মতামত

চলচ্চিত্র আবারও হয়ে উঠুক সমাজ বদলের হাতিয়ার

চলচ্চিত্র সমাজ বদলের হাতিয়ার। বিনোদনের পাশাপাশি জীবন ও জগৎ উপলব্ধি করতে শেখায় চলচ্চিত্র। শিল্পকলার অনেকগুলো শাখার একটি শাখা এটি। এই শাখার ডালে ডালে এত সব অভিনব কুসুম ফুটে ওঠে যে, ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। একমাত্র চলচ্চিত্রের পক্ষেই শিল্পকলার প্রায় সবগুলো শাখা আত্মস্থ করা সম্ভব। আলো-ছায়ার ভেতর দিয়ে বিশ্বব্রহ্মান্ডকে অবিকলভাবে প্রকাশ করার শক্তি চলচ্চিত্রের আছে বলেই চলচ্চিত্রকে ‘জীবনের চেয়েও বড়’ (Moving Picture is large than life) বলা হয়।

আমি চলচ্চিত্রের একজন নগণ্য দর্শক। চলচ্চিত্রের নির্মাণ সম্পর্কিত কোনো জ্ঞান আমার নেই বটে, তবে বেশ কয়েকজন বরেণ্য চলচ্চিত্র পরিচালকের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকার কারণে এটুকু বুঝেছি যে, চলচ্চিত্রের রূপালি জগৎ নির্মাণবিদ্যা মোটেই সহজ নয়। সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ‘মানিক দা’ বইটি যারা পড়েছেন, তারা নিশ্চয়ই মনে করতে পারবেন, সে সময়ে একেকটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে সত্যজিৎ রায় কী অসামান্য মেধা ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন। শুধু টাকা থাকলেই চলচ্চিত্র তৈরি করা যায় না। এ জন্য প্রয়োজন হয় একজন মহৎ মনের পরিচালক, দক্ষ অভিনেতা-অভিনেত্রী, যোগ্য টেকনিশিয়ান ও সংবেদনশীল কথাশিল্পী (কাহিনীকার)। এতগুলো করিৎকর্মা মানুষের সফল প্রচেষ্টারই নাম চলচ্চিত্র। 

রূপালি পর্দার সামনে যতজন অভিনয় করেন, রূপালি পর্দার নেপথ্যেও ঠিক ততজন মানুষই শ্রম ঢেলে যান। যে জীবন, যে পরিবেশ, যে সমাজব্যবস্থা আমরা প্রতিদিন দেখি, সেটাই যখন চলচ্চিত্রের বুকে প্রস্ফুটিত হয় জোছনাস্নাত শতদলের মতো তখন আমরা আশ্চর্য হই, বেদনায় কাঁদি, বিদ্রোহে প্রতিবাদী হয়ে উঠি। একেকটি চলচ্চিত্র একেকটি শিক্ষালয়। একেকটি চলচ্চিত্র একেকটি বিশাল গ্রন্থাগার। সমাজের কাছে চলচ্চিত্রের দায় আছে। এই দায় কেউ এই শিল্প মাধ্যমটির উপর চাপিয়ে দেয়নি। এই অভিনব শিল্পমাধ্যমটি নিজের কাঁধে নিজেই এ দায় তুলে নিয়েছে। 

আমাদের পূর্ণ যৌবনে অর্থাৎ স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে যেসব চলচ্চিত্র দেখেছি, সেগুলোর নিরিখে যদি আজকের বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের একটি তুলনামূলক সমালোচনা করি, তাহলে কে কী বলবেন জানি না, আমি খুবই মর্মাহত হই। ভয়ে কুঁকড়ে যাই আজগুবি সব মারপিট ও রক্তারক্তি দেখে। দশ-বিশজন গুন্ডা একজন নায়কের হাতে মার খেয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। নায়ক রক্তাক্ত চেহারা নিয়েই আবার নায়িকার সঙ্গে নাচ-গান করছে। বিজ্ঞান প্রযুক্তির কল্যাণে পৌরাণিক কাহিনীর কাল্পনিক অতিরঞ্জন না হয় মেনেই নিলাম, কিন্তু দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দুঃখ, প্রেম-ভালোবাসা-দ্রোহ প্রকাশের ক্ষেত্রে যেসব অদ্ভুত ও বিকৃত পন্থা অবলম্বন করা হয়, তা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য মোটেই উপকারী নয়। অশ্লীলতার কারণে নব্বই দশকের পরেই বাংলাদেশের চলচ্চিত্র দর্শক হারাতে থাকে। সেই ধারা এখনো অব্যাহত আছে।

সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, গৌতম ঘোষের মতো চলচ্চিত্রকারগণ বাংলা চলচ্চিত্রের অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্ব। এদের পরে বাংলাদেশের যে কজন চলচ্চিত্রকারের নাম বলা যেতে পারে, সে নামগুলো হবে এমন- খান আতাউর রহমান, সুভাষ দত্ত, জহির রায়হান, আলমগীর কবির, কাজী জহির অথবা আরো কেউ কেউ। বেশ কিছু বছর ধরেই বাংলাদেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনে অস্থিরতা বিরাজ করছে। চলচ্চিত্র অঙ্গনের শিল্পী সমিতির নির্বাচন সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত পৌঁছেছে শুনে হতবাক হয়েছিলাম। দেশের শিল্পীসমাজ যদি শিল্পসম্মতভাবে সমস্যার সমাধান না করতে পারেন, তাহলে এ জাতির ভবিষ্যৎ কী? সমাজে পচন থাকবে, দুর্নীতি, লুটপাট, ক্ষমতা প্রদর্শন থাকবে, শিল্পীরা হবেন এসব কিছুর সার্থক রূপকার। শিল্পাঙ্গনের শিল্পীরা যদি ক্ষমতার লোভ আর কালো টাকার হাতছানি উপেক্ষা করতে না পারেন, তাহলে তাদের করা চলচ্চিত্র মানুষ টাকা দিয়ে টিকিট কিনে দেখতে যাবে কেন? 

আজ কথায় কথায় চলচ্চিত্র বিষয়ক ব্যক্তিবর্গ দর্শকদের রুচির মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেন, কিন্তু নিম্নমানের চলচ্চিত্র নির্মাণ করে যারা সমাজকে রসাতলে ডুবাচ্ছেন, তাদের রুচি ও শিল্পবোধ নিয়ে প্রশ্ন তুললে কী জবাব দেবেন শুনি? আমাদের বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের সার্বিক সহযোগিতায় আমি প্রায় দুই ডজন প্রামাণ্য চিত্র নির্মাণ করেছিলাম। প্রয়াত কামাল লোহানী, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীসহ আরো অনেককেই আমি সেইসব প্রামাণ্য চিত্র নির্মাণকালে যুক্ত করেছিলাম। একটি প্রামাণ্য চিত্র নির্মাণ করার জন্য আমাকে বম্বে পর্যন্ত যেতে হয়েছিল পুরাতন  ভিডিও ফুটেজ জোগাড় করার জন্য। সে সময় আমি উপলব্ধি করেছি একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করতে যদি এত মানুষের সহযোগিতার দরকার হয়, তাহলে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে কী বিশাল কর্মযজ্ঞ করতে হয়। আজকালকার বাংলাদেশের চলচ্চিত্র দেখলে বোঝা যায়, এগুলোর অধিকাংশই অত্যন্ত নিম্নমানের এবং শিল্প নামের অযোগ্য।

কালো টাকার মালিকগণ এদেশে চলচ্চিত্র প্রযোজনা করতে এসে চলচ্চিত্র শিল্পের কবর রচনা করেছেন। আজকালকার প্রযোজকগণ শিল্পসফল চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে চান না, তারা ব্যবসা সফল চলচ্চিত্র নির্মাণে মরিয়া। কালোবাজারিদের খপ্পরে পড়তে বাধ্য হচ্ছে এদেশের চলচ্চিত্র পরিচালক ও কলাকুশলীগণ। তাছাড়া চলচ্চিত্র কর্মীদের চারিত্রিক স্খলন এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে ভক্তরাও বিরক্ত হচ্ছেন তাদের স্বপ্নের নায়ক-নায়িকার প্রতি। নানামুখী সংকটে ডুবতে বসেছে চলচ্চিত্রের রূপালি তরী। এত বাধার পাহাড় ঢেলে আবার কি কখনো মসৃণ পথে হাঁটবে না বাংলা চলচ্চিত্র? নিশ্চয়ই আবার বাংলাদেশের তথা বাংলা চলচ্চিত্রের সুদিন আসবে, তবে সেজন্য আমাদের আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

এক দশক আগেও তারেক মাসুদ, হুমায়ূন আহমেদের মতো প্রতিভাবান মানুষেরা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে একটি নবপ্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তাদের দেখাদেখি অনেকেই তখন রুগ্ন চলচ্চিত্রের শুশ্রূষা করতে এগিয়ে এসেছিলেন। তারেক মাসুদ ও হুমায়ূন আহমেদের অকালপ্রয়াণে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র অপূরণীয় ক্ষতির মুখে পড়েছে। বর্তমানে অনেক শিক্ষিত তরুণ চলচ্চিত্রে আসছেন। এদের অনেকের কাজই দেশে-বিদেশে প্রশংসিত হচ্ছে। কয়েকদিন আগে ঢাকার একটি অভিজাত সিনেপ্লেক্সে দেখলাম মাননীয় কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাকের পুত্র সুমিতের ‘নোনা জলের কাব্য’ চলচ্চিত্রটি। বিষয়ভিত্তিক এই চলচ্চিত্রটি একই সঙ্গে শিল্পসফল ও ব্যবসা সফল হয়েছে বলেই জানি। চলচ্চিত্রটি বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সম্মাননাও পেয়েছে। তারেক মাসুদের ‘মুক্তির গান’, ‘মাটির ময়না’ চলচ্চিত্র কিংবা হুমায়ূন আহমেদের ‘আগুনের পরশমণি’র মতো চলচ্চিত্র এদেশে বেশি বেশি নির্মাণ হওয়া দরকার। সেই সাথে দরকার সুস্থ, সুন্দর বিনোদনধর্মী চলচ্চিত্র। 

গৌতম ঘোষের বিশ্ববিখ্যাত ‘মনের মানুষ’ চলচ্চিত্রটি যখন নির্মাণ করা হয়, তখন আমি গৌতম ঘোষের জন্য বই কিনে পাঠিয়েছিলাম কোলকাতায়। মহাত্মা লালন ফকিরের জীবনীনির্ভর ‘মনের মানুষ’ চলচ্চিত্রে আমার আরেকজন প্রিয় মানুষ যুক্ত ছিলেন, তিনি হলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ফ্যাশন ডিজাইনার বিবি রাসেল। ‘মনের মানুষ চলচ্চিত্রে বিবি রাসেল পোশাক ডিজাইনারের পাশাপাশি একটি বিশেষ ভূমিকায় অভিনয়ও করেন। সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য হলেও বিবি রাসেল সেই অভিনয় নৈপুণ্যের জন্য দর্শকদের অন্তর জুড়ে রয়েছেন। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল বাংলাদেশের বরেণ্য মানুষদের সঙ্গে ‘মনের মানুষ’ চলচ্চিত্রের উদ্বোধনী শো দেখার। প্রথম দেখাতেই আমাদের অনেক দর্শক মন্তব্য করেছিলেন- ‘চলচ্চিত্রটি মানুষের মন জয় করবে।’ পরবর্তীতে আমরা সে কথা শতভাগ সফল হতে দেখেছি। বাংলাদেশে চলচ্চিত্র শিল্প বিকাশের জন্য দারুণ এক পরিবেশ আছে। ষোলো কোটি মানুষের একটি বৃহৎ বাজারে যদি এদেশের চলচ্চিত্র নির্মাতারা শিল্পসফল চলচ্চিত্র নির্মাণ করে ব্যবসা করতে না পারেন, তাহলে সে দোষ কী দর্শকদের একার?

সময়ের সাথে সাথে মানুষের মূল্যবোধ বদল হওয়াই স্বাভাবিক। সমাজ কাঠামো, এর রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি যদি চলচ্চিত্র কর্মীদের আলোড়িত না করে, নতুন কিছু সৃষ্টি করতে অনুপ্রাণিত না করে, তাহলে শুধু ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য চলচ্চিত্র নির্মিত হলে সেই চলচ্চিত্র থেকে মানুষ তো মুখ ফিরিয়ে নেবেই। আমরা চারদলীয় জোট সরকারের আমলে সিনেমা হলে বোমা মেরে চলচ্চিত্র শিল্পকে ধ্বংস করার চক্রান্ত দেখেছি। বিএনপি সরকার বোমা মেরে হল শূন্য করার ষড়যন্ত্র করেছিল। কিন্তু বর্তমানে সেই চক্রান্তকারীদেরই শিষ্য-প্রশিষ্যগণ চলচ্চিত্রকে মানশূন্য করার পাঁয়তারা করছে। যারা মনে প্রাণে চলচ্চিত্রের মানুষ নয়, তাদেরকে চলচ্চিত্র অঙ্গণ থেকে বিদায় করে সত্যিকারের চলচ্চিত্রপ্রেমীকদের চলচ্চিত্র অঙ্গণে প্রবেশ ঘটুক, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রপ্রিয় মানুষের মতো আমিও এমনটাই প্রত্যাশা করি। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের আকাশ থেকে কালো মেঘ কেটে গিয়ে আলো আসুক, আবারও চলচ্চিত্র হয়ে উঠুক সমাজ বদলের বারুদভরা হাতিয়ার। অশিক্ষা, কুসংস্কার ও মৌলবাদের শৃঙ্খল থেকে চলচ্চিত্র মানুষকে মুক্তি দেবে- এটাই হোক চলচ্চিত্র কর্মীদের অঙ্গীকার।  

লেখক: রাজনীতিবিদ, লেখক, কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক, গীতিকার ও মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ