মতামত

সরস্বতী : জ্ঞান, প্রজ্ঞা, শুদ্ধতার দেবী

মাঘ মাসের শেষে যখন প্রকৃতিতে ফাগুনের আগমনী বার্তা শোনা যায়, যখন প্রকৃতি আড়মোড় ভেঙে জেগে ওঠে নতুন সতেজতায়, গাছে গাছে পাখির কলকাকলিতে ভরে ওঠে তখন সনাতন ধর্মের দেবী সরস্বতীর আগমন ঘটে। 

সরস্বতী পূজা বাংলাদেশ, ভারত, জাভা এবং আরও কয়েকটি দেশে অনুষ্ঠিত হয়। সনাতন বা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে দেবী সরস্বতী বিদ্যার দেবী হিসেবে সমধিক পূজনীয় ও পরিচিত। আমাদের সমাজ ছেয়ে আছে কুসংস্কারের কালো ছায়ায়। আলো যেমন অন্ধকার দূর করে, সেভাবেই শিক্ষা, জ্ঞান, প্রজ্ঞা সমাজের কুসংস্কার, ভ্রান্ত ধারণা দূর করে সমাজ আলোকিত করে, মানুষকে সঠিক পথ দেখায়। দেশ ও জাতির উন্নয়নে, বিদ্যা, বুদ্ধিতে শিক্ষার বিকল্প নেই। এ কারণেই দেবী সরস্বতীর পূজা ছাত্রছাত্রীদের মাঝে বিশেষভাবে ব্যাপক উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। 

মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে বসন্ত পঞ্চমী রূপে পালন করা হয়। বিদ্যার দেবী হিসেবে সমধিক পরিচিত হলেও দেবী বাগদেবী হিসেবেও প্রসিদ্ধ। এ ছাড়াও তিনি জ্ঞান, সঙ্গীত, শিল্পকলা, বাক্য, প্রজ্ঞার দেবী হিসেবেও পরিচিত। বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, সংহিতা, রামায়ণ, মহাভারতে দেবী সরস্বতীর বিভিন্ন কাহিনী বর্ণিত আছে। তবে আমরা যে সরস্বতীর আরাধনা করি তিনি মূলত বৈদিক দেবী। আবার সরস্বতী নদী নামেও প্রসিদ্ধ নদী রয়েছে। বৈদিক সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে নদীটি প্রতিষ্ঠিত ছিল। তিনি শ্বেত বর্ণা ও শ্বেতবস্ত্র পরিহিতা। 

দেবী সরস্বতীর সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যায়, ইন্দো ইউরোপীয় দেবী এথেনি মিনার্ভা প্রমুখদের। সরস্বতী শব্দের আদি অর্থ হলো প্রবাহিত জল বা নদী। শব্দটি সরস+বতু আর স্ত্রী লীঙ্গে ‘ঈ’ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে সরস্বতী। পলাশ ফুল দেবীর প্রিয়। তাই তিনি ‘পলাশপ্রিয়া’ নামেও পরিচিত। বাগ অর্থ কণ্ঠ। আর আমাদের কণ্ঠে যিনি উপবেশিত। আমাদের জ্ঞানের পথ দেখান, আমাদের সত্য দর্শন করান তিনিই দেবী সরস্বতী। আমরা যে কথা বলি এবং যা সঠিক বলতে শিখি তা দেবী সরস্বতীর আর্শীবাদস্বরূপ। দেবীর বাহন রাজহংস। তবে দেবীকে পদ্মা উপবেশনা এবং পাশে রাজহংস থাকতেও দেখা যায়। আবার ময়ূর কোথাও কোথাও দেখা যায়। 

দেবীর হাতে বীণা থাকে। জ্ঞানময়ী দেবী সবর্ত্রব্যাপীনী। কথায় বলে, রূপে লক্ষ্মী আর গুণে সরস্বতী। অর্থাৎ দেবী সরস্বতীর মতো গুণ অর্জন করার প্রচেষ্টা থাকতে হবে। সরস্বতী বৈদিক দেবীদের একজন। তবে এই দেবীর বর্তমান রূপ আধুনিককালে প্রচলিত হয়েছে। দেবর্ষি নারদ তাকে বলেছেন জগন্ময়ী, ব্রহ্মময়ী, কোটিন্দুমুখী। আবার ঋষি যাজ্ঞবল্ক বলেছেন, জ্যোতিরূপা সনাতনী পরমা ব্রহ্মস্বরূপা। 

জানা যায়, ঊনবিংশ শতাব্দীতে পাঠশালায় প্রতি মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে ধোয় চৌকির উপর তালপাতার তাড়ি ও দোয়াত কলম রেখে পূজা করার প্রথা ছিল। শ্রীপঞ্চমী তিথিতে ছাত্রছাত্রীরা বাড়িতে পুস্তক বা বই, শ্লেট, কলম, দোয়াত ইত্যাদি পাশে রেখে পূজা করতো। বিংশ শতাব্দীতেও এই পূজা এভাবেই প্রচলন ছিল। বর্তমানে দেশের বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়। শ্রীপঞ্চমীর দিন সকালেই সরস্বতী দেবীর পূজা সম্পন্ন করা হয়। প্রচলিত আছে যে সরস্বতী পূজার পূর্বে কুল খাওয়া যায় না। আজও অনেকেই সেই বিধান মেনে চলেন। মূলত সরস্বতী পূজায় ফল উপাচারের সাথে কুল দেওয়া হয় এবং প্রতিটি দোয়াতের ওপর কুল দেওয়া হতো। সেখান থেকে দেবীকে উৎসর্গ না করে কুল খাওয়া যেতো না। কালক্রমে এটি বিধিতে পরিণত হয়। 

পৌরাণিক স্বীকৃতি আছে মাঘ মাসের শুক্ল পক্ষের পঞ্চমী তিথির জ্ঞান এবং বাণীর দেবী মা সরস্বতী ব্রহ্মার মুখ থেকে মর্ত্যে অবতরণ করেন। এই দিনটি দেবী সরস্বতী পূজার জন্য বিশেষভাবে পালন করা হয়। এই কারণেই প্রতি বছর বসন্তে পঞ্চমীতে সরস্বতী পূজা পালন করা হয়। কথিত আছে যে, রামায়নের অন্যতম চরিত্র রাক্ষস রাজ রাবণের ভাই কুম্ভকর্ণ যখন তার সাধনায় তুষ্ট করে বর চান তখন দেবী সরস্বতী তার কণ্ঠে অধিষ্ঠিত হয়ে ঘুমানোর বর চাওয়ান। কারণ কুম্ভকর্ণ ছিল যেমন বিশাল তেমন শক্তিশালী যা বিশ্বের ক্ষতির কারণ হতে পারতো। ঘুমানোর বর চাওয়ার ফলেই তিনি বেশিরভাগ সময় কেবল ঘুমিয়েই কাটাতেন। 

দেবী সরস্বতীর আরও বহু কাহিনী রয়েছে। তিনি পৃথিবীকে সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনার জন্য মানুষের বিবেক ও মুনষ্যত্বকে জাগ্রত করেন। এক তথ্যে জানা যায়, সরস্বতী একসময় শাক্ত দেবী রূপে সুপরিচিত ছিলেন। পুরাণ অনুসারে তিনি বৃত্র নামে এক অসুরকে বধ করেছিলেন। তবে কালক্রমে এই রূপের পরিবর্তে দেবীর বীণা হাতে জ্ঞানপ্রদায়িনী রূপটিই প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে। দেবীর হাতে রয়েছে বীণা। বীণায় ওঠ সুর। পৃথিবীতে সুরের অর্থাৎ ছন্দের দরকার। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘পুরস্কার’ কবিতায় রচনা করেছেন ‘বিমল মানস সরসবাসিনী/ শক্লবসনা শুব্রহাসিনী/ বীণাগঞ্জিত মঞ্জুভাষিণী/ কমলকুঞ্জাসনা।’

পূজার দিন শিশুদের হাতে খড়ির মধ্যে দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষাজীবন শুরু হয়। তিনি শুচিতা ও শুদ্ধ রাখার প্রতীক। দেবী সরস্বতী তাই মর্ত্যে মহাধুমধামে পূজিত হন।