মতামত

গোতাবায়া ফিরেছেন, শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ফিরবে কবে? 

শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধপরবর্তী ইতিহাসে রাজাপাকসে পরিবারের প্রভাবশালী ভূমিকা রয়েছে। আবার শ্রীলঙ্কার উত্থান ও পতনের ইতিহাসেও এই পরিবারের ভূমিকা রয়েছে। 

শ্রীলঙ্কায় গৃহযুদ্ধের অবসানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০০৫ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন গোতাবায়া রাজাপাকসের ভাই মাহিন্দা রাজাপাকসে। নানামুখী পদক্ষেপে শ্রীলঙ্কা বেশ ভালোভাবেই অগ্রসর হতে থাকে। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর মাহিন্দা গোতাবায়াকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। সেই শুরু। তারপর রাজাপাকসে পরিবারের হাতে শ্রীলঙ্কার শুধু উত্থানের ইতিহাস। দেশটির অর্থনীতির চাকাও ঘুরতে থাকে। পর্যটনকে কেন্দ্র করে শ্রীলঙ্কা এগিয়ে যেতে থাকে। 

এরপর গত কয়েক বছরে করোনা মহামারি শুরু হলে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। এর পরেই দেশটি বড় ধরনের ধাক্কা খায়। ব্যাপক অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য নেওয়া বিপুল পরিমাণ ঋণ এবং অর্থনীতির অচলাবস্থা মিলে শ্রীলঙ্কা বিপর্যস্ত হয়ে পরে। অভিযোগের তীর ক্ষমতাসীন রাজপাকসে পরিবারের দিকে। বর্তমান পরিস্থিতির পেছনে উল্লেখিত পরিবারের দিকে আঙুল তুলেছেন দেশটির জনগণ। ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে দেশটি দেউলিয়াত্বের কাতারে চলে যায়। দেশটির এমন সংকটে গণআন্দোলনের মুখে গোতাবায়া দেশ ছাড়েন একপ্রকার লোকচক্ষুর অন্তরালে। তারপর মালদ্বীপ-সিঙ্গাপুর-থাইল্যান্ড ঘুরে ৫০ দিন পর তিনি দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। বলাবাহুল্য তিনি স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেছেন আড়ম্বরপূর্ণ পরিবেশেই। তাকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়েছে। তিনি সরকারি বাড়ি, নিরাপত্তা প্রভৃতি পাবেন বলেও গণমাধ্যমে জানা গেছে। প্রশ্ন হলো গোতাবায়া তো ফিরেছেন কিন্তু শ্রীলঙ্কা কি আগের অবস্থায় ফিরবে? ফিরলেও কতদিনে? 

শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক কাঠামো শক্তিশালী করাই এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ। রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখন মোটামুটি শান্ত। ঋণের বোঝা মাথার ওপর রয়েছে, মুদ্রাস্ফীতি তীব্র, রিজার্ভ কম ইত্যাদি নানা সমস্যায় জর্জরিত দেশটি। এই মুহূর্তে পরিস্থিতি ফেরাতে তাদের প্রয়োজন অর্থ। অর্থনীতির ভীত শক্তিশালী না হলে দেশের পরিস্থিতি কেমন হতে পারে তার বড় উদাহরণ সাম্প্রতিক সময়ের শ্রীলঙ্কা। 

গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, জুন মাসে দেশটিতে মুদ্রাস্ফীতির হার পৌঁছেছে ৫৪.৬ শতাংশ। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, জুন মাসে দেশটিতে খাদ্য মূল্যস্ফীতি পৌঁছেছে ৮০.১ শতাংশ, পরিবহণ খরচ বেড়েছে ১২৮ শতাংশ। ইউনিসেফ এক বিবৃতিতে বলেছে, খাদ্যের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে ৭০ শতাংশ পরিবার এখন খাদ্য কমিয়েছে। চলতি বছর যখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয় তখন বিশ্বজুড়ে নানামুখী সংকট ঘনীভূত হতে থাকে। বিশ্ব ক্রমেই মুদ্রাস্ফীতির কবলে পরে এবং খাদ্য, জ্বালানি সরবরাহ প্রভৃতি কারণে জীবনযাত্রার মান কমতে থাকে। এর মধ্যে যে দেশটি সবচেয়ে খারাপ অবস্থা পার করছে সেটি শ্রীলঙ্কা। 

গত কয়েকমাস ধরেই দেশটি সংকটপূর্ণ পরিস্থিতি পার করছে। এই পরিস্থিতিতে সেদেশের জনগণ রয়েছে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে। মৌলিক চাহিদার সব কিছুর অপর্যাপ্ততা দেশের জনগণের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। ব্যবহার কমিয়েও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাদের প্রধান সমস্যা প্রতিদিনের ক্ষুধাসহ অন্যান্য অতি প্রয়োজনীয় দ্রব্য কেনার সামর্থ্য না থাকা। পরিবারের খাদ্যের নিশ্চয়তা না থাকা, চিকিৎসা সরঞ্জাম সংকট, পরিবহণে জ্বালানি না থাকাসহ মৌলিক চাহিদাগুলো মারাত্মকভাবে ব্যাহত হওয়ায় সেখানে জনগণের দিন-রাত কাটছে অনিশ্চয়তার মধ্যে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে তলানিতে ঠেকেছে। 

শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি সামনের কয়েক সপ্তাহে আরও অবনতি হতে পারে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের পরিচালক জন আইলিয়েফ। এই পরিস্থিতি থেকে শ্রীলঙ্কাকে বের করে আনতে পারে বিপুল পরিমাণ অর্থনৈতিক সাপোর্ট যা শুরু থেকেই দেশটি বিভিন্ন উৎস থেকে পাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। সংকটের শুরুতেই তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে তাদের অন্যতম মিত্র ভারত। অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে ভারত শ্রীলঙ্কাকে ৩৮০ কোটি মার্কিন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। মাত্র কয়েকদিন আগেই শ্রীলঙ্কাকে ২৯০ কোটি মার্কিন ডলার সহায়তার প্রাথমিক এক চুক্তিতে পৌঁছেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। এক্সটেন্ডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটি (ইএফএফ) এর অধীনে আগামী চার বছরে এই অর্থ শ্রীলঙ্কাকে দেওয়া হবে বলে বৈশ্বিক ঋণদাতা সংস্থাটি ঘোষণা দিয়েছে। 

শ্রীলঙ্কার সমস্যার শুরু হয়েছিল অর্থনৈতিক সংকট থেকে। তারপর এটি রাজনীতিতে ছড়িয়ে পড়ে। সেই অর্থনীতি যদি সুসংহত হতে থাকে তাহলে দেশটি যে ক্রমেই ঘুরে দাঁড়াবে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। তাছাড়া রাজনৈতিক পরিস্থিতিও আগের চেয়ে ভালো। দেশটি এই আর্থিক পরিস্থিতি সামাল দিতে আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সহায়তা চেয়েছে। এর মধ্যে ২৯০ কোটি ডলার দিতে সম্মত হয়েছে সংস্থাটি। এ ছাড়া আরও একটি সুসংবাদ রয়েছে শ্রীলঙ্কার জন্য। এটি হলো চীনের ঋণের বিষয়টি। 

গণমাধ্যমের সংবাদে জানা যায়, চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জাও লিজিয়ান গত শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে শ্রীলঙ্কার ঋণ মওকুফের ইঙ্গিত দিয়েছেন। যদি তাই হয়, তাহলে দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা ফিরতে হয়তো বেশি সময় লাগবে না। তাছাড়া শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির একটি বড় উৎস পর্যটন খাত। করোনার সময় বিশ্বজুড়েই পর্যটনশিল্প ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। সম্প্রতি শ্রীলঙ্কা তাদের পর্যটনখাত প্রসারিত করতে পদক্ষেপ নিয়েছে। দেশটি মাল্টিপল এন্ট্রি ট্যুরিস্ট ভিসা ৫ বছর পর্যন্ত বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর ফলে একজন পর্যটক ৬ মাস শ্রীলঙ্কা থাকতে পারবেন। ফলে দেশটি আশা করছে ২০২২ সালে এক মিলিয়ন পর্যটকের আগমন দেখতে পাবে শ্রীলঙ্কা। অর্থাৎ এ বছর পর্যটন থেকে তারা দুই বিলিয়ন ডলার আশা করছে। 

এমন পরিস্থিতিতে গোতাবায়া দেশে ফিরে এসেছেন। নিশ্চয়ই সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা নিয়েই তিনি ফিরেছেন। ভবিতব্য সঠিক বলা না গেলেও এটা অন্তত আন্দাজ করা যাচ্ছে সুসময় সন্নিকটে বুঝেই গোতাবায়া রাজাপাকসে দেশে ফিরেছেন। সেই সবুজ সংকেত তিনি পেয়েছেন। নইলে পালিয়ে দেশ ত্যাগের পর সহসা তিনি ফিরতেন না। দেশটির অর্থনীতি হয়তো পরিস্থিতি সামলে উঠতে যাচ্ছে- তার আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও মুক্তগদ্য লেখক