মতামত

অর্থনীতিতে নোবেল: অর্থনৈতিক মন্দা বিশ্লেষণ ও উত্তরণের কৌশল

অক্টোবরের শুরু মানেই নোবেল পুরস্কারের মৌসুম। মাসের ছয় দিনে বিশ্বের অভিজাত বিজ্ঞানী, লেখক, অর্থনীতিবিদ এবং মানবাধিকার নেতাদের ছয়টি পুরস্কার দেওয়া হয়। আলফ্রেড নোবেলের অভিপ্রায় অনুসারে নোবেল শান্তি পুরস্কার নরওয়েতে এবং অন্যান্য পুরস্কারগুলো সুইডেনে হস্তান্তর করা হয়। গত ১০ অক্টোবর অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। অর্থনীতির নোবেল পুরস্কারের মৌলিকতা এবং এর বিভিন্ন প্রভাবের দিক বিবেচনা করলে অনেক বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। কারণ অনেকে এটিকে ‘কাকের বাসায় কোকিলের ছা’ বলে অভিহিত করেছেন। আবার অর্থনীতিই একমাত্র বিষয় যেখানে একই বিষয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়ে নোবেল পাওয়া যায়; সে নজির রয়েছে।

প্রতিটি পুরস্কারের মূল্য ১০ মিলিয়ন ক্রোনা (প্রায় ৯ লাখ মার্কিন ডলার) ও স্বর্ণপদক যা আগামী ১০ ডিসেম্বর হস্তান্তর করা হবে। রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অফ সায়েন্স প্রায় তিন হাজার অধ্যাপক, পূর্ববর্তী বিজয়ী এবং একাডেমির সদস্যদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তালিকা থেকে বিজয়ী নির্বাচন করে থাকে। তবে কেউ নিজেকে মনোনয়ন দিতে পারেন না।

প্রাক্তন ইউএস ফেডারেল রিজার্ভ-এর চেয়ার বেন বার্নাঙ্ক, ডগলাস ডায়মন্ড ও ফিলিপ ডাইবভিগকে ব্যাংকিং সেক্টরের গুরুত্ব এবং ব্যর্থতা নিয়ে গবেষণার জন্য এবারের অর্থনীতির নোবেল দেওয়া হয়েছে। এ ত্রয়ীর কাজে গ্রেট ডিপ্রেশন (মহামন্দা বলার সুযোগ নেই কারণ, গ্রেট রিসেশনের বাংলা অনুবাদও মহামন্দা; কিন্তু দুটি এক নয়) থেকে যে শিক্ষা নেওয়া হয়েছে তার উপর ভিত্তি করে ব্যাংকিং সেক্টরের গুরুত্ব এবং একইসঙ্গে ২০০৮ সালের গ্লোবাল ফাইনান্সিয়াল ক্রাইসিস মোকাবিলায় ব্যাংক কী ভূমিকা রাখতে পারে সেগুলো প্রকাশ পেয়েছে। রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অফ সায়েন্স প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, আর্থিক বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং আর্থিক সংকট মোকাবিলায় তাদের বিশ্লেষণগুলো অত্যন্ত বাস্তবিক গুরুত্ব বহন করে। তাদের গবেষণাসমূহ আর্থিক সংকটের সময় ব্যাংকগুলোর ভূমিকা সম্পর্কে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ ধারণা দেবে। তাদের গবেষণার অন্যতম একটি বক্তব্য হলো কীভাবে এবং কেন ব্যাংকের পতন এড়ানো আবশ্যক। 

নোবেলজয়ীদের বিশ্লেষণধর্মী কাজের সূচনা ১৯৮০ দশকের গোড়ার দিকে। তাদের ফলগুলো আর্থিক বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং আর্থিক সংকট মোকাবিলায় গুরুত্ব বহন করে। ৬৮ বছর বয়সী বার্নাঙ্ক বর্তমানে ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের ইকোনমিক্স স্টাডিজ এর ফেলো হিসেবে কর্মরত। তিনি স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক থাকাকালীন ১৯৩০-এর দশকের গ্রেট ডিপ্রেশন নিয়ে গবেষণা করে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে আতঙ্কিত লোকেরা যখন তাদের সঞ্চয় তুলে নেয় তখন ব্যাংক পরিচালনা বাধাগ্রস্ত হয়। একইসঙ্গে তিনি ব্যাংকের পতন কীভাবে ব্যাপক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যায় তা দেখিয়েছেন। 

বার্নাঙ্কের প্রস্তাবনার পূর্বে অর্থনীতিবিদগণ ব্যাংকিং সেক্টরের ব্যর্থতাকে অর্থনৈতিক মন্দার ‘ফল’ হিসেবে বিবেচনা করতেন; মন্দার ‘কারণ’ হিসেবে নয়। ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত ‘Non-Monetary Effects of the Financial Crisis in the Propagation of the Great Depression’ গবেষণা পত্রে ১৯৩০ এর দশকের গ্রেট ডিপ্রেশনকে গভীর ও দীর্ঘায়িত করার ক্ষেত্রে ব্যাংকিং সেক্টরের ব্যর্থতাকে তিনি গুরুত্বপূর্ণ বলে অভিহিত করেছেন। 

অন্যদিকে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬৮ বছর বয়সী ডগলাস ডায়মন্ড (শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের বুথ স্কুল অফ বিজনেসের অধ্যাপক) এবং ৬৭ বছর বয়সী ফিপিল ডাইবভিগ (ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক) দেখিয়েছেন ব্যাংকিং সেক্টর কীভাবে একটি অর্থনীতিতে কাজ করে এবং আমানতের উপর সরকারি গ্যারান্টি কীভাবে আর্থিক সংকটের বৃদ্ধি রোধ করতে পারে।

১৯৮০-এর দশকে ডায়মন্ড এবং ডাইবভিগ একটি অর্থনীতিতে ব্যাংকের অনন্য ভূমিকার উপর জোর দেন। ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত ‘Bank Runs, Deposit Insurance, and Liquidity’-তে তারা দেখিয়েছেন যে কীভাবে ব্যাংকগুলো আর্থিক ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ব্যাংক আমানতকারী (depositor) এবং ঋণগ্রহীতার (borrower) মধ্যে সবচেয়ে বিশ্বস্ত মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে। সঞ্চয়কারীর কাছ থেকে আমানত গ্রহণ করে একটি মধ্যস্থতাকারী হিসাবে ঋণগ্রহীতাদের ঋণ প্রদান করে। ব্যাংকগুলো আমানতকারীদের ইচ্ছার উপর ভিত্তি করে তাদের অর্থ উত্তোলনের অনুমতি দেয়। আমানতকারীদের কখন অর্থের প্রয়োজন হবে তা ব্যাংক আগে থেকে জানে না; তবে যেহেতু সব আমানতকারী একই সময়ে আমানত উত্তোলন করে না তাই ব্যাংকিং খাতে সমস্যা তৈরি হয় না। 

মূলত সঞ্চয়কারী ও ঋণগ্রহীতারা সুদের হারের পার্থক্যের  মাধ্যমে ব্যাংক মুনাফা অর্জন করে। স্বাভাবিক সময়ে, এটি সম্পদ তৈরি করার একটি ভালো উপায় এবং সাধারণ পরিস্থিতিতে এটি ভালো কাজ করে। তবে মডেলটি থেকে আরও দেখা যায়, সঞ্চয়কারী ও ঋণগ্রহীতার মধ্যে একটা বিরোধ থাকা স্বাভাবিক। কারণ সঞ্চয়কারী আর্থিক ব্যবস্থায় অধিক তারল্য পছন্দ করেন, পক্ষান্তরে ঋণগ্রহীতারা দীর্ঘমেয়াদে ঋণ পছন্দ করেন। ফলে উভয়ের মধ্যে চাহিদার পার্থক্য হয়ে যায়। এটি ব্যাংক পরিচালনার একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের স্বল্পমেয়াদী তারল্য মেটাতে হাতে নগদ একটি ছোট ভগ্নাংশ রেখে থাকে। কিন্তু, যদি সমস্ত আমানতকারী একই সময়ে তাদের সঞ্চয় তুলে নেওয়ার চেষ্টা করে তখন ব্যাংকগুলো সে চাহিদা মেটাতে পারে না এবং দ্রুত দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়। অর্থনৈতিক সংকটের সময় এরকম ঘটে থাকে। 

ডায়মন্ড আরও যোগ করেছেন, ‘আর্থিক সংকট আরও খারাপ হয় যখন লোকেরা সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার স্থিতিশীলতার উপর বিশ্বাস হারাতে শুরু করে।’ ডায়মন্ড এবং ডাইবভিগের গবেষণা থেকে অনেক বিষয়ের সমাধান খুঁজে পাওয়া যায়। যদি আমরা স্বীকার করি, বেশিরভাগ সঞ্চয়কারী যে কোনো সময় অর্থ উত্তোলন করবে না, তখন ব্যাংক উচ্চতর রিটার্নিং সম্পদগুলোতে এমনকি প্রকল্প বিনিয়োগে তাদের সঞ্চয় কাজে লাগাতে পারে। যদি পূর্বের প্রসঙ্গে ফিরে যাই, সকল আমানতকারী যদি একই সময়ে তার অর্থ ফেরত চায় যেটি মন্দার সময় খুবই স্বাভাবিক তখন আসলে ব্যাংকের বীমা ব্যবস্থাও ভেঙে পড়ে। এ ক্ষেত্রে ডায়মন্ড ‘ভয়কে’ অন্যতম একটি সমস্যা বলে চিহ্নিত করেছেন। এটি সমাধানের উপায় হিসেবে তারা আমানত বীমা এবং তারল্য নিয়ন্ত্রণের উপর জোর দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে সরকার ব্যাংকগুলোকে সঠিকভাবে মনিটর করতে পারে।

প্রায় একই সময়ে, বার্নাঙ্ক গ্রেট ডিপ্রেশনের কারণগুলোর একটি পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন কেন প্রাথমিকভাবে একটি রিসেশন সে সময়ের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অর্থনৈতিক মন্দায় পরিণত হয়েছিল। ১৯৩০-এর গ্রেট ডিপ্রেশন নিয়ে প্রাসঙ্গিক আলোচনা করা প্রয়োজন। ১৯৩০-এর পূর্বে ধ্রুপদী ধারার অর্থনীতিবিদগণ বিশ্বাস করতেন অর্থনীতিতে সবসময় ‘পূর্ণ কর্মসংস্থানভিত্তিক ভারসাম্য’ (full employment level of output) থাকবে। কিন্তু ১৯৩০ এর গ্রেট ডিপ্রেশন অর্থনীতির চিন্তা, আলোচনা ও দর্শনে একটি বড় পরিবর্তন নিয়ে আসে। গ্রেট ডিপ্রেশন ছিল ১৯২৯ হতে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত সংঘটিত বিশ্বব্যাপী প্রসারিত একটি অর্থনৈতিক মন্দা যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সকল সামষ্টিক অর্থনৈতিক চলকের ঋণাত্মক পরিবর্তন নিয়ে আসে। স্টক মূল্যের বড় পতনের পর ১৯২৯ থেকে ১৯৩২ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী জিডিপি কমেছে আনুমানিক ১৫ শতাংশ। ধনী ও দরিদ্র উভয় দেশেই ব্যক্তিগত আয়, মূল্য, কর রাজস্ব, মুনাফা হ্রাসের বিধ্বংসী প্রভাব লক্ষণীয়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ৫০ শতাংশের বেশি কমেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্ব বেড়েছে ২৩ শতাংশ এবং কিছু দেশের জন্য তা ৩৩ শতাংশেরও বেশি। বিশ্বজুড়ে ভারী শিল্পের উৎপাদন মারাত্মকভাবে কমে যাওয়ায় অনেক দেশে নির্মাণ কাজ বন্ধ ছিল। ফসলের দাম প্রায় ৬০ শতাংশ কমে যাওয়ায় কৃষক সম্প্রদায় এবং গ্রামীণ এলাকাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ধ্রুপদী ধারার বিপরীত দর্শনকে প্রাধান্য দিয়ে কেইন্স রাজস্ব নীতিকে ত্রাতা হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং বিশেষ করে ‘সম্প্রসারণমূলক রাজস্ব নীতি’ কৌশল বাস্তবায়ন করে অর্থনীতিকে সে সময় রক্ষা করেছিলেন। সে বাস্তবতায় কেইন্সিয়ান মতাদর্শের উপর ভিত্তি করে নতুন school of thought এর বিকাশ ঘটে। মূলত ১৯৩০ এর গ্রেট ডিপ্রেশনকে কেন্দ্র করেই অর্থনীতির বিভিন্ন আদর্শিক জায়গা সৃষ্টি হয়। ১৯৭০-এর দশকে ধ্রুপদী বিশ্বাসের অনুসারী মুদ্রাবাদীরা কেইন্সিয়ান প্রস্তাবের বিরোধীতা শুরু করেন যার নেতৃত্বে ছিলেন মিল্টন ফ্রিডম্যান। এবাবের নোবেল বিজয়ীরা মূলত ধ্রুপদী ধারায় বিশ্বাসী মুদ্রাবাদী ঘরানার সমর্থক। মজার বিষয় হলো, ১৯৭০-এর দশকে এসে মুদ্রাবাদীরা দাবি করেছেন, গ্রেট ডিপ্রেশনের একটি সমাধান আর্থিক নীতি (monetary policy) প্রয়োগের মাধ্যমে করা সম্ভব ছিল; যদিও আসলে তা বাস্তবায়িত হয়নি কিংবা হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়নি।

বেন বার্নাঙ্ক ১৯৩০-এর দশকের মহামন্দা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে অর্থনৈতিক সংকট গভীর ও দীর্ঘায়িত হওয়ার একটি বড় কারণ ছিল ব্যাংকিং খাতের ব্যর্থতা। সে সময়ে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে প্রচলিত চিন্তাধারার বিপরীতে তিনি বলতে চেয়েছেন, বিপর্যয়ের মূল কারণ হলো বিপুলসংখ্যক মার্কিন ব্যাংক যা ১৯৩০-এর দশকের গোড়ার দিকে ব্যর্থ হয়েছিল। যা কার্যত আমানতকারী এবং ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসাবে কাজ করার অনন্য ক্ষমতাকে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছিল।

২০০৮-এ শুরু হওয়া গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ক্রাইসিসের সঙ্গে নোবেল ত্রয়ীর কাজের দারুণ সংযোগ রয়েছে। বছরের পর বছর ধরে হাউজিং খাতের গড় মূল্য বৃদ্ধি পেতে থাকে যার ফলে বন্ধকী ঋণও অকার্যকর হয় পড়ে এবং পরিস্থিতি দ্রুত ‘হাউজিং বাবল’ এর দিকে নিয়ে যায়। বার্নাঙ্ক যখন ২০০৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন ততদিনে মার্কিন অর্থনীতি নিম্নগামী হতে শুরু করেছে এবং ২০০৮ সালে তা গ্রেট রিসেশনে রূপ নেয়। মন্দা গভীর হওয়ার সাথে সাথে ফেডারেল রিজার্ভের উপর অর্থনীতি পুররুদ্ধারের দায়িত্ব পড়ে যাতে ১৯৩০-এর গ্রেট ডিপ্রেশনের পুনরাবৃত্তি না হয়। ফেড রিজার্ভের চেয়ারম্যান হিসেবে বার্নাঙ্ক কিছু অপ্রথাগত পদক্ষেপ দিয়ে শুরু করেছিলেন। যেমন, ফেড তার তহবিলের সুদের হার এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে ৫.২৫ শতাংশ থেকে শূন্য শতাংশে নামিয়ে আনে। এমনকি এ পদক্ষেপ যখন তারল্য সংকট কাটাতে যথেষ্ট ছিল না, তখন বার্নাঙ্ক ‘quantitative easing’ বা অর্থ সরবরাহে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দ্বারা নতুন অর্থের প্রবর্তন করেন। এ পদক্ষেপের মাধ্যমে ফেড নভেম্বর ২০০৮ এবং জুন ২০১০ এর মধ্যে ১.৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ তৈরি করে। ব্যাংক ও সরকারের কাছ থেকে আর্থিক সম্পদ কেনার জন্য এ অর্থ ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া, তিনি ফেডের ট্রেজারি ক্রয় এবং বন্ধকী বিনিয়োগের নির্দেশনা দেন। ব্যাংকিং খাতের এসব নজিরবিহীন পদক্ষেপ এবং ফলশ্রুতিতে ব্যাংকগুলোর সক্রিয়তা মুদ্রানীতিনির্ভর অর্থনৈতিক দর্শনে নতুন মাত্রা যোগ করে।

সে সময় বার্নাঙ্ক ফেডারেল রিজার্ভ কর্তৃক অর্থনীতিতে হস্তক্ষেপের বিষয়টি নতুনভাবে উপস্থাপন করেন এবং আমেরিকার কিছু বড় ব্যাংকের bailout এর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। যদিও এ পদক্ষেপগুলি রাজনৈতিকভাবে বিতর্কিত ছিল তবুও প্রেসিডেন্ট ওবামা স্বীকার করেছেন যে বার্নাঙ্কের যুগান্তকারী পদক্ষেপের কারণেই কার্যত ২০০৮ সালে আরেকটি গ্রেট ডিপ্রেশন এড়ানো সম্ভব হয়েছিল। তাঁকে ফেডারেল রিজার্ভ চেয়ারম্যান হিসাবে দ্বিতীয় মেয়াদের জন্যও মনোনীত করা হয়। সে সময় রিপাবলিকান সমর্থকগণ বার্নাঙ্কের এ সকল নজিরবিহীন পদক্ষেপের কঠোর সমালোচনা করেন। তাদের হিসাবে আগামীতে ফেডারেল রিজার্ভের এ সকল  অনাকাঙ্ক্ষিত কৌশল ডলারের মূল্যকে নিম্নমুখী করবে এবং পরবর্তী সময়ে মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা বেড়ে যাবে।

কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলায় ফেড এবং অন্যান্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক বার্নাঙ্ক প্রণীত একই কৌশল গ্রহণ করেছে। ২০২০ সালের প্রথম দিকে করোনাভাইরাস যখন মার্কিন অর্থনীতিকে আঘাত করে তখন ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ার জেরোম পাওয়েল দ্রুত স্বল্পমেয়াদি সুদের হার শূন্যে ফিরিয়ে এনে আর্থিক ব্যবস্থায় অর্থ ‘পাম্প’ করেন। ব্যাপক সরকারি ব্যয়ের সঙ্গে ফেডারেল রিজার্ভের সুনিপুণ ও কৌশলী হস্তক্ষেপ মন্দার অবসান ঘটায় এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু হয়। তবে ফলশ্রুতিতে কোভিড-১৯ পরবর্তী ২০২১ সাল থেকে মূল্যস্ফীতি দ্রুত বাড়তে শুরু করে। এ সময়ে বিগত ৪০ বছরের মধ্যে মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ উচ্চতায় পৌঁছেছে। বর্তমানে মূল্যস্ফীতির নেতিবাচক প্রভাবের কারণে বিশ্বজুড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সুদের হার এবং অন্যান্য ব্যাংক হার বাড়ানোর পদক্ষেপ নিচ্ছে। 

নোবেলজয়ী এ তিন অর্থনীতিবিদের গবেষণালব্ধ ফল মূলত পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে নতুনভাবে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে। উপরন্তু, ভবিষ্যতের যে কোনো সংকট মোকাবিলায় মুদ্রানীতিনির্ভর কার্যকর কৌশল গ্রহণ করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করবে। অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলায় কেইন্সের সম্প্রসারণমূলক রাজস্ব নীতির একটি সন্তোষজনক বিকল্প হিসেবে নোবেল ত্রয়ীর এ গবেষণা কতটুকু কার্যকর হবে তার জন্য আরেকটি গ্রেট ডিপ্রেশনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে! তবে এসব নতুন নতুন দর্শন আগামীর পৃথিবীকে নিরাপদ রাখুক- এটাই প্রত্যাশা। 

লেখক: উন্নয়ন অর্থনীতি গবেষক