মতামত

মেট্রোরেলের ভাড়া কমিয়ে বাস মালিকদের নৈরাজ্য নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব

রাজধানীর যানজট নিরসনে সবচেয়ে আশার প্রকল্প মেট্রোরেল চালুর ঠিক আগে নির্ধারিত ভাড়া নগরবাসীকে অনেকটা আশাহত করেছে। এ নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা চলছে সমানতালে। দেশ মেট্রোযুগে প্রবেশের আগে, ভাড়া নিয়ে যাত্রীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে অসন্তুষ্টি। দ্রব্যমূল্য ঊর্ধগতির এই বাজারে অনেকেই ভাড়ার বিষয়টিকে ‘জুলুম’ হিসেবেও দেখছেন।  

সাধারণ রেলের সঙ্গে মেট্রোরেলকে মেলানো হচ্ছে বলেই ভাড়া নিয়ে কথা বেশি হচ্ছে। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠেছে সরকার যদি রেলে ভর্তুকি দিয়ে পরিচালনা করতে পারে, তবে মেট্রোতে কেন নয়? তাছাড়া মেট্রো পরিচালনায় প্রতিদিন ব্যয়ের বিপরীতে যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় কত হবে? সব মিলিয়ে মাস শেষে কত টাকা ভর্তুকি দিয়ে এই সার্ভিস পরিচালনা করতে হবে? বিষয়গুলো অনেক সাধারণ নাগরিক জানেন না বা বিষয়গুলো নিয়ে খোলামেলা কথা হয়নি। এ পরিস্থিতিতে কথা হলো- সরকার এই সেবা খাতে ভর্তুকি দিতে পারে কি পারে না? অবশ্যই পারে। তাহলে এ নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হতে পারে। কারণ মেট্রোরেলে যে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে শেষ পর্যন্ত বহাল থাকলে যাত্রীরা এই সেবা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে সরকারকেই আরো বেশি ক্ষতি স্বীকার করতে হবে।   

আগামী ডিসেম্বরে উত্তরা-মতিঝিল রুটে চালু হতে যাওয়া মেট্রোরেলের ভাড়া সর্বনিম্ন ২০ টাকা ও সর্বোচ্চ ১০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই বিবেচনায় প্রতি কিলোমিটারে বাসের ভাড়া কত?  নির্ধারিত বাস ভাড়া কিলোমিটারপ্রতি ২ টাকা ৪৫ পয়সা। সেখানে মেট্রোরেলের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে কিলোমিটারপ্রতি ৫ টাকা। আবার বাসের সর্বনিম্ন ভাড়া ৮ ও ১০ টাকা হলেও মেট্রোর সর্বনিম্ন ভাড়া ২০ টাকা। বাসে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২১ দশমিক ৬ কিলোমিটারে যেখানে ভাড়া ৫৩ টাকা, সেখানে মেট্রোরেলে দিয়াবাড়ী থেকে মতিঝিলের ভাড়া ১০০ টাকা। তবে এসি বাসে এই দূরত্বে ভাড়া শত টাকার বেশি! 

তাছাড়া অটোরিকশায় যাত্রীদের জন্য প্রথম ২ কিলোমিটারের ভাড়া ৪০ টাকা, পরে প্রতি কিলোমিটার ১২ টাকা এবং বিরতিকালে চার্জ প্রতি মিনিটে ২ টাকা নির্ধারণ করা হয়। যদিও অটোরিকশাগুলো এই শহরে সরকার নির্ধারিত ভাড়ায় চলে এমন নজির নেই। এদিক বিবেচনায় মেট্রোরেলের ভাড়া অটোরিকশার চেয়ে কম। গণপরিবহন হিসেবে ট্যাক্সিক্যাব কাগজে কলমে থাকলেও ট্যাক্সির চেয়ে ভাড়া কম মেট্রোরেলে। ২০ টাকার কমে রিকশায় ওঠার সুযোগ নেই। তাই রিকশার চেয়ে মেট্রোর ভাড়াও কম।  বিশ্বের অধিকাংশ দেশে সড়ক পরিবহনের চেয়ে মেট্রোরেলের ভাড়া অপেক্ষাকৃত কম হয়। শহরের নাগরিক হিসেবে মেট্রোর ভাড়া কম হবে এটা আশাকরা অমূলক কিছু নয়। মূলত যাত্রী আকর্ষণের জন্যই এ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। 

ভারত থেকে শুরু করে থাইল্যান্ড, চীন, হংকং, জাপান, ইংল্যান্ডে মেট্রো খুবই জনপ্রিয় দ্রুততা ও স্বল্প ব্যয়ের কারণে। কলকাতায় ইস্টওয়েস্ট মেট্রোরেলের ভাড়া প্রথম দুই কিলোমিটার ৫ রুপি ও পরবর্তী তিন কিলোমিটার ১০ রুপি। এর পরের পাঁচ (৬-১০) কিলোমিটার ভাড়া ২০ রুপি ও বাকি সাড়ে ছয় (১১-১৬.৫) কিলোমিটার ৩০ রুপি। অর্থাৎ সাড়ে ১৬ কিলোমিটার মেট্রোরেলে ভ্রমণ করলে ভাড়া দিতে হবে ৬৫ রুপি বা প্রায় ৭৫ টাকা। এতে প্রতি কিলোমিটার গড় ভাড়া পড়ে ৪ টাকা ৫৫ পয়সা। এই হিসাবে ঢাকার মেট্রোরেলের ভাড়া বেশি। 

হায়দরাবাদ মেট্রোরেলের প্রথম দুই কিলোমিটার ভাড়া ১০ রুপি ও পরবর্তী দুই কিলোমিটার ৫ রুপি। পুরো মেট্রোরেল রুটটি ২৬ কিলোমিটার। এ রুটে ভাড়া ৬০ রুপি বা ৭০ টাকা। এতে কিলোমিটারপ্রতি গড়ে ভাড়া ২ টাকা ৬৯ পয়সা। 

ঢাকায় সর্বনিম্ন যে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে সেই ২০ টাকা দিয়ে সর্বোচ্চ দুই স্টেশন পর্যন্ত যাতায়াত করা যাবে। এক স্টেশন পর নেমে গেলেও যাত্রীকে ২০ টাকা ভাড়া দিতে হবে। যেখানে বাস-মিনিবাসে সর্বনিম্ন ভাড়া ৮ থেকে ১০ টাকা। যারা এখন সর্বনিম্ন এই ভাড়া দিয়ে ২ থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে নেমে যাবেন, তাদের জন্য মেট্রোরেলের ভাড়া কিছুটা বেশি মনে হওয়া স্বাভাবিক। 

এটা ঠিক যে, নির্ভরযোগ্য ও ব্যয়সাশ্রয়ী হওয়ায় সারা বিশ্বেই মেট্রোরেলকে গণপরিবহনের মেরুদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা হয়। স্বল্প সময়ে ও স্বল্প ব্যয়ে সর্বোচ্চসংখ্যক যাত্রী পরিবহনের কারণে দ্রুত এটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। মূলত সড়কের ওপর চাপ কমাতে মেট্রোরেল নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। যার ধারাবাহিকতায় গত বছরই ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) মেট্রোরেলের জন্য কিলোমিটারপ্রতি ভাড়ার প্রস্তাব করেছিল ২ টাকা ৪০ পয়সা। এ বিবেচনায় উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ভাড়া হওয়ার কথা ৪৮ টাকা ২৫ পয়সা, যা বাস ভাড়ার চেয়ে কম। দেশীয় ও বৈশ্বিক পরিবর্তিত নানা প্রেক্ষাপটে ভাড়ার আগের অবস্থান থেকে সরকার সরে এসে নতুন ভাড়া দ্বিগুণ করেছে।  

মেট্রোরেলের ভাড়া নির্ধারণে দুটি বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে বলে কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে বলা হচ্ছে। প্রথমত, জনগণের সামর্থ্য বা সক্ষমতা। দ্বিতীয়ত, মেট্রোরেল পরিচালনার জন্য যে ব্যয় হবে সেটি তুলে আনা ও আশপাশের দেশের মেট্রোরেলের ভাড়া বিচার-বিশ্লেষণ। কিন্তু পাশের দেশে তো মেট্রোর ভাড়া কম।   

রাজধানীতে মেট্রোরেল নির্মাণ, পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। মেট্রো ট্রেন পরিচালনা করতে প্রতিদিন ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত খরচের কথা বলা হচ্ছে কোম্পানির পক্ষ থেকে। আর প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০২২ সালে প্রতিদিন ৩ লাখ ৯৬ হাজার যাত্রী চলাচল করবে এ মেট্রোতে। এ ক্ষেত্রে সব যাত্রীর কাছ থেকে সর্বোচ্চ ভাড়া আদায় হলেও প্রতিদিন আয় হবে প্রায় ৪ কোটি টাকা। কিন্তু সব যাত্রী তো শুরু থেকে শেষ গন্তব্য পর্যন্ত যাতায়াত করবেন না। এক্ষেত্রে ভাড়া আদায়ের পরিমাণ কমবে। ফলে নিয়মিত যাত্রী পরিবহনের মাধ্যমে পরিচালন খরচ উঠে না আসায় প্রতিদিন সরকারকে কোটি টাকার বেশি ভর্তুকি দিতে হবে! গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি কোনোভাবেই এড়িয়ে গেলে চলবে না। 

তবে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় বলা হয়েছে, উত্তরা-মতিঝিল মেট্রোরেলে প্রতি বছর যাত্রী সংখ্যা বেড়ে ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিদিন যাতায়াত দাঁড়াবে ৫ লাখ ৮৮ হাজারে। এই সময়ে আরো পাঁচটি মেট্রো রেল নির্মাণের লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছে সরকার। প্রায় সবপথে যদি মেট্রোর ব্যবস্থা থাকে তাহলে যাত্রী টানবে অনেক বেশি। আস্তে আস্তে লাভের দিকে যাবে পুরো প্রকল্প। 

রাজধানীর বাস্তবতায় মেট্রোকে বেসরকারি বাস মালিকদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হবে। মেট্রোর ভাড়া নির্ধারণে কৌশলী হওয়া গেলে বাসের ভাড়াও যৌক্তিক পর্যায়ে নেমে আসবে। যেমনটি ঘটেছে পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় লঞ্চের ভাড়া এক ধাক্কায় কমে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে কম আদায় করা হচ্ছে। আইন প্রয়োগ করে এটি সম্ভব হয়নি, সম্ভব হয়েছে পদ্মা সেতু চালুর মধ্য দিয়ে।

তেমনি মেট্রো চালুর মধ্য দিয়ে ঢাকা শহরে বাস ভাড়া যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনা এবং বাস মালিকদের নৈরাজ্যও কমিয়ে আনা সম্ভব। কিন্তু সে জন্য প্রয়োজন কৌশলে মেট্রোর ভাড়া কমানো। সুযোগ-সুবিধা বিবেচনায় মেট্রোর ভাড়া অবশ্যই বাসের চেয়ে কিছুটা বেশি হবে এটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু যা ধরা হয়েছে, তা বেশি। মনে রাখা প্রয়োজন শুধু ভাড়া দিয়ে মেট্রোরেল লাভজনক করা যায় না। স্টেশনে কমার্শিয়াল স্পেস। টিওডি বা ট্রান্সপোর্ট অব ইন্টার ডেভেলপমেন্ট। তার সঙ্গে স্টেশন প্লাজা। এই তিনটি বিষয় যদি করা যায় তাহলে যে ঘাটতি থাকবে, সেখান থেকে মেটানো যাবে। এভাবেই বিশ্বে অধিকাংশ মেট্রো লাভজনকভাবে চলছে। সঙ্গে রেল চালুর পর যদি প্রতি ট্রেনে অন্তত দুটি কোচ বাড়ানো যায় সেক্ষেত্রে আয় বাড়বে। 

দেশে ট্যাক্সিক্যাব ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা জনবান্ধব করা হয়নি। তাই বিবেচনায় নিতে হবে মেট্রোকে জনবান্ধব পরিবহনে পরিণত করতে হলে কী ধরনের ভাড়া কার্যকর করা উচিত। এক্ষেত্রে আশপাশের দেশগুলোর মেট্রোরেলের ভাড়া পর্যালোচনার পাশাপাশি মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বিষয়টি আন্তরিকভাবে ভাবতে হবে।   এরই মধ্যে বিআইডব্লিউটিএর চক্রাকার নৌযান এবং শুল্ক প্রত্যাহার করে নামানো ট্যাক্সিক্যাবও দেখেছি। তবে হুলুদ টেক্সির ভাড়া বিআরটিএ নির্ধারণ করার পর এ নিয়ে সমালোচনা শুরু হলে উদ্বোধনের দিন প্রধানমন্ত্রী যাত্রীদের কথা বিবেচনায় নিয়ে তা কমিয়েছিলেন। সদরঘাট থেকে আমিনবাজার পর্যন্ত চালু করা ওয়াটার ট্যাক্সিও ইতিহাসের পাতায় নাম লিখিয়েছে। আশাকরি মেট্রোর ভাড়া কমানোর বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী ইতিবাচক ভূমিকা রাখবেন। মনে রাখা উচিত যাত্রীর সামর্থ্যের বাইরে চলে গেলে তা জনমানুষের বাহনে পরিণত হয় না। ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে সেটি বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। সবদিক মিলিয়ে সামর্থের মধ্যে স্বাচ্ছন্দে চলায় জনপ্রিয় বাহন হয়ে উঠুক বহুল প্রত্যাশার মেট্রো সার্ভিস। 

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট