়েও বিরুদ্ধ সত্য বলার অভ্যাস, তা-ই কি তাকে সাহস দিয়ে গেল পরবর্তী প্রতিটা পদক্ষেপে?

সংগঠক হিসেবেও যে তিনি ইতিহাস সেরা তালিকায় থাকবেন, সে-দক্ষতাও তিনি অর্জন করেছেন ছোটবেলা থেকেই। স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেছেন, সাধারণ কর্মী হিসেবে কাজ করেছেন, দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন, বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাল তুলে দরিদ্র ছাত্রদের সহায়তা করেছেন। মিশন স্কুলের ছাত্র থাকা অবস্থায় ফুটবল মাঠেও রেখেছেন সাংগঠনিক দক্ষতার উদাহরণ। ‘স্কুলেও আমি ক্যাপ্টেন ছিলাম। খেলাধুলার দিকে আমার খুব ঝোঁক ছিল।’ এখানেও আমরা তাঁকে দেখি লক্ষ্যে অবিচল থেকে সফলতা অর্জনের চেষ্টা করে যেতে। ‘আমাদের স্কুল টিম খুব ভালো ছিল। মহকুমায় যারা ভালো খেলোয়াড় ছিল, তাদের এনে ভর্তি করতাম, এবং বেতন ফ্রি করে দিতাম।’

ঠিক সময়ে ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারার মতো বিবেচনা ও দৃঢ়তা তাঁর চরিত্রের আর এক উজ্জ্বল দিক। ‘সিভিল ডিজঅবিডিয়েন্স’ নামক রচনায় দার্শনিক হেনরি ডেভিড থরোর বলা ‘অনৈতিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবাধ্যতা’র অনুসরণ করেছেন বঙ্গবন্ধু। অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন, স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন সময় বুঝে, কোনো তাড়াহুড়া নেই, নেই কোনো দোনোমনা। গোপালগঞ্জে রাজনৈতিক কনফারেন্স আয়োজন, ঊনপঞ্চাশে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন, তারপর সেখান থেকে ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ দেওয়া, আমার বিবেচনায় আমাদের স্বাধীনতার পথে সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ- ছয়দফা দাবি প্রস্তুত ও উত্থাপন, সত্তরের নির্বাচন ও তারপর স্বাধীনতার ঘোষণা- প্রতিটা ক্ষেত্রেই অসম দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন।

বঙ্গবন্ধুর অনবদ্য সব ভাষণ টিকে আছে, চাইলেই শোনা যায়। শুনতে গেলেই বুঝি, যা তিনি ভাবছেন, উপলব্ধি করছেন, সরল ভাষায় তা-ই বলছেন। কোনো মেকি ভাব নেই, নেই কোনো আড়াল। আর বক্তৃতা যখন এমন হয়, মনে হয় হৃদয়টাকে সামনে এনে ফেলছেন বক্তা, যেন মরতে হলে তিনিও মরবেন সঙ্গে, বিশ্বাস তখন তাঁকে করতেই হয়। এও তো একটা কারণ যে, তাঁর কথামতো মরণপণ করেছে বাঙালি, বিলিয়ে দিয়েছে প্রাণের পর প্রাণ। 

‘কারাগারের রোজনামচা’য় দেখি, নিজের দুঃখ দুর্দশার কথা বলার চেয়ে তাঁর কাছে বড় হয়ে উঠেছে সঙ্গী সাথীদের অবস্থার বর্ণনা। একটা যে হলুদ পাখি বেড়াতে আসত তাঁর কাছে, তার কথাও লিখেছেন গভীর মমতায়। প্রিয় দূর্বাঘাসের বাগানে বাদলা ঘাসের আক্রমণ হয়েছে, সঙ্গী সাথী নিয়ে তাদের উচ্ছেদ করছেন নিবিড় উৎসাহে। এই প্রকৃতিপ্রেম ও সংবেদনশীলতাও তো মহামানবেরই বৈশিষ্ট্য।

ব্যবস্থাপনায় আমরা যে কন্টিনিউয়াস কন্ট্রোল এর কথা পড়ি, তার সফল উদাহরণও বঙ্গবন্ধুর জীবন। নিজের কাজের মূল্যায়ন করেছেন প্রতিনিয়ত, ভুল ধরা পড়লে শুধরে নিয়েছেন। আবার শুরু করেছেন নতুন উদ্যোমে। রাজনীতিতে তাঁর হাতেখড়ি স্বদেশি আন্দোলনের সময়ে। ছিলেন পাকিস্তান আন্দোলনে। কিন্তু দেশভাগের পরই যখন দেখেছেন তাতেও গলদ থেকে গেছে, ভুলটা বুঝতে এবং স্বীকার করতে সময় নেননি; সময় নেননি ঘুরে দাঁড়াতে। আর সে কারণেই দীর্ঘ চব্বিশ বছরের আন্দোলন সংগ্রামের ভেতর দিয়ে তিনি উদ্ভাসিত হয়েছেন বিজয়ের সূর্য হিসেবে। 

সবাই জানেন, সীমাহীন প্রতিকুলতার বিরুদ্ধে দেশ পরিচালনা করেছেন বঙ্গবন্ধু। তখনকার ভুলত্রুটিগুলো নিয়েও ভেবেছেন। বুঝেছেন, ‘ঘুণে ধরা ইংরেজ আমলের, পাকিস্তানি আমলের শাসনব্যবস্থা’য় দেশ চালাতে গিয়েই যত সমস্যা। আর তা শুধরে নেওয়ার জন্যই ডাক দিয়েছেন দ্বিতীয় বিপ্লবের, চালু করেছেন বাকশাল, যা ছিল তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলবারই আরেকটি পদক্ষেপ। এর বিরুদ্ধে করা মনগড়া সীমাহীন অপপ্রচারে কান না দিয়ে একটু পড়াশোনা করলেই আমরা বুঝতে পারি, বাকশাল ছিল দূরদর্শী ও মঙ্গলময় পরিকল্পনা। তা বাস্তবায়নের সময় যদি বঙ্গবন্ধু পেতেন, সফলতার নজির হিসেবে মাহাথির মোহাম্মদের মালেশিয়ার চেয়ে বহু আগেই হয়তো বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের কথাই জানত বিশ্ববাসী। 

তা হয়নি, হয়নি আমাদের সীমাহীন কৃতঘ্নতা আর নিচুতার জন্যই। যে বাঙালির মুক্তিচিন্তায় নিজের বন্দ্বিত্বকেও বারবার মেনে নিয়েছেন বঙ্গবন্ধু, যে বাঙালির ভালোবাসাকে ভেবেছেন সবচেয়ে বড় শক্তি, যে বাঙালিকে বিশ্বাস করেছেন সবচেয়ে বেশি, সেই বাঙালিরই কিছু কুলাঙ্গারের হাত ধরেই পৃথিবীর সকল আঁধার আর নৃশংসতা জড়ো করে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে হামলে পড়েছিল পঁচাত্তরের পনেরো আগস্ট। তাঁর মহত্ব আর দূরদর্শিতা সহ্য হয়নি যাদের, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের শত্রু যারা, সেসব অমানুষের ষড়যন্ত্র ও সম্পৃক্ততাই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করল সপরিবার। হত্যা কি করতে পারল আসলে? তিনি তো মহামানব, শেষ সময়েও তাই বঙ্গবন্ধুকে দেখি অটল নির্ভীক। নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চলছে জেনেও সদর্পে এগিয়ে এলেন, সিঁড়ি দিয়ে নামছেন, অস্ত্রধারী কালো আর খাকি পোশাকধারীদের চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই তোরা কী চাস? আমাকে কোথায় যেতে হবে?’ আহা, মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও এমন সাহস, এমন দৃঢ়তা! মনে পড়ে তাঁরই বলা কথা: ‘বাঙালি একবার মরে বারবার মরে না।’ আর যারা তাঁর মতো মানুষ, যারা একবারই মরে, তারা তো মরেই না কখনো। বঙ্গবন্ধু তাই বেঁচে আছেন আমাদের বুকে-চোখে-চেতনায়, থাকবেন আজীবন।

যতবার চোখ ফেলি তাঁর জীবনে, যতবার শুনি তাঁর অকৃত্রিম কণ্ঠস্বর, বিস্ময় জাগে: আমাদের মতো ভেতো বাঙালিরই নেতা ছিলেন তিনি! সুকোমল সংবেদনশীলতা, কঠোর পরিশ্রম ও ত্যাগ স্বীকার, খেলার মাঠ থেকে শুরু করে রাজনীতির মাঠ প্রতিটা জায়গা থেকে পাওয়া শিক্ষা জীবনযুদ্ধে কাজে লাগানোর ক্ষমতা, নিবিড় অধ্যবসায় নিয়ে চরম প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও লক্ষ্যে অবিচল থাকা, ভুল হলে তা স্বীকার করা ও শুধরে নেওয়ার প্রজ্ঞা, আর সকল পরিস্থিতিতেই পঠন-পাঠন চালিয়ে যাওয়া মননের সম্মিলন ঘটেছিল চরিত্রে তাঁর- এগুলোই কি তাঁকে আলাদা করে দেয়নি গড়পড়তা অন্য বাঙালির থেকে? অনন্য এই বৈশিষ্ট্যগুলোর চর্চা যদি আমরাও করতে পারি, নিতান্তই সাধারণ হওয়া সত্ত্বেও, আমাদের চেহারা কি একটু হলেও বঙ্গবন্ধুর মতো হয়ে উঠবে না একসময়? আমরা কি তখন পারব না তাঁরই স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে নিতে?

লেখক: কথাসাহিত্যিক