মতামত

সাংগঠনিক সংকট কাটাতে প্রয়োজন শুদ্ধি অভিযান

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি আছে প্রায় দেড় বছর। এর আগেই দেশের রাজনৈতিক জল ক্রমশই ঘোলা হয়ে উঠছে। সরকার উৎখাতের ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে। প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এখন ষড়যন্ত্রকারীরা বাসা বেঁধেছে। ঘোলা জলে মাছ শিকারের অভিসন্ধিতে ঘটানো হচ্ছে একের পর এক অঘটন। লক্ষ্য একটাই-সরকারকে বিব্রত করা, বিতর্কিত করা।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা ‘আতঙ্ক রোগে’ ভুগছেন। আড়ালে আবডালে আওয়ামী লীগ নেতারা যেভাবে সরকারের সমালোচনা করছেন, তাতে বিরোধীদলের নেতারাও লজ্জায় মুখ লুকাবেন। রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগ প্রায় বন্ধুহীন বললে ভুল হবে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী শরিকরা আগে ফিসফাঁস করে সরকারের সমালোচনা করতেন, এখন করেন প্রকাশ্যে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী জোট ‘মহাজোট’ কে আনুষ্ঠানিকভাবে মৃত ঘোষণা করা হয়েছে। একটা সময় ছিল, বুদ্ধিজীবীরা আওয়ামী লীগের প্রতি এক ধরনের নৈতিক সমর্থন জানাতেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ, সমতাভিত্তিক একটা সমাজ বিনির্মাণে মুক্তচিন্তার মানুষ আওয়ামী লীগের ওপরই ভরসা রাখত। কিন্তু এখন বুদ্ধিজীবীরাই আওয়ামী লীগের কঠিন সমালোচক। যাদের নিজস্ব এজেন্ডা রয়েছে। বিভিন্ন পদপদবির আশায় এরা প্রকাশ্যে সরকারের তোষামোদ করে। গোপনে এদের হতাশার দীর্ঘশ্বাস রীতিমতো ভূমিকম্প সৃষ্টি করে। রূঢ় বাস্তবতা সামনে নিয়ে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মাঠে নামতে আওয়ামী লীগকে সাংগঠনিক দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে এখনি।

আওয়ামী লীগের মধ্যে এখন অনুপ্রবেশকারীর সংখ্য প্রচুর। বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াত থেকে সুবিধাবাদীরা আওয়ামী লীগে নিজেদের জায়গা পাকাপোক্ত করতে উঠেপড়ে লেগেছে। তারা আওয়ামী লীগের নাম পদবি ব্যবহার করে নানা অপকর্মের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করছে। এটা করা হয়েছে কিছু কিছু কেন্দ্রীয় নেতার যোগসাজশে। মূলত ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতির চর্চা থেকেই নিজের সিন্ডিকেট ভারি করার মানসিকতা থেকেই এই দুরাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। যাচাই-বাছাই ছাড়া এ ধরনের অনুপ্রবেশ আওয়ামী লীগের তৃণমূলের মধ্যে ক্ষত সৃষ্টি করেছে, যার মাশুল দিতে হচ্ছে আওয়ামী লীগকে।

তৃণমূলের মধ্যে একটা ধারণা হয়ে গেছে তাদেরকে টাকা বানাতে হবে। টাকা বানাতে না পারলে সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান এমনকি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানও হতে পারবে না। কারণ বিগত সময়ে জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে দেখা গেছে যে, দলীয় ত্যাগী পরীক্ষিত কর্মীদের বাদ দিয়ে টাকা পয়সাওয়ালা ব্যবসায়ী বা বিভিন্ন রকম বিত্তবানদের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। এর ফলে তৃণমূলের তরুণদের মধ্যে অর্থলিপ্সা জাগ্রত হয়েছে।

আওয়ামী লীগ মাঠপর্যায়ের কর্মী নির্ভর একটি দল। তৃণমূলে যদি পচন ধরে তাহলে আওয়ামী লীগ থাকবে না বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এ কারণেই তৃণমূলের পচনরোধে এখনি আওয়ামী লীগের ভেতরে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করা প্রয়োজন বলে মনে করা হচ্ছে। 

ওয়ার্ড থেকে শুরু করে কেন্দ্র পর্যন্ত সব জায়গায় গ্রুপিং দলকে পঙ্গু করে দিচ্ছে। দলের জন্য, দেশের জন্য, মানুষের জন্য কল্যাণমূলক রাজনীতির বদলে প্রতিহিংসামূলক রাজনীতি সংগঠনের জন্য বিষোফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে।  তৃণমূলের আর্তনাদ শোনার কেউ নেই। মন্ত্রীর সাথে প্রশাসনের সম্পর্কের ভাটা, প্রশাসনের সেবা পেতে হলে ঘুষ ছাড়া সম্ভব না, স্থানীয় সংসদ সদস্যের সাথে সংগঠনের মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সম্পর্কের দূরত্ব বাড়ছে, আবার নেতাদের সাথে কর্মীদের ব্যবধান বেড়ে চলেছে ক্রমাগত৷ সর্বত্র প্রশাসনের জয়জয়কার লক্ষ্য করা যায়। টাকার বিনিময়ে বদলি বাণিজ্য হলে সেখানে দলীয় আদর্শের কোনো ছিটেফোঁটাও থাকবে না এটি খুবই স্বাভাবিক। ফলে রাজনৈতিক সমীকরণে আওয়ামী লীগ পিছিয়ে পড়ছে এটি বলা যায়।

অবশ্য বর্তমান সময়ে রাজনীতির চেয়ে অপরাজনীতির চর্চা বেশি লক্ষণীয়। যারা বিরোধীদলে থাকা অবস্থায় দলের জন্য জীবন যৌবন উৎসর্গ করছেন, এখন তারা  মূল্যায়িত হচ্ছে না। দলের সুসময়েও অনেকে নাজুক পরিস্থির ভেতর দিয়ে জীবনযাপন করছে। তবে এ কথাও সত্য রাজনীতিতে প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকাটাই আদর্শবান কর্মীর কাজ। আবার কর্পোরেট থেকে আসা সংসদ সদস্য, মন্ত্রীদের রাজনৈতিক পদচারণা না থাকলেও রাজনৈতিক বাণিজ্য তারা গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। সম্প্রতি দেখা গেছে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের টেন্ডার না পাওয়ায় স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে কাজ করতে বাধা দিয়েছে যা নিশ্চয়ই আমাদের লজ্জিত করে। রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে শুধু টাকার পেছনে ছুটলে আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক মাশুল দিতে হবে।

পরিশেষে বলতে চাই, আওয়ামী লীগ জনগণের জন্য রাজনীতি করে। বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা দীর্ঘদিন প্রধানমন্ত্রী থাকায় আজ বাংলাদেশ বিশ্বের রোল মডেল। মাথাপিছু আয় থেকে শুরু করে জনগণের জীবনমান উন্নয়ন হয়েছে প্রতিটি ক্ষেত্রে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু টানেল ও পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ মেগা প্রকল্প একে একে বাস্তবায়নের শেষ পর্যায়ে যা বাংলাদেশকে অনন্য উচ্চতায় আসীন করবে। সুতরাং এসব অর্জন গুটিকয়েক স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক নেতা, সংসদ সদস্য, মন্ত্রী বা প্রশাসনের লোকজনের কারণে ম্লান হোক এটি আমাদের কাম্য নয়। সুতরাং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অনুরোধ থাকবে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে দলের ভেতরে ও বাইরে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে দুধের মাছিদের হটানো এখন সময়ের দাবি। প্রকৃত ত্যাগীদের মূল্যায়নের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নিশ্চয়ই জনগণের কল্যাণে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে কাজ করে যাবে সে প্রত্যাশাই সবার। 

লেখক: উপ-তথ্য, যোগাযোগ ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ